রাজ্যের আট দফা নির্বাচন মধ্যম পর্বে প্রবেশ করছে। এপর্যন্ত অভিজ্ঞতা হল, ভোটদানের ইচ্ছাশক্তির ভালোমাত্রায় প্রকাশ ঘটতে চাইলেও ভোটপর্ব পুরোদস্তুর অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হতে পারেনি। কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন পুলিশ ও প্রশাসনিক অফিসারদের বহু রদবদল করেছে, কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতি রয়েছে পর্যাপ্ত সংখ্যায়, তবু তাদের ভূমিকা নিয়ে অনেক অভিযোগ উঠেছে। যেখানে দৃঢ় ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন সেখানে অথচ দেখানো হয়েছে শিথিলতা, আবার অনেক ক্ষেত্রে এতটুকু নিরপেক্ষতা বজায় রাখেনি, প্রচ্ছন্নভাবে পক্ষপাতিত্ব করা হয়েছে বিজেপির প্রতি। বিজেপির তরফে খোলাখুলি চালানো হচ্ছে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ-বিভাজনের ভিত্তিতে ভোট মেরুকরণের ঘৃণ্য প্রচার। এটা শুরু করে দেওয়া হয়েছে নন্দীগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্র থেকেই। অবাধে দেগে দেওয়া হয় ‘পাকিস্তান পন্থী’! চক্রান্ত ষড়যন্ত্র চলছে নাকি ‘মিনি পাকিস্তান’ বানানোর! সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও প্রতিপক্ষ প্রার্থীকে কোণঠাসা করতে ঐ ধংসাত্মক প্রচারকে ছড়িয়ে দেওয়া হয় সর্বত্র। রোড শো-সমাবেশে-মিডিয়া সাক্ষাতকারে এতে মদত দেন মোদী-যোগী-শাহ-নাড্ডা’রা। বিপজ্জনক প্রচার সেখানেই থেমে থাকেনি। সন্দেহ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে সীমান্ত জেলাগুলোতে ভোট করানোর জন্য ঢোকানো হচ্ছে নাকি সীমান্তবর্তী ‘বাংলাদেশীদের’! এই ধরনের সাজানো তথ্যচিত্র ও খবর পরিবেশন করছে নির্বাচন পরিস্থিতিতে নতুন খোলা কিছু বাংলা চ্যানেল। বোঝাই যায় পেছনে রয়েছে শাসকশ্রেণীর কোন দলের হাত। এসব বিধিভঙ্গের প্রবণতা নির্বাচন কমিশন দেখেও দেখছে না। ফলে আরও বেপরোয়া হচ্ছে গেরুয়া দলটি, বিধিনিয়ম না মানতে আর পরিবেশকে বিষিয়ে দিতে। কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন মাত্রায়। রাতের অন্ধকারে গ্রামে পাড়ায় ঘরে ঘরে গিয়ে বা বুথের ভিতরে পদ্ম চিহ্নে ভোট দিতে প্রভাবিত করছে। সময়মতো মহল্লার মানুষের নিরাপত্তার প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় বাহিনীর দেখা মেলেনি। ঘটেছে বেশ কিছু সংঘর্ষ, রক্তপাত, প্রাণহানির ঘটনা। কয়েকটি ক্ষেত্রে প্রার্থীরও নিরাপত্তা মেলেনি। আক্রান্ত হয়েছেন বিভিন্ন দলের একাধিক প্রার্থী। তৃণমূলের হাতে মানসিক-শারীরিক হেনস্থা হয়েছেন সিপিএম থেকে বিজেপিতে যাওয়া মহিলা প্রার্থী। তেমনি অন্য এক কেন্দ্রে বিজেপির ভাষায় ‘জনরোষে’র মার থেকে জীবন বাঁচাতে পালাতে হয়েছে বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেওয়া মহিলা প্রার্থীকে। বিজেপির এক জেলা সভাপতি প্রকাশ্যে হুমকি দিয়েছেন, প্রয়োজনে ‘এনকাউন্টার’ করে শেষ করে দেওয়া হবে! নির্বাচন কমিশন ও তার নিয়োজিত কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক ও বিশেষ পর্যবেক্ষকরা তবু কোনও ব্যর্থতা স্বীকার করেননি, উল্টে উড়িয়ে দিয়েছেন প্রায় সমস্ত অভিযোগ, পিটিয়েছেন স্ব-স্ব ভূমিকার ঢাক! এই সেই উপলক্ষে ‘ধর ধর’ রব তুলে বাড়িয়ে দেওয়া হয় এনআইএ, ইডি, সিবিআই হানা। জঙ্গলমহলে ভোট শেষ হতেই ‘নিয়া’ লাগিয়ে ফের গ্রেপ্তার করা হল বারটি বছর কারাজীবনের ভুক্তভোগী হয়ে সদ্য বাইরে আসা বহুল পরিচিত এক জনজাতি নেতাকে, অজুহাত দেখানো হল পুরানো মামলায় জেরা ও তদন্তের জন্য হেফাজতে নেওয়া প্রয়োজন। আসল কারণটি অন্য। ঐ জননেতা বাইরে থাকলে বিজেপি বিরোধী