কানোরিয়া জুট মিলে যখন তীব্র আন্দোলন চলছে সেখানে চলে গিয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষ। সেটা ১৯৯৪ সাল। কানোরিয়া পাটকলের শ্রমিকদের সমর্থনে অনেকেই যাচ্ছেন সংহতি জানাতে। শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে রেললাইন পেরিয়ে সিং পাড়াতে গেলেন। শাসকের রঙ দেখেননি কোনও দিন। শাদাকে শাদা, কালোকে কালো বলার নম্র হিম্মত তাঁর ছিল। পরবর্তীকালে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম থেকে ভাঙ্গড় সর্বত্র তাঁর অবস্থান ছিল স্পষ্ট, সেই অবস্থানের সঙ্গে কেউ একমত না হতে পারেন। সঙ্ঘপরিবারের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদী ভূমিকা আমরা জানি। বাবরি মসজিদ ভাঙার সময় গর্জে উঠেছিল তাঁর কলম। বিহারে রণবীর সেনার আক্রমণে যখন কমিউনিস্টরা খুন হচ্ছেন তখনও তিনি নিশ্চুপ ছিলেন না।
যদিও বধির, তবু ধ্বনিরও তো ছিল কিছু দেনা
সবই কি মিটিয়ে দিয়ে গেল তবে রণবীর সেনা?
আরওয়াল গণহত্যার পর প্রতিবাদে ফেটে পড়ে লিখছেন -
‘ওদের ব্রহ্মর্ষি সেনা, ওদের চক্রের ব্যূহ ঘেরা
ওদের রাইফেলে গুলি ওদের পুলিশ সুপারেরা’
ইদানীং ‘সালোয়া জুড়ুম’ শব্দটি শুনতে শুনতে সেই আরওয়ালের কথা মনে পড়ে। গুজরাত দাঙ্গার পরে লেখা তাঁর বিখ্যাত লাইন -
‘নারায়ণ নয়, আমি পেয়ে গেছি নারায়ণী সেনা।
যতদূর যেতে বলি যায় এরা, কখনো আসেনা কোন কূটতর্ক নিয়ে,
ভাবলেশহীন ধ্বংস হাতে ছুটে যায়। যদি বলি দিন বলে দেয় দিন
যদি বলি রাত, বলে রাত’।
শঙ্খ ঘোষের প্রকৃত নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ। মা অমলাবালা, পিতা মণীন্দ্রকুমার ঘোষ। শঙ্খবাবু বঙ্গবাসী কলেজ, সিটি কলেজ, যাদবপুর, দিল্লি ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপনা করেছেন। বাবরের প্রার্থনা কাব্যগ্রন্থটির জন্য তিনি ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৬ সালে লাভ করেন ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার তাঁর উল্লেখযোগ্য গদ্য রচনা “বটপাকুড়ের ফেনা”র জন্য। তাঁর বিশেষ গ্রন্থগুলি হল : মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে, উর্বশীর হাসি, ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ ইত্যাদি।
মনে পড়ে ১৪ এপ্রিল, ২০০২ সালে গুজরাত গণহত্যার প্রতিবাদে তাঁর কলম গর্জে ওঠে। তিনি লিখেছিলেন, “না, ধ্বংসকে বিধিলিপি ভেবে আমরা চুপ করে থাকব না আর … গুজরাত জ্বলছে। শিশুঘাতী নারিঘাতী কুৎসিত বীভৎসার এক নারকীয় তাণ্ডব চোখের সামনে আমাদের দেখতে হচ্ছে আজ। কোন ভাষায় আমরা জানাব আমাদের ধিক্কার আমাদের ক্রোধ আমাদের লজ্জা আমাদের অপমান? ... শুধু গুজরাত নয়, ভিতরে ভিতরে জ্বলছে গোটা দেশটাই?”
