কেরল, তামিলনাড়ু, আসাম ও পশ্চিম বাংলা — এই চারটি রাজ্য বিধানসভা এবং কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল পুদুচেরির নির্বাচন অনুষ্ঠানের নির্ঘন্ট ভারতের নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করেছে। বিহারের পর এটাই হবে কোভিড-১৯ অতিমারী চলাকালে দ্বিতীয়বারের জন্য বড় আকারের নির্বাচন অনুষ্ঠান। তামিলনাড়ু, কেরল ও পুদুচেরিতে যেখানে একদিনেই নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন হবে, সেখানে আসামে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তিনটি পর্যায়ে আর পশ্চিমবাংলার নির্বাচনের জন্য গোটা এপ্রিল মাস জুড়ে নির্দিষ্ট হয়েছে একেবারে আটটি পর্যায়। কোনো কোনো জেলাকে আবার ভাঙ্গা হয়েছে দুটি বা তিনটি পর্যায়ে। বিহারের মতো বড় রাজ্যে তিনটি পর্যায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা সম্ভব হলেও পশ্চিমবাংলার জন্য অভূতপূর্ব মাত্রায় আটটি পর্যায়ের প্রয়োজন হচ্ছে কেন? নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে এর কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। অধিকাংশ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকই এর থেকে অবধারিত যে সিদ্ধান্তটা টানছেন তা হল, অত্যন্ত বেশি সংখ্যক পর্যায়ে ছড়ানো নির্ঘন্ট থেকে বিজেপি’রই বেশি সুবিধা হওয়ার কথা।
প্রতিটি রাজ্যের নির্বাচনেরই একটা রাজ্য-নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিত থাকলেও দেখা যাচ্ছে – মোদী সরকার ক্রমান্বয়ে সমস্ত ক্ষমতা নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করে ভারতের অর্থনীতিকে নিজেদের কবজায় নিয়ে আসার কর্পোরেটদের এজেণ্ডা এবং ভারতীয় সংবিধানকে বিপর্যস্ত করে তুলে ভারতকে ফ্যাসিস্ত চরিত্রের হিন্দু আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার আরএসএস এজেণ্ডাকে আগ্ৰাসিভাবে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে; আর তাই, প্রতিটি নির্বাচনেই ফ্যাসিবাদী বিজেপিকে পরাস্ত করার আহ্বান সারা ভারতেই গণতন্ত্রপ্রেমী ভোটারদের কাছে সাধারণ লক্ষ্য রূপে আবির্ভূত হয়েছে। মোদী সরকার তার দ্বিতীয় পর্বে যে দ্রুততায় তার এজেণ্ডাকে রূপায়িত করে চলেছে তা এই চ্যালেঞ্জকে আরো জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। পাঁচটা রাজ্যর মধ্যে বিজেপি এখন আসামে ক্ষমতায় রয়েছে। পশ্চিমবাংলায় ২০১৯’র লোকসভা নির্বাচনে তারা জোরদার লড়াই করে দ্বিতীয় স্থান পায়, লাভ করে ১৮টি আসন ও ৪০ শতাংশ ভোট। বিজেপি তামিলনাড়ু, কেরল ও পুদুচেরিতে সুকৌশলী জোট গঠন, কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ এবং আরএসএস-এর ক্রমবর্ধমান সাংগঠনিক জাল বিস্তারের মধ্যে দিয়ে দ্রুতই তার প্রভাব বাড়িয়ে চলেছে।
মোদী সরকার অনুসৃত সর্বনাশা নীতিমালা দেশকে এক বড় ধরনের সংকটে নিমজ্জিত করেছে। এনআরসি-এনপিআর-সিএএ প্যাকেজ লক্ষ-লক্ষ মানুষকে চূড়ান্ত নিরাপত্তাহীন করে তুলেছে, তাদের নাগরিকত্ব এবং তার থেকে উদ্ভূত অধিকারগুলোকে ঢেকে দিয়েছে অনিশ্চয়তার কালো মেঘ। এবারের নির্বাচনে বিজেপি এ বিষয়ে হেঁয়ালি ভরা নীরবতা চালিয়ে গেলেও আসাম এবং পশ্চিম বাংলা উভয় রাজ্যেই বিষয়টা যথেষ্ট উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। অবিবেচনাপ্রসূত লকডাউন লক্ষ-লক্ষ শ্রমজীবী জনগণ, বিশেষভাবে পরিযায়ী শ্রমিকদের অস্তিত্ব এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তার কাছে এক নির্মম আঘাত