ষড়যন্ত্রের নয়া রূপ
A new form of conspiracy

বিজেপি পশ্চিমবাংলার বিধানসভা নির্বাচনে হার মেনে নিতে পারছে না। শুধু তাই নয়, আসন সংখ্যার বিচারে বিশাল ব্যবধানে পরাজিত হতে হয়েছে। গত লোকসভা নির্বাচনে বিধানসভা ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার তুলনায়ও এবার বহু আসনে নেমে যেতে হয়েছে। ঘা খেতে হল উগ্র হিন্দুত্বের মেরুকরণের রাজনীতিতে, ডবল ইঞ্জিন সরকারের ওকালতিতে। সবকিছু ঢেলেও সবচেয়ে বড় ধাক্কা লেগেছে দলের ফ্যাসিবাদী ধূর্তামীতে, দম্ভে, ঔদ্ধত্যে, আগ্রাসনে। এই সবকিছুকে প্রত্যাখ্যান করেছে গণরায়। ২০১৪-তে কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর থেকে, বিশেষত ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে এখানে অপ্রত্যাশিত ‘আগে রাম পরে বাম’ যোগফল পেয়ে, বিজেপি অনেক জাল বুনে আসছিল, কি করে এখানে ক্ষমতা হাসিল করা যায়, কেবল আরেকটা রাজ্য মাত্র দখল করা নয়, তা ছাড়াও আরও গভীর আরও ব্যাপক গেরুয়া নকশা রয়েছে। এযাবৎ বাংলার যা কিছু প্রগতিশীল বৈশিষ্ট্য সবই পাল্টে দেওয়ার দৌরাত্ম্য শুরু করে দেওয়া, আর, অতীতের দেশভাগের যন্ত্রণা খুঁচিয়ে তুলে আরেকবার ধর্ম-রাজনীতির বিদ্বেষ-বিভাজনের জিগিরে গোটা দেশকে ভাসাতে পশ্চিমবঙ্গকে ব্যবহার করা। এত কিছু পরিকল্পনা একটা গণরায়ে এভাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার পরিণতি বিজেপি কিছুতেই হজম করতে পারছে না। তাই তার শয়তানির শেষ নেই।

