পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন এগিয়ে আসছে যত, বাঙালী ব্রাহ্মণ্যবাদী মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী কাম শিক্ষাবিদদের মুখোশ ততই খসে পড়ছে। কোনো না কোনো ক্ষমতার বৃত্তে থাকা কারুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে (দুর্জনের কথায় তেল দিয়ে) বিশ্ববিদ্যালয়ের কিউবিকলে মৌরসিপাট্টা গাড়ার পরে এখন বৃহত্তর ক্ষমতা দখলের অপেক্ষায় রয়েছেন অনেকেই। তেমনই একজন মাঝে মাঝে লেখার বরাত পান একটি আনন্দদায়ক বাজারে, লেখার জন্য। খোলাখুলি ভারতীয় জনতা পার্টিকে ভোট দেওয়ার কথা না বলে সোনার বাংলা গড়তে গেলে মানুষেরর মধ্যে উচ্চাকাঙ্খা তৈরি করার দায়িত্ব রাজনীতিকদের উপর অর্পণ করেছেন তিনি। সোনার বাংলা বলতে কী বোঝায় এই প্রশ্নটা মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকলেও পরিমাপের জন্য তিনি যে মাথাপিছু আয় আর ইজ অফ ডুইং বিজনেসেকেই মাথায় ঢুকিয়ে নিয়েছেন তা বুঝতে খুব একটা অসুবিধে হয় না। অর্থাৎ যে সূচকগুলিকে ব্যবহার করে বিজেপি গুজরাট মডেলকে পশ্চিমবঙ্গে গুজে দিতে চাইছে সেই নিরীখেই শিক্ষাবিদ মহাশয় সোনা লোহায় পার্থক্য করতে উন্মুখ। তাছাড়া উনি জানেন যে আর্থিক উদারীকরণ অত্যন্ত সুন্দর প্রকল্প, যার উপর নির্ভর করে দেশের অন্যান্য প্রান্তের মানুষ দ্রুত এগিয়ে গিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গকে পিছিয়ে ফেলে। যে কথাটাকে উনি বলতে চেয়েছেন কিন্তু বলতে পারেননি সেটি হল যে, সোনার বাংলা গড়তে বিজেপিকে ভোট দিন।
এটা অনস্বীকার্য পশ্চিমবঙ্গ অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে। তথাপি বহু বিজেপি শাসিত বা কিয়দ্দিন পূর্বে বিজেপির শাসনাধীন থাকা রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বিচারে বহুলাংশে পিছিয়ে আছে। উক্ত অর্থনীতি শিক্ষক স্বপ্নের চাঁদ আলো ফেলেছেন এরাজ্যের নিম্ন স্তরের মাথাপিছু আয়ের উপরে, যা ২০১৮-১৯ সালে ছিল মাত্র ১,০১,১৩৮ টাকা বার্ষিক, সারা ভারতের গড় ১,২৬,৫২১ টাকার তুলনায় বেশ খানিকটা কম, প্রায় ২০শতাংশ কম। ওই সময়ে বা তার বছর খানেক আগে দীর্ঘকাল ধরে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির দিকে চোখ ফেরালে বোঝা যাবে ওই সমস্ত রাজ্যগুলিকে মোদি-শাহেরা কী রকম স্বর্ণরাজ্যে রূপান্তরিত করেছে। যেমন ধরা যাক বিহার। প্রায় ১৩ বছর বিজেপি-জেডিইউ-র সঙ্গে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। ওই রাজ্যটির ২০১৮-১৯ এর মাথাপিছু আয় ৪০,৯৮২ টাকা, সারা ভারতের গড় আয়ের তুলনায় ৭০ শতাংশ কম। আসাম, ঝাড়খন্ড, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ের ২০১৮-১৯ সালের বার্ষিক মাথাপিছু গড় আয় যথাক্রমে ৭৩১৫৫ টাকা, ৮২৮৩৭ টাকা, ৯০১৬৫ টাকা ও ৯২৪১৩ টাকা। ওই সমস্ত রাজ্যগুলির ভোটারদের জন্য সোনার রাজ্য গড়তে বোধহয় বিজেপির সোনা কম পড়েছিল বা তা সোনার বাংলা গড়ার জন্য সেফ ডিপোজিট ভল্টে রেখে দিয়েছেন মোদি-শাহ-চাড্ডা।
