ফ্যাসিবাদী মানসিকতার পরিচয় বোধকরি এই যে, জনগণের মধ্যে অনাচার চাপিয়ে দেওয়ার মধ্যেই তা প্রশাসনিক উৎকর্ষ খুঁজে পায়। আর আত্মানুসন্ধানের পথে না যাওয়াটাও তার এক মার্কামারা বৈশিষ্ট্য। পশ্চিম বাংলায় নির্বাচনী প্রচারে এসে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ যখন বলেন যে, তাঁরা এই রাজ্যে ক্ষমতায় এলে ‘নারীর সুরক্ষায়’ অ্যান্টি-রোমিও স্কোয়াড বানাবেন, তখন এই কথাগুলোই মনে আসে। ‘নারী সুরক্ষাকে’ অছিলা করে যে বাহিনী আদিত্যনাথ উত্তরপ্রদেশে বানিয়েছিলেন তা যে তরুণ-তরুণীদের কাছে, সাধারণ জনগণের কাছে উৎপীড়নের এক যন্ত্র হয়ে উঠেছিল তা আজ এক প্রতিষ্ঠিত সত্য এবং সেই কারণেই গঠনের এক বছেরেরও কম সময় পর বাহিনীকে যে নিষ্ক্রিয় করে দিতে হল তাও কোনো গোপন ব্যাপার নয়। এছাড়া, নারী নিগ্ৰহ, নারীর অসম্মান-অমর্যাদার বিচারে উত্তরপ্রদেশ আজ দেশের শীর্ষে। নিজের রাজ্যেই যিনি নারীদের নিরাপত্তা দিতে পারছেন না, নারী নির্যাতন যেখানে প্রতিদিনই খবর হচ্ছে, সেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে অন্য রাজ্যের নারীদের নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে মন্তব্য করতে গেলে কতটা দু’কান কাটা হতে হয় তা যে কেউই অনুমান করতে পারবেন।
উত্তরপ্রদেশের যে মডেলকে আদিত্যনাথরা বাংলায় প্রয়োগ করার কথা বলছেন তা সেই রাজ্যে কোন পরিণতি ডেকে এনেছিল তার দিকে তাকানো যাক। এক-একটা অ্যান্টি-রোমিও স্কোয়াডে সাধারণত থাকত চারজন কনস্টেবল — দুজন পুরুষ ও দুজন মহিলা। তারা যেমন উর্দি পরত, আবার সাদা পোশাকেও থাকত। তাদের দেওয়া হয়েছিল অবাধ ক্ষমতা। শুধু স্কুল-কলেজ ও কোচিং সেন্টারই নয়, পার্ক, সিনেমা হল, মল-এর মতো যে কোনো প্রকাশ্য স্থানে — লোক জড়ো হওয়ার সম্ভাবনাময় জায়গায় — তারা ঘুরে বেড়াত। নারী-পুরুষকে একসাথে বসে থাকতে বা যেতে দেখলেই তাদের ডেকে জেরা করত, তাদের সম্পর্ক বৈধ না অবৈধ তা নিজেরা বিচার করত এবং নিজেদের সিদ্ধান্ত অনুসারে তাদের শাস্তিও দিত। প্রেমিক যুগলের একসাথে ঘুরে বেড়ানোটা স্কোয়াডের কাছে অপরাধ বলেই বিবেচিত হত। লক্ষ্ণৌর এক মলে অ্যান্টি-রোমিও স্কোয়াডের হাতে বাবা ও মেয়ের হেনস্থা হওয়ার ঘটনাও ঘটে। পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, এই বাহিনী গঠন হওয়ার এক বছরের মধ্যে রাজ্যে ৩৪,৪৯,৬৪৬ জনকে সন্দেহজনক ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, ২,৪৮১টি এফআইআর করা হয়, ৪,৩৯২ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় এবং ১৫,৬৯,১৪৫ জনকে সতর্ক করা হয়। এই বিপুল পরিমাণ হস্তক্ষেপের মধ্যে দিয়ে সাধারণ জনগণকে কি অপার হেনস্থা ভোগ করতে হয়েছিল তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার নয়। যে সমস্ত শাস্তি দেওয়া হয় তারমধ্যে ছিল কান ধরে উঠবোস