অতিমারিতে প্রসূতি ও শিশুমৃত্যুতে ভারত কেন শীর্ষে?
India at the top in maternal and child mortality

যোগীরাজ্যে আবার কিশোরী হত্যা। পিলভিটে ইট-ভাটা শ্রমিকের দুই কন্যা সন্ধ্যায় গিয়েছিল কাছের একটি মাঠে। আর বাড়ি ফেরা হয়নি তাদের। ফিরেছে তাদের মৃতদেহ। দু’জনেরই গলায় রয়েছে ক্ষতচিহ্ন। পুলিশ যথারীতি জানিয়েছে, ধর্ষণ কিনা এখনই বলা যাচ্ছে না। যতটা বিলম্ব করে ধর্ষকদের বাঁচিয়ে দেওয়া যায়!

যিনি নিজের রাজ্যকে ধর্ষকদের স্বর্গরাজ্য বানিয়ে ফেলেছেন যেখানে প্রতিদিন নারীমেধ যজ্ঞে তার প্রশাসন আহুতি দিয়ে চলেছে, সেই তিনি যখন বাংলায় এসে নারীসুরক্ষা নিয়ে কথা বলেন তখন তার চেয়ে বড় প্রহসন আর কী হতে পারে!

উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রীর, দায়িত্বভার নেওয়ার পরই নজর গেল মেয়েদের ফাটা জিনস-এর দিকে! তার প্রশ্নের যাথার্থ্য থাকতেই পারে না, যতক্ষণ নাগপুরের খাকীওলাদের উরু ও হাঁটু প্রদর্শন অব্যাহত থাকছে। কই, তারা তো ভুলেও প্রশ্ন করেন না, হতদরিদ্র নারীকে কেন শতচ্ছিন্ন বস্ত্রে আব্রু রক্ষা করতে হবে আজও, স্বাধীনতার তিয়াত্তর বছর পরেও? কেন তাকে প্রাকৃতিক কাজ সারতে মাঠ-ঘাট-বন-জঙ্গলে যেতে হবে? যেখানে নরপিশাচরা তার দেহটা ছিঁড়ে খাওয়ার জন্যে ওঁত পেতে থাকে? কেন সে জলের বন্দোবস্ত সহ পাকা শৌচাগার পাবে না? কেন তার বাছা অপুষ্টি অনাহারে পাঁচটা বছরও পৃথিবীর আলো দেখতে পাবে না? কেন অপুষ্টির শিকার প্রসূতি মাকে গর্ভস্থ সন্তানের মুখ না দেখেই মরতে হবে? কেন  নাবালিকা মেয়েটিকে পুতুলখেলার বয়েসে বিয়ে দিতে বাধ্য হবে তার গরিব মা-বাপ? কেন স্কুল-ছুট নাবালক তার অপটু কচি শরীরটা নিয়ে কাজ খুঁজে ফিরবে এখানে ওখানে?

এই সব প্রশ্ন আপনাদের মনে কখনও জাগবে না! এগুলো আপনারা শুনতেও নারাজ। কিন্তু কোভিড-উত্তর পৃথিবী আজ বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের এই বেহাল দশা দেখে হতবাক। ২০২০তে কোভিড কালে দক্ষিণ এশিয়ায় ৫ বছরের নীচে শিশুমৃত্যু বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি ভারতে, মাতৃত্বকালীন মৃত্যুসংখ্যাও সবচেয়ে বেশি এ দেশে। যেহেতু কোভিড পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য পরিষেবা চূড়ান্ত ব্যাহত হয়েছে। রাষ্ট্র সঙ্ঘের রিপোর্ট বলছে।

‘দক্ষিণ এশিয়ায় কোভিড-১৯ অতিমারি পরিস্থিতির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া’ শীর্ষক রিপোর্ট তৈরি করেছে ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনাইটেড নেশনস পপুলেশন ফান্ড। সেখানে বলা হয়েছে, ফেব্রুয়ারি, ২০২১ পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ায় কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা ১২০ লক্ষেরও বেশি যার মধ্যে ভারতেই সর্বাধিক, ১০৯ লক্ষ ছাড়িয়েছে। রিপোর্টে ৬টি জনবহুল দেশ ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল আফগানিস্তান এবং শ্রীলঙ্কার শিশু ও প্রসূতি-স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, চাকরি ও শিক্ষার ক্ষেত্রে অতিমারির ভয়াবহ প্রভাব তুলে ধরা হয়েছে।

এ পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ায় কোভিড-১৯ -এর পরীক্ষা ও কোভিড-মৃতদের অন্তিম সৎকার ইত্যাদি বাবদ ২.৪ বিলিয়ন ইউএসডি-র বেশি খরচ হয়েছে যার সিংহভাগই ভারতের। আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, কোভিড পরীক্ষা, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের চালু ব্যবস্থা সত্ত্বেও অক্টোবর, ২০২০ থেকে সেপ্টেম্বর, ২০২১’র মধ্যে কোভিড-আক্রান্ত হয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় আরও পাঁচ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হতে পারে যার বেশির ভাগটাই ঘটতে পারে ভারতে (অনুমিত সংখ্যা, ৪৯১,১১৭)। সংক্রমণ প্রশমণের সমস্ত ব্যবস্থা, যেমন সময়োপযোগী সঠিক মাত্রার লকডাউন, হাতের পরিচ্ছন্নতা, মাস্ক ব্যবহার - কঠোরভাবে কার্যকর থাকলে ভারতে কোভিড-মৃত্যুর এই সংখ্যা ৮৩% কমানো যেত এবং তখন সংখ্যাটা নেমে আসতো ৮৫,৮২১-এ।