২০০৬ সালে নন্দীগ্রামে গণহত্যার প্রতিবাদে শঙ্খ ঘোষ নেমে এলেন রাজপথের মিছিলে। কলকাতার সেই মিছিল এখনও অনেকের মনে আছে। সেদিনও শঙ্খবাবু পথে নেমেছিলেন নিজের বিবেকের তাগিদে। রাজনৈতিক নেতা বা নেত্রী থাকলে তিনি হাঁটবেন না। তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাঁটা হয়নি সেই মিছিলে।
একজন বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত তা শঙ্খ ঘোষ নিজের কাজ দিয়ে বার বার প্রমাণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে কিছু বলা দরকার। কেননা, এক শ্রেণির উচ্ছিষ্টভোগীকে বাংলার মানুষ বুদ্ধিজীবী ভেবে প্রায়শই গালাগালি দেন।
বুদ্ধিজীবীরা কেন তাঁদের মতামত জানান? এর উত্তর প্রথাগতভাবে দুটো। এক, ব্যক্তিগত প্রবণতা। দুই, পেশাগত ভূমিকার দায়বদ্ধতা। কোনও একজন বুদ্ধিজীবীর ক্ষেত্রে এই দুটো কারণ একই সঙ্গে কাজ করতে পারে, আবার কোনও একটি একক বোধ তাঁকে সিদ্ধান্ত গঠনের পথে নিয়ে যেতে পারে। বৌদ্ধিক প্রবণতা অথবা আগ্রহ বিভিন্ন ব্যক্তির ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকার। বৌদ্ধিক প্রবণতার তীব্রতা অনুসারে এই পার্থক্যের জন্ম। জরুরি কথা হল, যাঁরা তথাকথিত অবৌদ্ধিক পেশার সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের ভেতরেও বিভিন্ন মাত্রায় বৌদ্ধিক ভূমিকা পালন করার প্রবণতা দেখা যায়। এখানে ‘অবৌদ্ধিক পেশা’ কথাটায় আপত্তি থাকতে পারে। কেননা সেই অর্থে কোনও পেশাকে অবৌদ্ধিক বলা যায় না। সুতরাং গতানুগতিক ধারণাকে বিসর্জন দিয়ে সব মানুষকে বুদ্ধিজীবী আখ্যা দেওয়া যেতে পারে।
কিন্তু সত্যিই কি সব মানুষ বুদ্ধিজীবী? এই প্রশ্নের দুটো উত্তর পাওয়া যেতে পারে। বিংশ শতাব্দীর দু জন চিন্তাবিদ এর ভিন্ন ভিন্ন উত্তর দিয়েছেন। একজন অ্যান্টনিও গ্রামশি, অন্যজন জুলিয়েন বেন্দা। গ্রামশি ইতালীয় মার্কসবাদী, সক্রিয় কর্মী, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক দার্শনিক। মুসোলিনি তাঁকে ১৯২৬ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত কারাগারে বন্দি করে রাখেন। ‘প্রিজন নোটবুকস’-এ গ্রামশি বলেছিলেন, “সব মানুষ বুদ্ধিজীবী, সুতরাং একজন বলতে পারেন : কিন্তু সমাজে সকল মানুষের কাজ বুদ্ধিজীবীর নয়।” গ্রামশির এই কথা থেকে বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে দ্বান্দ্বিক ধারণাটি ধরা পড়ে। যে কোনও কাজ, তা সে কায়িক পরিশ্রম হোক, আর বৌদ্ধিক কাজ—সব মানবিক কাজেই বুদ্ধির দরকার হয়। এই কথাটা আমরা প্রায়ই বিস্মৃত হই এবং কায়িক ও মানসিক শ্রমের বিরোধিতার মুখোমুখি হই। একজন লেখক শুধু বুদ্ধির জোরে লিখতে পারেন না, তাঁকেও কায়িক পরিশ্রম করতে হয়। তেমনি যে মানুষটি মাছ ধরেন অথবা লোহা পেটান তাঁকেও নির্ভর করতে হয় বুদ্ধির উপর। গ্রামশি সব মানুষকে বুদ্ধিজীবী বললেও তিনি এই কথাটায় জোর দেন— “সমাজে সকল মানুষের কাজ বুদ্ধিজীবীর নয়।” বুদ্ধিজীবীর একটা ভূমিকা থাকা দরকার, সামাজিক ভূমিকা। ইতিহাস পর্যালোচনা করে গ্রামশি বুদ্ধিজীবীর কাজ ভূমিকাকে দু’ভাবে দেখেছেন। একদলকে তিনি বলছেন গতানুগতিক, চিরাচরিত বা ট্রাডিশনাল বুদ্ধিজীবী — যাঁদের মধ্যে শিক্ষক, ধর্মপ্রচারক, প্রশাসকরা রয়েছেন। তাঁরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম একই ভূমিকা পালন করে আসছেন। এই বুদ্ধিজীবীরা বিশেষ কোনও শ্রেণির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত নন। দ্বিতীয় ধরনের বুদ্ধিজীবীদের গ্রামশি বলছেন অর্গ্যানিক বা সাংগঠনিক বুদ্ধিজীবী, যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে কোনও শ্রেণির সঙ্গে যুক্ত। তাঁরা উঠতি সামাজিক শ্রেণির মুখপাত্র। ট্রাডিশনাল বুদ্ধিজীবীদের থেকে বিকাশের উত্তরণে সাংগঠনিক বুদ্ধিজীবীরা উদ্ভূত হতে পারেন। আবার শ্রেণির ভাঙনে বা বিশৃঙ্খলায় অর্গ্যানিক