হয়ে দেখা দিয়েছে। অর্থনৈতিক বৃদ্ধি শূন্যের নীচে নেমে গেলেও সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের সম্পদের বিক্রি নিয়ে মেতে উঠেছে, আর তার পরিণতিতে সৃষ্টি করছে অভূতপূর্ব মাত্রার বেকারি ও পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। সরকার এখন আবার কৃষির নিয়ন্ত্রণকে কর্পোরেটদের কব্জায় তুলে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে, যে কৃষি হল একমাত্র ক্ষেত্র যা লকডাউন ও অতিমারির মধ্যে প্রকৃত বৃদ্ধির সাক্ষর রেখেছে।
যে বিষয়গুলো সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে বিজেপিকে অভাবনীয় সাফল্য এনে দিয়েছে তার একটা হল বিভিন্ন পরিচিতির ভিত্তিতে জনগণের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে জাতি রূপে ভারতের এক ধারণা অথবা ঘেরাওয়ের পরিস্থিতির মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের থাকার ধারণা গড়ে তুলে এক ঐক্যবদ্ধ নির্বাচনী জোট গড়ে তোলার তার সামর্থ্য। আরো যে ব্যাপারটা তাদের সাফল্যে অবদান যোগায় তা হল তুলে ধরা এই ধরনের সংকটময় পরিস্থিতিতে মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপিকে সবচেয়ে শক্তিশালী বিকল্প রূপে তুলে ধরা। তবে বিহার নির্বাচন আমাদের দেখিয়েছে বর্তমানের জ্বলন্ত ইস্যুগুলোকে ধরে জনগণের শক্তিশালী ঐক্য ও আত্মঘোষণার মধ্যে দিয়ে কিভাবে ঐ কৌশলের মোকাবিলা করা যায়। কাজের ইস্যুকে সামনে রেখে বিহারের যুবক-যুবতীরা ব্যাপক সংখ্যায় বিজেপি-জেডিইউ জোটের বিরুদ্ধে ভোট দেয়, সিপিআই(এমএল)-কে এনে দেয় ১২টা আসন যা এতদিনের মধ্যে তাদের সর্বোচ্চ আসন সংখ্যা এবং আরজেডি-বাম-কংগ্ৰেস মহাজোটকে নিয়ে আসে সংখ্যাগরিষ্ঠতার কাছাকাছি। আসন্ন নির্বাচনগুলোতে এই নজিরের ওপর ভিত্তি করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
জাতপাত-সম্প্রদায় বিভাজন নির্বিশেষে কৃষির সঙ্গে যুক্ত জনগণের শক্তিশালী ঐক্যের ভিত্তিতে চলমান কৃষক আন্দোলনও একই ধরনের প্রভাব সৃষ্টি করছে। কৃষক আন্দোলন মোদীর সর্বনাশা কৃষি আইনগুলোর বিরুদ্ধে এক নতুন ঐক্য গড়ে তোলায় পাঞ্জাব ও হরিয়ানার মধ্যে চলে আসা দীর্ঘকালের প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের দাঙ্গা-বিধ্বস্ত মুজফ্ফরনগর অঞ্চলে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে তীব্র বিভাজন পিছনে চলে যাচ্ছে। কৃষক আন্দোলন আদানি-আম্বানি কোম্পানিরাজের আধিপত্যের বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ বার্তাও পাঠিয়েছে। বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের আন্দোলন, কাজের দাবিতে যুব সম্প্রদায়ের আন্দোলন এবং জনশিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবা ও পরিবহনের জন্য সাধ্যায়ত্ত ব্যবস্থার লক্ষ্যে ব্যাপকতর স্তরে অনুভূত প্রয়োজনীয়তার মধ্যে এই বার্তাকে অঙ্গীভূত করে নিয়ে মোদী সরকারের সর্বনাশা নীতিগুলোর বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী গণজাগরণের জন্ম দিতে হবে। জনগণের এই ধরনের লড়াকু ঐক্য, সরকারের দমন পরিকল্পনা এবং দেশে এখন বহাল অঘোষিত জরুরি অবস্থাকেও চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবে। আসন্ন নির্বাচনগুলোতে স্থানীয় ইস্যু এবং জনগণের উদ্বেগগুলোকে তুলে ধরার সময় আমাদের নির্বাচনী লড়াইগুলোকে দেশে বিকাশমান ফ্যাসি-বিরোধী প্রতিরোধের একটা মঞ্চেও পরিণত করতে হবে।
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ২ মার্চ ২০২১)