করানো, মাথা কামিয়ে দেওয়া, মুখে কালি মাখানো, থানায় নিয়ে যাওয়া, ইত্যাদি। এছাড়া, মেয়েদের শ্লীলতাহানি করা এবং তোলাবাজিও ঐ বাহিনীর কীর্তিকলাপের অন্যতম অঙ্গ ছিল। স্কোয়াড ধরলে টাকার বিনিময়ে রোমিও হিসাবে চিহ্নিত হওয়াকে এড়ানোর রাস্তাই অনেকের কাছে ঈপ্সিত হত। একটি ঘটনায় স্কোয়াডের সদস্যদের হাতে এক ব্যক্তির খুন হওয়ার কথাও জানা যায় — “২০১৮-র অক্টোবরে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়া স্কোয়াডের দুই সদস্য প্রশান্ত চৌধুরী ও সন্দীপ কুমার রাণা রাত দুটোর সময় অ্যাপল কোম্পানির পদস্থ কর্মচারি বিবেক তিওয়ারিকে গুলি করে মেরে ফেলার জন্য গ্ৰেপ্তার হয়। একটা নতুন মোবাইল ফোন বাজারে চালু করার দিন পার্টি দেওয়া হয়েছিল, সেই পার্টি থেকে ফেরার সময় তিওয়ারি এক মহিলা সহকর্মীকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্যে নিজের গড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁকে গুলি করা হয়”। (দ্য টেলিগ্ৰাফ, ৯ এপ্রিল ২০২১) স্কোয়াডের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় জমা হতে থাকায় ঐ বাহিনী আর সক্রিয় থাকে না। অ্যান্টি-রোমিও স্কোয়াড গড়ার ঘোষিত উদ্দেশ্য ‘নারীর সুরক্ষা’ হলেও তা আসলে চালিত হয়েছিল গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে, পারস্পরিক মেলামেশা করার সাংবিধানিক অধিকারকে খর্ব করার উদ্দেশ্যে, নারী স্বাধীনতায় লাগাম পরানোর লক্ষ্যে, নিজের জীবনসঙ্গীকে বেছে নেওয়ার নারীর অধিকারকে শৃঙ্খলিত করতে।
আরএসএস ও বিজেপি নারীর স্বাধীনতাকে কি চোখে দেখে, এই প্রশ্নটাও আলোচ্য প্রসঙ্গের সঙ্গে একসূত্রে বাঁধা। সংঘীয় মতাদর্শে নারী কখনই পুরুষের সম-অধিকারী নয়। আদিত্যনাথ নিজে এক বড় হিন্দুত্ববাদী নেতা এবং তিনি তাঁর ওয়েবসাইটে লেখা এক রচনায় বলেছেন, “নারীদের গুরুত্ব ও সম্মানের কথা বিবেচনা করে… আমাদের শাস্ত্র সর্বদাই নারীকে সুরক্ষা জোগানোর কথা বলেছে। … কর্মশক্তিকে অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত করে রাখলে তার যেমন অপচয় হতে পারে ও তা ক্ষতি করতে পারে, সেরকমভাবে নারীর ক্ষমতার স্বাধীনতার চেয়ে সুরক্ষারই প্রয়োজন। …” স্বাধীনতা বর্জিত নারীকে সুরক্ষা জোগাতে হবে — নারী সম্পর্কে এই দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা চালিত হয়ে নারীকে শুধু পুরুষের অধীনস্থ রূপে দেখা হয়না, তাকে নিয়ন্ত্রিত করতে না পারলে সে পরিবারের কাছে সমস্যা হয়ে দেখা দেবে বলেও মনে করা হয়। রান্নাবান্না করা, ঘরবাড়ি পরিচ্ছন্ন রাখা, শিশু লালনপালন সহ গৃহস্থালির অন্যান্য কাজে লেগে থাকা — এইভাবে নারীকে নিয়ন্ত্রণ করাটাকে তার বিপথগামিতা রোধের পথ বলে বিবেচিত হয় পিতৃতন্ত্রের কাছে। অ্যান্টি-রোমিও বাহিনী গঠনের পিছনে এই লক্ষ্যই কাজ করেছে। পছন্দের