বুদ্ধিজীবী চিরাচরিত বুদ্ধিজীবীতে পরিণত হতে পারেন। প্রতিটি সামাজিক শ্রেণি যখন পূর্বের অর্থনৈতিক কাঠামো থেকে জন্ম নেয় তখন সেই শ্রেণি ট্রাডিশনাল বুদ্ধিজীবীদের পেয়ে থাকে। তাঁরা শত জটিলতা ও পরিবর্তনের মধ্যেও ইতিহাসের ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন। একজন পুরোহিত একটা সময়ে সাংগঠনিক বুদ্ধিজীবী ছিলেন, কিন্তু ধনতন্ত্রের বিজয় অভিযানে তাঁদের এই ভূমিকা বাতিল হয়ে যায়। গ্রামশি বিশ্বাস করতেন অর্গ্যানিক বুদ্ধিজীবীরা সমাজে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকেন, তাঁরা মানসিকতার পরিবর্তন এবং বাজার প্রসারণে নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যান। অন্যদিকে শিক্ষক বা পাদ্রি এই ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত নন, তাঁরা বছরের পর একই ধরনের কাজ করে যান; একই জায়গায় অবস্থানকে অপরিবর্তনীয় রেখে।
শিক্ষক শঙ্খ ঘোষ, কবি শঙ্খ ঘোষ সব সময় ঝুঁকি নিয়েছেন। ঝুঁকিহীন আরামের জীবন, অন্যায়কে মেনে নিয়ে ঘরে বসে থাকার জীবন যা তিনি চাইলেই পেতে পারতেন, তাঁর শিক্ষক-খ্যাতি, কবি-খ্যাতি তাতে কমতো বা বাড়তো না। কিন্তু তিনি শঙ্খ ঘোষ। তিনি সময়ের ট্রাডিশনকে গড়েছেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বা মহাকবি ইকবালের যথার্থ উত্তরসূরি শঙ্খ ঘোষ।
২০১৮ সালে ভাঙড় আন্দোলনের সময় তিনি রাজ্য সরকারকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলার আর্জি জানান। তিনি লেখেন, স্থানীয় গ্রামবাসীরা আজ ধারাবাহিক সংঘর্ষ, খুন, কারাবাস আর পুলিশি নির্যাতনের শিকার। স্বাভাবিক জীবন সেখানে (ভাঙড়ে) আজ সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। তাঁর কথায়, ‘আমাদের গোটা দেশের দুর্ভাগ্য, যে কোনও সঙ্গত দাবি বা বিক্ষোভের প্রকাশকেও সরকার পক্ষ যেন ধরে নেন কোনও বিরোধী রাজনৈতিক দলের ষড়যন্ত্র।’
নতুন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে দিল্লির সীমান্তে লড়ছেন লক্ষ লক্ষ কৃষক। নতুন কৃষি আইন চালু হলে চুক্তি চাষ হবে, কৃষকের জমির অধিকার থাকবে না। ফসলের মূল্য লাগামছাড়া হবে। রেশন ব্যবস্থা উঠে যাবে, উঠে যাবে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন। এই কৃষি আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন শঙ্খ ঘোষ। তিনি বলেছেন, ‘রাষ্ট্রশক্তির চাপিয়ে দেওয়া সর্বনাশা কৃষি আইন বাতিল করার দাবিতে গোটা দেশের কৃষক সমাজ কিছু দিন ধরে এক দুঃসাহসিক আন্দোলনে রত। রাজনৈতিক দল-মত নির্বিশেষে, নেতা-কর্মী ছাত্র-যুবা শিল্পী-সাহিত্যিকদের সঙ্গে মিলিত ভাবে আমিও চাই যে, সর্বতোভাবে সফল হোক এই আন্দোলন’।
বাবর তাঁর আয়ু দিয়ে দিয়েছিলেন অসুস্থ উত্তরসূরিকে। তাঁর আর্জি ছিল আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক। বাবরের জবানিতে কবির সেই প্রার্থনা যেন সত্য হয়।
এই তো জানু পেতে বসেছি, পশ্চিম
আজ বসন্তের শূন্য হাত —
ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।
কোথায় গেল ওর স্বচ্ছ যৌবন
কোথায় কুড়ে খায় গোপন ক্ষয়!
চোখের কোণে এই সমুহ পরাভব
বিষায় ফুসফুস ধমনী শিরা!
জাগাও শহরের প্রান্তে প্রান্তরে
ধূসর শূন্যের আজান গান ;
পাথর করে দাও আমাকে নিশ্চল
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।
না কি এ শরীরে পাপের বীজাণুতে
কোনোই ত্রাণ নেই ভবিষ্যের
মৃত্যু ডেকে আনি নিজের ঘরে?
না কি এ প্রসাদের আলোর ঝল্ সানি
পুড়িয়ে দেয় সব হৃদয় হাড়
এবং শরীরের ভিতরে বাসা গড়ে
লক্ষ নির্বোধ পতঙ্গের?
আমারই হাতে এত দিয়েছ সম্ভার
জীর্ণ ক’রে ওকে কোথায় নেবে?
ধ্বংস করে দাও আমাকে ঈশ্বর
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।
সে ছিল জরুরি অবস্থার কাল। এখনও কি তা নয়?
- শামিম আহমেদ
২২ এপ্রিল ২০২১