স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে উঠে-পড়ে লাগা হচ্ছে নিত্যনতুন ‘ইস্যু’ পাকিয়ে। পরিকল্পনা ও পরিচালনায় রয়েছে দলের দিল্লীর সদর-দপ্তর, মোদী-শাহ-নাড্ডা-মালব্যরা। মওকা তৈরি করতে দফায় দফায় দলের টিম পাঠানো হয়েছে রাজ্যপালের কাছে। কখনও সন্ত্রাস ও হিংসার অভিযোগে নালিশ ঠুকতে। কখনও ‘সৌজন্য সাক্ষাৎ’-এর ছুতোয়। অনতিবিলম্বেই ধরা পড়তে থাকে পরের ষড়যন্ত্রের প্রস্তুতি পর্ব। রাজ্যপালের কেবল বিজেপির সাংসদ-বিধায়কদের সঙ্গে নিয়ে চরকি মারা, টুইট করা, সংবাদ মাধ্যমে খবর করা চলতে থাকে। মাঝে ঘুরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অনুসন্ধানকারী দলকে। এসব করে চলার সাথে সাথে তৃণমূলের ক্ষমতাধীনে ‘আইনের শাসন ভেঙে পড়েছে’, ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য দরকার রাষ্ট্রপতির শাসন’ — বলা হতে থাকে এমনসব কথা। কিন্তু এতসব করেও পরিবেশ যখন ঘেঁটে দেওয়া সম্ভব হল না, তখন অতর্কিতে নামানো হল ‘নারদ’ ধরার অভিযান। গেল গেল রব ওঠে এমন বিশাল সংখ্যায় কেন্দ্রীয় সশস্ত্র বাহিনী সহযোগে সংঘটিত হল সিবিআই হানা ও গ্রেপ্তারী। এ নিছক দুর্নীতিতে যুক্ত শাসকদলের নেতা-মন্ত্রীদের শায়েস্তা করার অভিযান নয়। নতুন করে ছলে-বলে- কৌশলে রাজ্যের ওপর কেন্দ্রের নতুন চাপ চাপিয়ে দেওয়ার পদক্ষেপ, রাজ্য পরিস্থিতির ও রাজনীতির রাশ ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা। এই অপচেষ্টায় বিজেপি এতই মরীয়া যে, আইনকানুন ও গণতন্ত্রের চোখ-কানের মাথা খেয়ে হানা নামিয়েছে, বর্তমান ও প্রাক্তন মিলিয়ে তৃণমূলের চার মন্ত্রী-নেতাদের গ্রেপ্তার করেছে, ধর্তব্য মনে করেনি এর সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে। এই গ্রেপ্তারীর তীব্র নিন্দা করেছে বাকী সমস্ত রাজনৈতিক দল। বিজেপি পড়েছে একঘরে। বিরোধিতায় সরব হয়েছেন এমনকি সদ্য নির্বাচনে বিজেপির প্রতি আনুগত্য দেখানো টলিউড ও টেলিউডের কিছু মুখ। এরা কোনো পক্ষই দুর্নীতিকে প্রশ্রয় বা আড়াল দিতে, দুর্নীতির মূলোৎপাটনে বাগড়া দিতে চান না। যদিও নাগরিক জনতার ব্যাঙ্কে সঞ্চিত সম্পদ হাতিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া ঠেকাতে না পারা, আটকাতে না চাওয়া, কার্গিল কফিন বরাত-ভ্যাপম (মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি)-রাফায়েল যুদ্ধ বিমান কেনা সংক্রান্ত দুর্নীতিতে কলঙ্কিত হওয়া, এরকম একটিও কেলেঙ্কারীর কার্যকরী তদন্ত না করে যারা ‘সুশাসন চালানো’র স্বঘোষিত দাবিদার, যারা আম্বানী-আদানীর মতো স্যাঙাত পুঁজিমালিকদের কাছে দেশবেচার দালাল বলে জনারণ্যে চিহ্নিত হচ্ছে, যতই হাইকোর্টের নির্দেশে হোক, তারা যে নারদ কেলেঙ্কারীর প্রকৃত তদন্ত করবে তা সহজবোধ্য নয়। প্রথম চার্জশীট দিতে ‘আঠারো মাসে বছর’ লাগিয়ে দিল। গোটা নির্বাচনী প্রচার প্রক্রিয়ায় একবারও ‘নারদ’ রগরানির প্রসঙ্গ তোলা হয়নি। তবু এই মামলা ঠিক এখন কেন নামানো হল অপারেশান চালাতে? মুখে কুলুপ এঁটেছেন মোদী-শাহরা! বিজেপির রাজ্য নেতৃত্ব বলছেন সিবিআই হানার সাথে তাদের দলের কোনো সম্পর্ক নেই! ওরা যে প্রতিক্রিয়াই দেখান, এই হানাদারির মধ্যে দিয়ে প্রতিহিংসা, পক্ষপাতদুষ্টতা, নব নির্বাচিত রাজ্য সরকারকে অজ্ঞাত রাখা, রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসনকে আগাম বুঝতে না দেওয়া, বিধানসভার স্পীকারের অনুমোদন নেওয়ার স্বীকৃত প্রথার পরিবর্তে ডিঙিয়ে রাজ্যপালের থেকে অনুমোদন নিয়ে গ্রেপ্তারীর অপারেশান — এভাবে ক্ষমতার দাপাদাপি চালানো হয়েছে। গণতান্ত্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় রীতিনীতিকে যথেচ্ছ লঙ্ঘন করা হয়েছে।

সদ্য নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে ফের নতুন অস্থিরতা তৈরির পিছনে ক্ষমতায় আসতে না পারাটা যেমন বিজেপির গাত্রদাহের একটি কারণ, তেমনি অন্য কারণটি হল কোভিড সংকট থেকে জনতার দৃষ্টিকে অন্যদিকে সরানোর চেষ্টায় কেন্দ্রের ফিকির খোঁজা। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ যত ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, তার মোকাবিলার প্রশ্নে মোদীরাজ তত অমানবিকতা, উদাসীনতা, অপদার্থতা দেখিয়ে চলছে। দেশজুড়ে চিকিৎসার পরিত্রাণ পেতে হাহাকার অবস্থা, থামছে না মৃত্যুমিছিল। ধিক্কার উঠছে মোদীতন্ত্রর বিরুদ্ধে। এই সংকট থেকে দৃষ্টি ঘোরাতে কেন্দ্র এবং বিজেপি সন্ত্রাস ও দুর্নীতির সোরগোল তুলে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে চাইছে। মানুষজন প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করছে বিজেপির এহেন কেন্দ্র-রাজ্যের আচরণকে। ওদের এই উদ্দেশ্য ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া দরকার।

খণ্ড-28
সংখ্যা-18