ক্রমবর্ধমান কৃষি সংকটের পরিস্থিতিতে, বিভাজনের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন ও ঐক্যের বার্তা তুলে ধরে নদীয়া জেলায় লড়ছে সিপিআই(এমএল)
CPI (ML) fights in Nadia district

মোদী সরকার সারের দাম লাগাতার বাড়িয়ে চলেছে। ডিজেলের উপর দফায় দফায় ট্যাক্স চাপিয়ে দিচ্ছে। অথচ চাষিরা ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছে না, বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আগুন। এই বিজেপি সোনার বাংলা গড়বে? আসলে রকমারী স্লোগানের চমক দিয়ে ওরা মানুষকে ধাপ্পা দিচ্ছে। পাশাপাশি অবস্থিত লাগোয়া দুটি ব্লক তথা বিধানসভা ধুবুলিয়া (কৃষ্ণনগর দক্ষিণ) ও নাকাশীপাড়ার গ্রামে গ্রামে চাষিরা প্রবল ক্ষোভের সাথে কৃষি-সংকটের এই বাস্তব চিত্র তুলে ধরছেন। এই দুটি বিধানসভায় সিপিআই(এমএল) নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এখানকার গ্রামাঞ্চলে দেখা গেলো অনেকের ঘরে ধান রয়েছে, কিন্তু হাতে পয়সা নেই, চাষের জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজি নেই। অথচ অসহায় হয়ে ক্ষেতের ফসল অত্যন্ত কম দামে বিক্রি করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। কেন্দ্রের নয়া কৃষি আইনের কথা তারা জানেন। দিল্লীর কৃষক আন্দোলনের খবরও গ্রামীণ মানুষের কাছে রয়েছে। এ রাজ্যে সরকারী সহায়ক মূল্য থেকে কৃষকরা বঞ্চিত, কিন্তু মোদী সরকার যে কৃষকের স্বাধীনতা কেড়ে নিতে চাইছে, কোম্পানির হাতে কৃষি বাজার তুলে দিলে চাষির কোনোরকম লাভই হবে না, এ বিষয়ে চাষিরা প্রবল ভাবেই সোচ্চার। নির্বাচনের মুখে দাঁড়িয়ে মোদী অমিত শাহ বড় গলা করে বলেছিলো যে কেন্দ্রীয় প্রকল্পে কৃষকদের নগদ আর্থিক সহায়তা দেবে। ব্লকে ব্লকে প্রচুর দরখাস্ত জমাও পড়লো। কিন্তু দেখা গেলো সেটা চরম ধাপ্পা। কৃষকের প্রাপ্য অধিকার কেড়ে নিয়ে রুটির টুকরো ছুঁড়ে দেওয়ার সেই প্রতিশ্রুতিও মোদী সরকার পালন করলো না। কৃষক ও কৃষিমজুর পরিবারের যে হাজারে হাজারে যুবকেরা লকডাউনে কাজ হারিয়ে ঘরে ফিরে এসেছে গ্রামে, তারা নিজেদের জীবনের সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরছেন। কেন্দ্রীয় সরকার তাদের পাশে দাঁড়ায়নি। কোন রকম সহায়তা করেনি, বরং বিপুল আর্থিক বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। অনেকেই কাজ হারিয়ে ঘরে ফিরে এসে এখানে খুবই কঠিন সংকটের মধ্যে রয়েছেন, বহু সংখ্যক কাজে ফিরে গেলেও তাঁদের মজুরি কমে গেছে।