রিপোর্টে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ এর জন্য যৌন, প্রজননগত, মাতৃত্ব ও নবজাতকের পরিচর্যা ভীষণভাবে ব্যাহত হওয়ায় প্রসূতি ও শিশুমৃত্যুর উপর তা বিশেষ প্রভাব ফেলেছে। ২০২০-তে দক্ষিণ এশিয়ায় ৫ বছর ও তার কম বয়সী শিশুমৃত্যু আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে মোট ২২৮,৬৪১টি; ভারতে সর্বোচ্চ-১৫৪,০২০ (১৫%); পাকিস্তান-৫৯,২৫১ (১৪%)। দক্ষিণ এশিয়ায় মৃত শিশু প্রসবের ঘটনাও বাড়বে বলেই আশঙ্কা, মোট অনুমিত বৃদ্ধি-৮৯,৪৩৪; এর মধ্যে ভারতে অনুমিত বৃদ্ধি-৬০,১৭৯ (১০%)-সর্বোচ্চ; পাকিস্তান-১১%; বাংলাদেশ-৩%; অতিমারির ২০২০তে ভারতে প্রসূতি মৃত্যুর অনুমিত বৃদ্ধিও সর্বোচ্চ-৭,৭৫০ (১৮%); পাকিস্তান-২০৬৯ (২১%); অতিমারি পর্যায়ে আধুনিক গর্ভনিরোধক ব্যবস্থার সুযোগ নেওয়া সম্ভব ছিল না। ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় অতিরিক্ত ৩৫ লক্ষ অনিচ্ছুক গর্ভধারণের ঘটনা ঘটেছে যার মধ্যে ভারতেই অনুমিত বৃদ্ধির সংখ্যা প্রায় ৩০লক্ষ (সর্বোচ্চ); ২০২০তে দক্ষিণ এশিয়ায় ১৫-১৯ বছর বয়সী প্রসূতিমৃত্যুর অনুমিত বৃদ্ধি সংখ্যা-১১৯১; ভারতে-৬৪৩ (সর্বোচ্চ); অতিমারিতে ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, এইচআইভি/এইডস-এর মতো সংক্রামক রোগগুলির চিকিৎসা পরিষেবা অপ্রতুল থাকায়, এসব অসুখে বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়েদের মৃত্যুও বেড়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় বৃদ্ধি-৫৯৪৩ (অনুমিত); ভারতে-৩৪১২; অতিমারিতে পথ-দুর্ঘটনায় বয়ঃসন্ধিকালীন মৃত্যুর সংখ্যা অবশ্য আগের বছরের তুলনায় কমেছে। ভারতে হ্রাসের সংখ্যা সর্বোচ্চ-৪১৪৫; অতিমারি পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায়, দক্ষিণ এশিয়ায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের প্রায় ৯০ লক্ষ ছেলে মেয়ে স্থায়ীভাব স্কুল-ছুট হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা; ভারতে সংখ্যাটা প্রায় ৭০ লক্ষ।

রিপোর্ট বলছে এই ব্যাপক সংখ্যক ছেলেমেয়ে পড়াশোনা থেকে চির-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতেও। এইসব ছেলে মেয়েদের নিম্ন মানের শিক্ষার জন্য তাদের ভবিষ্যৎ জীবিকায় আয় কমবে ১৫-২৩%; দক্ষিণ এশিয়ায় আগামী ৪৫ বছরে যে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৬৩.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; ভারতে সেই ক্ষতির পরিমাণ হবে সর্বোচ্চ- ৫২.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; বাংলাদেশ-৭.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; শ্রীলঙ্কা-১.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু’র দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক অধিকর্তা পুনম ক্ষেত্রেপাল সিং বলেছেন, হু-র কোভিড মোকাবিলা প্রচেষ্টার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হল-অত্যাবশ্যক স্বাস্থ্য পরিষেবাকে অব্যাহত অক্ষুণ্ণ রাখা। যেসব জাতীয় স্তরের নেতারা, কোভিড-এর আসন্ন দ্বিতীয় ঢেউয়ের মুখে দাঁড়িয়ে জনসাধারণকে স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে সচেতন করার পরিবর্তে নির্বাচনী সভায় কুৎসিততম ভাষায় পরস্পরকে কাদা ছুঁড়তে ব্যস্ত তারা কি চূড়ান্ত অবহেলিত ক্ষতিগ্রস্ত এই শৈশব কৈশোরে কথা একটু ভাববেন!

না, সে সময় তাদের নেই! তাহলে কি আর প্রত্যেক দিন বোমা গুলি ছুরিতে ‘খেলা’র বলি হতে হয় শিশু-কিশোর-যুবকদের!

(সূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ১৮ মার্চ, ২০২১ )

খণ্ড-28
সংখ্যা-11