উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ মালদহে বিজেপির নির্বাচনী প্রচারে এসে বলে গিয়েছিলেন যে — যে সরকার নারীদের নিরাপত্তা দিতে পারে না, একদিনও ক্ষমতায় থাকার অধিকার তার নেই। কিন্তু তাঁর রাজ্যে নারীরা কেমন আছেন? যোগী শাসনে তাঁরা কি নিরাপদ বোধ করেন? পুলিশ কি নারীর বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধে দুষ্কৃতী দমনে তৎপরতা দেখায়? ঐ রাজ্যেরই উন্নাও, বদায়ুন, হাথরসে ঘটে নারী-বিরোধী হিংসার হাড় হিম করা ঘটনা আর সেই সমস্ত ঘটনার অপরাধীদের, পৈশাচিক দুষ্কৃতীদের রক্ষায় পুলিশ ও প্রশাসনের মদত দান কোনো গোপন ব্যাপার নয়। দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকার ১৫ মার্চ সংস্করণে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে যাতে দেখানো হয়েছে উত্তরপ্রদেশে কি অবাধে নারী-বিরোধী হি্ংসার ঘটনা ঘটে চলে এবং রাজ্যটা নারীদের কাছে কি রকম আতঙ্কের হয়ে উঠেছ। ঐ প্রতিবেদনে শুধু এ বছরেরই ১ থেকে ৮ মার্চ ঘটা নারীর ওপর হামলার একের পর এক ঘটনা বিধৃত হয়েছে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর পরিসংখ্যান উল্লেখ করে তাতে জানানো হয়েছে যে, শুধু ২০১৯ সালেই নারীর বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের সংখ্যা ছিল ৫৯৮৫৩, যা সারা দেশে ঘটা নারী-বিরোধী অপরাধের ১৪ শতাংশ। মুখে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বললেও বিজেপি শাসন যে নারীর কাছে ভীতিজনক এবং তার আত্মপ্রতিষ্ঠার পথে প্রতিবন্ধক তাকে তুলে ধরতে ঐ প্রতিবেদনে বিবৃত ঘটনাগুলো এখানে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হচ্ছে।
তারিখ ১ মার্চ : এক পেশাদার নর্তকীকে অপহরণ করে গোরখপুর জেলার শাহাপুরের একটা বাড়িতে আটকে রেখে তিন ব্যক্তি তাকে গণধর্ষণ করে। অভিযুক্তরা ধর্ষণ কাণ্ডের একটা ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে তুলে দিয়েছিল বলেও জানা যায়। অভিযোগ নথিবদ্ধ না করায় এক পুলিশ ইন্সপেক্টর ও এক কনস্টেবলকে সাসপেন্ড করা এবং তিন অভিযুক্তকে গ্ৰেপ্তার করা হয়েছে।
তারিখ ৪ মার্চ : বদায়ুনের সিভিল লাইন এলাকায় এক অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে কর্মরত এক মহিলা অভিযোগ করেন, ২ মার্চ সেই কেন্দ্রে চার পুলিশ কর্মী হানা দেয়। তারা মহিলাকে মারধর করে, সেই কেন্দ্রের খরচের হিসেবের খাতা নিয়ে চলে যায় এবং অন্য একদিন তাকে তাদের কাছে যেতে বলে। তাদের কথামতো তিনি তাদের কাছে অন্য একদিন গেলে এক সাব-ইন্সপেক্টর ও দুই কনস্টেবল তাঁকে একটা ঘরে আটকে গণধর্ষণ করে।
অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে হামলা, হিসেবের খাতা চুরি করা বা মহিলার ওপর গণধর্ষণের জন্য কোনো অভিযোগ নথিবদ্ধ করা হয়নি। তাঁর ডাক্তারি পরীক্ষার ব্যবস্থা করা বা বিবৃতি নথিবদ্ধ করতেও পুলিশ কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এসপি জানিয়েছেন, “মহিলার স্বামী শ্লীলতাহানির একটি ঘটনায় অভিযুক্ত। পুলিশ কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ভিত্তিহীন। এ সত্ত্বেও আমরা ঘটনাটার তদন্ত করছি।”
প্রতিবেদনে এই অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে যে, মহিলার স্বামীর শ্লীলতাহানির ঘটনায় অভিযুক্ত হওয়ার সঙ্গে মহিলার ওপর গণধর্ষণ চালানোর কোনো সম্পর্ক কি আদৌ থাকতে পারে।
তারিখ ৭ মার্চ, ঘটনা ১ : ১৯ বছরের এক যুবক আগ্ৰার হাভেলি মহল্লায় ৪৫ বছর বয়স্ক এক মহিলার বাড়িতে জোরজবরদস্তি ঢুকে ঐ মহিলা ও তাঁর ১৫ বছরের মেয়েকে ছুরি মেরে খুন করে। অভিযুক্ত পাড়ারই যুবককে ১০ মার্চ গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ঘটনা ২ : আজমগড় জেলার ফুলপুরে চাষের মাঠে ১১ বছরের এক বালিকাকে ধর্ষণ করা হয়। বালিকার গ্রামেরই একটি ছেলে ধর্ষণ করেছে বলে জানা যায়। পুলিশ জানিয়েছে, অভিযুক্তকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