বিস্তীর্ণ গ্রাম গঞ্জে কৃষির বাইরে রয়েছে বিশাল পরিমাণ অসংগঠিত শ্রমজীবী মানুষ। নানান মেহনতি পেশায় থাকা এই মানুষেরা চরম দূরবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। স্থায়ী কাজ, ন্যায্য মজুরি বা সামাজিক নিরাপত্তার কোনো সরকারী ব্যাবস্থাই তাদের জন্য নেই। আছে কেবল শুকনো প্রতিশ্রুতি, হেন করেঙ্গা তেন করেঙ্গা সরকারী বোলচাল। কেন্দ্র ১০০ দিনের কাজের বরাদ্দ টাকা কমিয়ে দিয়ে কাজের জায়গাটাকেই বিলোপ করে দিতে চাইছে। অথচ গরিব মানুষের মধ্যে ধর্মের নামে বিভেদ বিভাজন সৃষ্টি করতে বিজেপি জঘন্যতম মিথ্যা প্রচারের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। রাস্তা ঘাটে চা দোকানে অপপ্রচারে ওরা প্রবল সোচ্চার, বাংলা নাকি পাকিস্তান হয়ে যাবে, সংখ্যালঘুদের তোষণ করে তাদের নাকি সমস্ত সুযোগ সুবিধা পাইয়ে দেওয়া হয়েছে, এনআরসি করে এদের তাড়িয়ে দিলেই নাকি উন্নয়ন আর বিকাশ হয়ে যাবে। এ ধরনের মিথ্যা গল্প ছড়িয়ে মানুষের মধ্যে ওরা অন্ধবিশ্বাস সৃষ্টি করতে চাইছে। বিজেপির পেছনে রয়েছে আরএসএস। উপর থেকে চোখে দেখা না গেলেও ওরা গোপন নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে বিজেপি কর্মীদের ভরসা যোগাচ্ছে যে ওরা পেছনে আছে, ভয় নেই, বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়িয়ে যাও, প্রয়োজনে দাঙ্গা করতে হবে, আমরা পেছনে আছি। সদ্য বিজেপিতে যোগ দেওয়া মানুষদের সাথে আলাপচারিতায় এইসব খবর উঠে আসছে। ওপার বাংলা থেকে আগত মানুষের মধ্যে ওরা বিভেদ বিভাজনের বিষাক্ত হাওয়া ছড়িয়ে দিতে চাইছে, কিন্তু এনআরসি তাদের মধ্যে আশঙ্কার এক বাতাবরণ সৃস্টি করেছে। এই দুটি দিকের টানাপোড়েনের মধ্যে বিজেপির আগ্রাসনের মুখে তৃণমূলের সংগঠন রয়েছে খুবই রক্ষণাত্মক অবস্থানে। তারা কেবল সরকারী প্রকল্পের জয়গান গেয়ে কেল্লা ফতে করতে চাইছে। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতায় মানুষ দেখছেন, যতটুকু ছিটে ফোঁটা সরকারী সুযোগ সুবিধা স্বল্প সংখ্যক মানুষেরা পেয়েছে, অপ্রাপ্তি জনিত বঞ্চনার দিকটা তার থেকে অনেকগুন বেশি। উল্টে দুর্নীতি দলবাজি, দাদাগিরি বিজেপিকে সুবিধা করে দিচ্ছে। তাই বিজেপির ফ্যাসিস্ট হামলাকে মোকাবিলা করতে পারবে একমাত্র সংগ্রামী বামপন্থা — এই প্রচারকে জোরের সাথে তুলে ধরে সিপিআই(এমএল), ধুবুলিয়া (কৃষ্ণনগর দক্ষিণ) ও নাকাশীপাড়া কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।

এই এলাকায় বিগত দিনে যে আন্দোলনগুলি সিপিআই(এমএল) করেছে সেগুলিকেই প্রচারে সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। যেমন বিস্তীর্ণ এলাকায় জমির অধিকারের জন্য তথা খাস জমি দখলের আন্দোলন, বাস্তু জমি দখল করে বেশ কিছু সংখ্যক কলোনী স্থাপন, কৃষকদের নানাবিধ দাবিতে আন্দোলন যথা সরকারী দরে ফসল ক্রয় ইস্যুতে ব্লকে ব্লকে বিক্ষোভ, পথ অবরোধ, ১০০ দিনের কাজের দাবিতে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া, আমফান দূর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে বিজেপি ও তৃণমূল নেতাদের অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করা টাকা ফেরত দিতে বাধ্য করা, লকডাউনের সময়কালে রেশনের দাবিতে এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনার দাবিতে আন্দোলন প্রভৃতি। সর্বোপরি এনআরসি-র বিরুদ্ধে সংগঠন বহির্ভূত ব্যাপক মানুষকে সংগঠিত করে প্রতিরোধের বলিষ্ঠ কর্মসূচী, বড় বড় মিছিল, পথ অবরোধ, কুশপুতুল দাহ, “আমরা কাগজ দেখাবো না” এ ধরনের আক্রমণাত্মক প্রচার জনমানসে লড়াকু মেজাজ সৃস্টি করেছিলো। নির্বাচনী প্রচারে সেই দিকটাকেই সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। বিজেপিকে রুখতে নিজ নিজ কাজের অঞ্চলে প্রতিরোধের এলাকা গড়ে তোলা ও সংগ্রামী শক্তির বিকাশ ঘটানো – এই প্রত্যয় জাগিয়ে তুলে চলছে নির্বাচনী প্রচার। দেওয়াল লিখনের কাজ শেষ করে বেশ কিছু এলাকায় প্রার্থী সহ বাড়ি বাড়ি যাওয়া/ পাড়া/ গ্রাম পরিক্রমা শুরু হয়েছে। গত ৩০ মার্চমনোনয়ন পত্র জমা দিয়েছেন কৃষ্ণনগর(দঃ) ও নাকাশীপাড়া কেন্দ্রের প্রার্থী যথাক্রমে সন্তু ভট্টাচার্য ও কৃষ্ণপদ প্রামানিক। ঐ দিন কৃষ্ণনগর সদর মোড় থেকে এক মিছিল জেলা শাসকের দপ্তরে আসে। লাল পতাকায় সুসজ্জিত এই উদ্দীপনাময় মিছিলের সামনে থেকে পথ পরিক্রমা করে প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দেন।

খণ্ড-28
সংখ্যা-12