যেহেতু মাথাপিছু আয়কে উল্লেখ করেই মূলত স্বপ্নের চাঁদ সোনার স্বপ্ন বেঁচতে বেরিয়েছেন, তাই ডাবল ইঞ্জিনে টানলেও যে কখনো কখনো গাড়ির দুদিকে দুমুখো ইঞ্জিন লাগানোয় তা ন যযৌ ন তস্থৌ অবস্থায় জড় হয়ে যেতে পারে সেটা মাথাপিছু আয়কে ধরেই দেখানো সম্ভব, তবুও সোনার ভারতের ভবিষ্যৎ বিজেপির হাতে কেমন পিতলে পালিস করে ঝকঝকে হয়েছে তার দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। ২০১৫-১৬ সালের ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেল্থ সার্ভে (এনএফএইচএস ৪), এখন অবধি প্রকাশিত শেষ পূর্ণাঙ্গ জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা অনুসারে এনডিএ শাসিত বিহারে ৫৯ শতাংশ বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌছেছিল (পশ্চিমবঙ্গে ৯৪ শতাংশ, কেরালায় ৯৯ শতাংশ)।
যথাযোগ্য পানীয় জল ছিল এনডিএ শাসিত ঝাড়খন্ডে ৭৮ শতাংশ, মধ্যপ্রদেশে ৮৫ শতাংশ, গুজরাটে ৯১ শতাংশ বাড়িতে (পশ্চিবঙ্গ ৯৫ শতাংশ, কেরালা ৯৯ শতাংশ)।
শৌচালয়ের সুবিধে ছিল এনডিএ শাসিত ছত্তিশগড়ে ৪১ শতাংশ, মধ্যপ্রদেশে ৪৩ শতাংশ, মহারাষ্ট্রে ৭১ শতাংশ, গুজরাটে ৭১ শতাংশ (পশ্চিমবঙ্গ ৭৫ শতাংশ, কেরালা ৯৯ শতাংশ) বাড়িতে।
পাকা বাড়িতে বাস ছিল বিহারে ২৬ শতাংশ, ছত্তিশগড়ে ৩৬ শতাংশ, মধ্যপ্রদেশে ৩৬ শতাংশ, মহারাষ্ট্রে ৭৩ শতাংশ ও গুজরাটে ৭৭ শতাংশ (পশ্চিমবঙ্গে ৪৭ শতাংশ ও কেরালায় ৮৯ শতাংশ) নাগরিকের।
কোনোদিন বিদ্যালয়ে যায়নি (৬ বছরের অধিক বয়স্ক) এমন ব্যক্তিদের অনুপাত এনডিএ শাসিত বিহারে ৪৩ শতাংশ, ঝাড়খন্ডে ৩৯ শতাংশ, মধ্যপ্রদেশে ৩৬ শতাংশ, ছত্তিশগড়ে ৩২ শতাংশ, হরিযানায় ৩০ শতাংশ, গুজরাটে ২৮ শতাংশ (পশ্চিমবঙ্গ ২৬ শতাংশ, কেরালা ৪ শতাংশ)।
শিশু পরিচর্যার ক্ষেত্রেও এনডিএ শাসিত রাজ্যগুলির পরিস্থিতি তথৈবচ। ৫ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর হার (প্রতি হাজারে) মধ্যপ্রদেশে ৬৫, ছত্তিশগড়ে ৬৪, বিহারে ৫৮, ঝাড়খন্ডে ৫৪, রাজস্তানে ৫১, গুজরাটে ৪৪ (পশ্চিমবঙ্গ ৩২, কেরালা ৭)।
প্রতিষেধক প্রদানের ক্ষেত্রেও এনডিএ শাসিত রাজ্যগুলির অনেকগুলিই পিছিয়ে আছে; গুজরাটে ৫০ শতাংশ, মধ্যপ্রদেশে ৫৪ শতাংশ, রাজস্থানে ৫৫ শতাংশ, বিহারে ৬২ শতাংশ ঝাড়খন্ডে ৬২ শতাংশ, হরিযানায় ৬২ শতাংশ (পশ্চিমবঙ্গ ৮৪ শতাংশ, কেরালা ৮২ শতাংশ) শিশুকে প্রতিষেধক দেওয়া হযেছে। শিশুদের বামনাকৃতি বা খর্বাকৃতি হওয়ার ক্ষেত্রেও তেমনটাই দেখা যায়; বিহার, ঝাড়খন্ড, গুজরাট, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় পিছিয়ে আছে, এবং কেরালা এক্ষেত্রেও অনেক এগিয়ে।
নীতি আয়োগ কর্তৃক প্রকাশিত সাসটেইনেবেল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) বা টেঁকসই উন্নয়ন লক্ষ্য সংক্রান্ত সূচকের (২০১৯-২০) নিরিখে এনডিএ শাসিত বহু রাজ্যের অবস্থান নীচের দিকে। অর্থনৈতিক বৈষম্যের নিরিখে গোয়া ২৮তম, ত্রিপুরা ২৬তম, উত্তর প্রদেশ ২৫তম, হরিয়ানা ২৩তম, গুজরাট ২১তম।
উন্নয়নের লক্ষ্য পূরণের সূচকের নিরিখে বিহার ২৮তম, ঝাড়খন্ড ২৫তম, উত্তর প্রদেশ ২৩তম, হরিয়ানা ১৮তম, ত্রিপুরা ১৫তম, মধ্যপ্রদেশ ১৫তম, গুজরাট ৯ম (পশ্চিমবঙ্গ ১৩তম, কেরালা ১ম)।