প্রচারে নামা বন্ধ করা যাবে না, প্রচারে থাকলে বিজেপির বিপদ। মুখ বন্ধ করতেই তাই আবার গ্রেপ্তার। কয়লার চোরা কারবার ধরতে সিবিআই-ইডিকে লেলিয়ে দেওয়ার পেছনে চোর ধরাটা গুরুতর উদ্দেশ্য নয়, তা যদি থাকত তাহলে বিজেপির ঠগ বাছতে দল উজার হয়ে যেত। আসল মতলব হল তৃণমূল-পুলিশ-আমলা চক্রের একটা চোরা যোগসাজশ যদি এই নির্বাচনী বাজারে খাইয়ে দেওয়া যায়। অর্থাৎ তার নির্বাচনী খাস স্বার্থের খাঁই মেটাতেই বিজেপির গোপনে গোপনে এত কলকাঠি নাড়া, এত তৎপরতা। এরই সাথে জনমানসকে দিগভ্রান্ত করতে চিৎকার জুড়ে দিচ্ছে— ‘বিজেপি নন্দীগ্রামে জিতে গেছে’! শুধু তাই নয়, সত্তর শতাংশ আসনে হৈহৈ করে বিশাল ব্যবধানে ‘জিতছে, জিতবে’!! এর উদ্দেশ্য হল, একটা হাওয়া তৈরি করা। হাওয়া তুলতে প্রচার করছে যথেচ্ছ মিথ্যাচার। মিথ্যাচারের সাথে উন্মত্ততা ছড়ানো, গুজব ছড়ানো — সবই তার মেরুকরণের কৌশল প্রয়োগের অঙ্গ। নির্বাচন কমিশনের দ্বিচারিতার নির্দিষ্ট প্রকাশ ধরা পড়ল তৃণমূল-বিজেপির দুই সর্বোচ্চ নেত্রী ও নেতার আচরণকে কেন্দ্র করেও। নন্দীগ্রামে বুথে ভোটারদের বাধা দেওয়া হচ্ছে খবর পেয়ে প্রার্থী হিসেবে উপস্থিত হয়েছিলেন তৃণমূল দলনেত্রী। সেখানে বহুক্ষণ অবস্থানও করেন। এতে নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ হয়েছে অভিযোগে নির্বাচন কমিশন কৈফিয়ৎ তলব করেছে। অন্যদিকে বিজেপির নির্বাচনী সভামঞ্চ থেকে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার বিধিবহির্ভূত ব্যবহার করে রাজ্যের আধিকারিকদের খোলাখুলি প্রশাসনিক দিলেন নরেন্দ্র মোদী! সরকারের বদল হবে ‘নিশ্চিত’ ধূয়ো তুলে ‘ডবল ইঞ্জিন সরকারে’র কাজ এখন থেকেই শুরু করে দিতে বললেন! এটা যুক্তরাষ্ট্রীয়তার কাঠামোকে অমান্য করার সাংবিধানিক অমান্যতা তো বটেই। নির্বাচনী আচরণ বিধি লঙ্ঘনেরও নিকৃষ্ট প্রকাশ। তবু হায়! নির্বাচন কমিশন থাকে মূক ও বধির হয়ে!
বেশ কিছুদিন যাবত সরব হচ্ছেন বাজপেয়ী আমলের এক প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, গুচ্ছের অভিযোগের তীর ছুঁড়ছেন মোদীরাজ ও বর্তমান বিজেপির বিরুদ্ধে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা করোনা অতিমারীর আগে থাকতেই অধোগতির শিকার হচ্ছিল। জড়িয়ে যাচ্ছিল মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যবৃদ্ধির আবর্তে। নোটবন্দীর জের অনুভূত হয় আজও। ব্যাপক অসংগঠিত ক্ষেত্রের অস্তিত্ব আধমরা হয়ে যায় তখন থেকেই। তারপরে অতিমারী কবলিত অবস্থায় হয়েছে আরও মৃত্যুমুখী। জিডিপি হ্রাস হয়ে চলেছে লাগাতার।
অর্থনীতি, গণতন্ত্র, যুক্তরাষ্ট্রীয়তা ও সংবিধানের বারটা বাজিয়ে ‘আত্মনির্ভর ভারত নির্মাণ’-এর নামে নয়া প্রতারণা শুরু করেছেন মোদী। অমিত শাহ তো প্রতিশ্রুতি দিয়ে তামাশায় পরিণত করেন হেসে খেলে। উত্তরবঙ্গের নির্বাচনী সফরে শাহ বলে দিলেন গোর্খা সম্প্রদায়ের এগারোটি গোষ্ঠীকে বিশেষ মর্যাদা মঞ্জুর করা হবে, চা শ্রমিকদের মজুরি বর্তমান স্তর থেকে দ্বিগুণ করা হবে, জমির পাট্টা দেওয়া হবে। আরও কত কি বলে দিলেন! যে দল ক্ষমতার চূড়ান্ত কেন্দ্রীকরণকেই পাখীর চোখ করেছে, আদিবাসী-জনজাতি সম্প্রদায়গুলোকে জীবন-জীবিকার প্রশ্নে পীড়িত করে চলছে, শ্রমিকের এযাবত সমস্ত অধিকারকে চারটি লেবার কোডে আবদ্ধ করার পলিসি বানিয়েছে, তারা আবার ভোট পেতে প্রতিশ্রুতির ছলনার আশ্রয় নিচ্ছে।
এই সবকিছুকে মোকাবিলার চ্যালেঞ্জটা নতুন করে জোরদার করা দরকার। দেশজুড়ে বিজেপি জমানার শেষের শুরুর অভিযানটা ত্বরান্বিত করা প্রয়োজন। এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব এসে পড়েছে বাংলার জনগণের ওপর।