তারিখ ৮ মার্চ, ঘটনা ১ : কানপুর গ্রামীণ অঞ্চলে ঘটমপুর এলাকায় ১৩ বছরের এক বালিকাকে গণধর্ষণ করা হয়। মূল অভিযুক্ত এক পুলিশ অফিসারের ছেলে, এবং তার সাথে তার বন্ধুও ছিল। পরদিন ধর্ষিতার দাদা যখন অভিযোগ দায়ের করার জন্য সাজেতি থানায় যাচ্ছিল, অভিযুক্তর দাদা তখন ধর্ষিতার দাদাকে মারধর করে এবং হুমকি দেয়—ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করলে তাকে এবং তার বাবাকে মেরে ফেলা হবে। ধর্ষিতার দাদা কোনোরকমে থানায় পৌঁছলেও পুলিশ অভিযোগ নেয় না এবং এই কথাও নাকি বলে যে, মেয়েটার চরিত্র ভালো নয়। পরদিনই, অর্থাৎ ১০ মার্চ পুলিশের সামনেই একটা লরি ধর্ষিতার বাবাকে চাকার তলায় পিষে দিয়ে মেরে ফেলে। ধর্ষিতার দাদার অভিযোগ, এক পুলিশ কর্মী তার বাবাকে লরির নীচে ঠেলে দেয়।
সাংবাদিকরা থানায় যাওয়ার পরই থানায় ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের হয়। পুলিশের এক ইন্সপেক্টর, এক সাব-ইন্সপেক্টর ও এক কনস্টেবলকে কর্তব্যে অবহেলার জন্য সাসপেন্ড করা হয়েছে। মূল অভিযুক্তর বাবা, পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টরের বিরুদ্ধে হত্যার ষড়যন্ত্রের মামলা দায়ের হয়েছে।
ঘটনা ২ : এলাহাবাদের সিভিল লাইন এলাকায় এক পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর সর্বসমক্ষে এক মহিলা ইন্সপেক্টরের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে ও তাকে ধাক্কা দেয়। মহিলা ইন্সপেক্টর ঐ সাব-ইন্সপেক্টরের চেয়ে উঁচু পদে অধিষ্ঠিত হলেও পুরুষ সাব-ইন্সপেক্টর তার হেনস্থায় কোন দ্বিধা দেখায় না। পুরুষ সাব-ইন্সপেক্টর চাইছিলেন – মহিলা ইন্সপেক্টর কোতোয়ালি অঞ্চলে যে বাড়িতে ভাড়া থাকেন, সেটা তিনি ছেড়ে দিন। ঘটনার একটা ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে সচল হয়েছে।
স্থানীয় সার্কেল ইন্সপেক্টর বলেছেন, এরকম কোন ঘটনার কথা তিনি জানেন না। মহিলা ইন্সপেক্টর জানিয়েছেন, তাঁর নিজের থানা তাঁর অভিযোগ নিতে অস্বীকার করেছে।
এলাহাবাদের ডিআইজি জানিয়েছেন, তিনি উভয় পুলিশ কর্মীকেই সতর্ক করে বলেছেন, এই ধরনের ঘটনা আবার ঘটলে উভয় পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধেই তিনি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবেন। মহিলা ইন্সপেক্টর কোনো খারাপ ব্যবহার করেছেন বলে ভিডিওতে দেখা যায়নি।
ঘটনা ৩ : বুলন্দশহরের শিকারপুরের এক রাস্তায় এক যুবক এক মহিলাকে ছুরি মেরে খুন করে। অভিযুক্ত ঐ মহিলার দূর সম্পর্কের আত্মীয়।
অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশের দাবি, যুবকের সঙ্গে মহিলার প্রণয়ের সম্পর্ক ছিল।
উত্তরপ্রদেশ মহিলাদের কাছে যে আতঙ্কের রাজ্য হয়ে উঠেছে তার সঙ্গে কি নারী সম্পর্কে বিজেপির ধারণার কোনো সংযোগ রয়েছে? রাজ্যে নারী-বিরোধী হিংসার বাড়বাড়ন্তের পিছনে নারীদের সম্পর্কে বিজেপি-আরএসএস-এর পোষণ করা ধারণা, রাজ্যে রাজনীতি-দুর্বৃত্ত গাঁটছড়ার অতি শক্তিশালী হয়ে ওঠার ভূমিকাকে অস্বীকার করা যাবে না। বিজেপি মনে করে গৃহকোণই নারীদের জন্য নির্দিষ্ট স্থান, রান্নাবান্না, ছেলে-মেয়েদের লালন-পালন এবং গৃহস্থালির অন্যান্য কাজের জন্যই তারা নিয়তি-নির্দিষ্ট। যোগী আদিত্যনাথের মত হিন্দুত্ববাদী নেতা কখনই চাইবেন না যে, নারীরা পুরুষের সমানাধিকার অর্জন করুক, সমাজ নির্মাণে ভূমিকা রাখুক, আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে নিজেদের আত্মঘোষণায় এগিয়ে যাক। যে রাজ্যে প্রশাসনের শীর্ষে থাকা ব্যক্তিটির মধ্যে নারী-বিদ্বেষী মনোভাব চরম মাত্রায় মূর্ত হয়, সেই রাজ্যে নারী নিগ্ৰহ ও তাদের দমনের এক পরিমণ্ডল যে বিরাজ করবে সেটাই স্বাভাবিক।
(যোগী আদিত্যনাথ নারীদের সম্পর্কে কি মনোভাব পোষণ করেন, আন্তর্জাতিক নারী দিবসে নারীদের সম্পর্কে তাঁর কি বার্তা ছিল, সে সম্পর্কে অবহিত হতে দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় এম-এল আপডেট সম্পাদকীয় দেখুন।)