দারিদ্র নিরসনের নিরিখে ঝাড়খন্ড ২৮তম, বিহার ২৭তম, উত্তর প্রদেশ ২৪ তম, মধ্যপ্রদেশ ২৪তম, হরিয়ানা ১৯তম, গুজরাট ১৯তম, আসাম ১৭ তম, ত্রিপুরা ২য় (পশ্চিমবঙ্গ ১৪তম, কেরালা ৭ম, তামিলনাড়ু ১ম)।
সুস্বাস্থ্য সুস্থ জীবনযাপনের নিরিখে উত্তর প্রদেশ ২৭তম, বিহার ২৫তম, মধ্যপ্রদেশ ২৩তম, ঝাড়খন্ড ১৯তম, হরিয়ানা ১১তম, গুজরাট ৮ম, (পশ্চিমবঙ্গ ৭ম, কেরালা ১ম)।
উচ্চমানের শিক্ষাপ্রদানে অগ্রগতির ভিত্তিতে বিহার ২৮তম, ঝাড়খন্ড ২৬তম, আসাম ২৫তম, গুজরাট ২৩তম, উত্তরপ্রদেশ ২২তম, মধ্যপ্রদেশ ১৭তম (পশ্চিমবঙ্গ ২১তম, কেরালা ১ম)।
লিঙ্গসাম্যের অগ্রগতির সূচকের ভিত্তিতে আসাম ২৫তম, ঝাড়খন্ড ২২তম, গুরাট ১৯তম, বিহার ১২তম, উত্তরপ্রদেশ ১০ম, মধ্যপ্রদেশ ৮ম (পশ্চিমবঙ্গ ১৫তম, কেরালা ২য়)।
তাহলে কী দাঁড়াল? এনডিএ অর্থাৎ ভারতীয় জনতা পার্টি বিভিন্ন রাজ্যে মানুষের মধ্যে বিপুল উচ্চাকাঙ্খা তৈরি করে হীরের গুজরাট, প্লাটিনামের হরিয়ানা, মণিমুক্তার মধ্যপ্রদেশ, জহরতের উত্তর প্রদেশ, বিহার, ছত্তিশগড়, ঝাড়খন্ড প্রভৃতি তৈরি করার পরে সোনার বাংলা গড়তে পচনশীল তৃণমূলের উচ্চাকাঙ্খী তোলাবাজদের বেছে নিয়েছে। আর স্বপ্নের চাঁদবাবু সেই সোনার বাংলার স্বপ্ন ফেরি করার দয়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন! অসত্য ভাষণ ভারতীয় জনতা পার্টি বা তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বের, এমনকি উচ্চতম নেতৃত্বের অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। তাদের নেকনজরে থাকতে তাঁবেদার বুদ্ধিজীবী কাম শিক্ষাবিদরা অর্ধসত্য বলতে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। এমনটা নয় যে, এনডিএ বা বিজেপি শাসিত সমস্ত রাজ্যগুলিই উন্নতির সমস্ত সূচকের নিরিখে পিছিয়ে আছে, এমনটাও নয় যে সমস্ত নিদর্শনের ভিত্তিতে সেগুলি অনন্য হয়ে উঠেছে। বরং সমস্ত সামাজিক উন্নয়নের সূচকের নিরিখেই কেরালা সামনের সারিতে আছে, সেদিক দিয়ে কেরালা অনন্য, তাই উদাহরণ দিতে হলে সেই রাজ্যকেই সামনে আনা প্রয়োজন, যেখানে না ডাবল ইঞ্জিনের সরকার আছে না বিজেপি কোনদিন শাসন করেছে।
তাই বিজেপির নেতারা যখন সোনার বাংলা (‘সুনার বাঙ্গালা’!) তৈরি করতে হুঙ্কার ছাড়েন তখন যেকোনো প্রকৃত অর্থনীতির শিক্ষকের দায়িত্ব সেই ফাঁকা আওযাজকে বাস্তবের জমিতে এনে দাঁড় করানো, চাটুকারিতা করা নয়। তা না হলে বুদ্ধিজীবী-শিক্ষক-বিদ্যাজীবীর এহেন আচরণ বিজেপির দাঙ্গাবাজদের সাহস যোগাবে পশ্চিমবঙ্গকে ‘মিডাস টাচ’এর রাজ্যে রূপান্তরিত করতে, যেখানে হাত দিলেই সোনা হয়ে যাওয়ায় বহু দরিদ্রের ভাত জুটবে না কারণ সোনার লোভের হাতছানিতে ভাতও সোনা হয়ে যাবে। মনে রাখা দরকার নিতি আয়োগের এসডিজি (২০১৯-২০)-র সূচকের নিরীখে ক্ষুধা নিরসনের ভিত্তিতে ঝাড়খন্ড ২৮তম, মধ্যপ্রদেশ ২৭তম বিহার ২৬তম, উত্তর প্রদেশ ২৪তম, কর্নাটক ১৭তম, গুজরাট ১৫তম, আসাম ১৫তম (পশ্চিমবঙ্গ ১৪তম, কেরালা ২য়)।
- অমিত দাশগুপ্ত