সাথীকে বেছে নেওয়ার ও তার সঙ্গে ঘোরাফেরার স্বাধীনতা নারী যেন ভোগ করতে না পারে, অবাঞ্ছিত হাতের স্পর্শে নারী যেন অপবিত্র হয়ে না যায়। এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিবাদ করে নারীবাদীরা বলে থাকেন, নারীরা পুরুষের মালিকানাধীন কোনো ‘মাল’ নয় যাকে চুরি হয়ে যাওয়া বা যার ক্ষতি হওয়া থেকে তাকে ‘স’রক্ষিত করতে হবে’। নারীর সমানাধিকারের, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় সম-অংশিদারীর দাবিকে দাবিয়ে রাখতে না পেরে ‘সুরক্ষার’ নামে নারীকে শৃঙ্খলিত করতে উদ্যোগী হচ্ছে সংঘ পরিবারের শক্তিগুলো। অ্যান্টি-রোমিও স্কোয়াড যে উত্তরপ্রদেশের নারীদের কাছে হয়রানির এক বাহিনী হয়ে উঠেছিল তা তাঁরা হাড়ে-হাড়ে বুঝেছেন। উত্তরপ্রদেশের সমাজ আন্দোলনের নারী কর্মীরা ২০১৭-র এপ্রিলে এক যৌথ বিবৃতিতে জানান, “অনেক ক্ষেত্রেই অ্যান্টি-রোমিও স্কোয়াডগুলো নারী ও পুরুষের কাছে হেনস্থার বৃহত্তর কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে, উত্তরপ্রদেশ পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেলও যেটা স্বীকার করেছেন। …” কিছুদিন আগে মধ্যপ্রদেশের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান নির্দেশিকা জারি করে বলেছেন, মেয়েরা বাইরে বেরোলে স্থানীয় থানায় জানাতে হবে যাতে পুলিশ তার ‘নিরাপত্তার’ জন্য তার গতিবিধির ওপর নজর রাখতে পারে! এমনকি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিও প্রশ্ন তুলেছেন, মহিলা কৃষকরা কেন কৃষি আইন বাতিলের প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন! দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতির কণ্ঠেও সংবিধান প্রদত্ত নারীর সমানাধিকার নিয়ে প্রশ্ন! কাজেই, সংখ্যাগুরুবাদী নৈতিকতা, পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ দিয়ে সমাজকে পরিচালনার যে আয়োজন চলছে, তাকে প্রত্যাখ্যান করেই নারীদের এবং জনসমাজকে এগিয়ে যেতে হবে। সংবিধানের দেওয়া অধিকারকে কিছুতেই ছিনিয়ে নিতে দেওয়া যাবে না। ভারতের ক্রমেই এক পুলিশ রাজের অভিমুখে যাত্রার সঙ্গে এই বাহিনীর ধারণার সংযোগ থাকতে পারে, সেই অভিমতও উড়িয়ে দেওয়ার নয়। বিজেপি পশ্চিম বাংলার ক্ষমতায় আসুক আর না আসুক, এই রাজ্যের উদারবাদী জীবনধারাকে অব্যাহত রাখতে অ্যান্টি-রোমিও স্কোয়াডের মতো নারী-বিদ্বেষী, সাধারণ জনগণের নিপীড়ক বাহিনীকে কখনই দিনের আলো দেখতে দেওয়া যাবে না। রোমিও আমাদের কাছে শেকসপীয়রের কালজয়ী নাটকের নায়ক, পবিত্র প্রেমের প্রতিমূর্তি, এক নির্মল হৃদয়ানুভূতি। লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে আসা, সংঘ পরিবারের চিন্তাধারার অনুগামী হয়ে নীতি পুলিশের কাজ করা নিপীড়ক কোনো বাহিনীর সঙ্গে জুড়ে এই নামকে কখনই কলুষিত হতে দেওয়া যাবে না।