রাজনীতির বাজারে পরিবেশ চিরকালই দুয়োরাণী
The environment

যে কোনও রাজনৈতিক দলের নির্বাচনি ইস্তাহারে পরিবেশ একটি ফুটনোট ছাড়া আর কিছু নয়। অথচ বেলাগাম উন্নয়নের ফলে এবং এলাকার পরিবেশ উপেক্ষা করার কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিনিয়ত নানা দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। হিমালয়ের ভঙ্গুর এবং অত্যন্ত স্পর্শকাতর পরিবেশে এলাকার বাসিন্দা এবং পরিবেশবিদদের বিরোধিতা উপেক্ষা করে একের পর এক বাঁধ নির্মাণ হয়েছে। ডিনামাইট দিয়ে পাহাড় ফাটিয়ে পাকা রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। এর পরিণামে সম্প্রতি উত্তরাখন্ডের চামেলি জেলায় হিমবাহ ভেঙে বিশাল প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে গেছে। লকডাউনের সময় বিশাখাপত্তনমে স্টাইরিন গ্যাস লিক করে মানুষ মারা গেলেন। পরে জানা গেল যে কারখানাটি থেকে গ্যাস লিক হয়েছে সেটির পরিবেশের কোনও ছাড়পত্রই নেই। একই সময়ে প্রধানমন্ত্রী পাঁচটি রাজ্যে ৪১টি কয়লা ব্লক নিলাম করলেন যার মধ্যে ১৪টি ব্লক গভীর অরণ্য এবং সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যর কারণে নো-গো অঞ্চল(অর্থাৎ যে এলাকাগুলিতে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয় এমন কিছু করা যাবে না)। এর মধ্যে দু’টি অঞ্চল ভার্জিন ফরেস্ট, অর্থাৎ বিশুদ্ধ অরণ্য হিসাবে গণ্য করা হয়। অতীতে জোনগুলিতে খননের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরেও তা বাতিল হয়ে গেছে। তবুও খোদ প্রধানমন্ত্রী একই অঞ্চলে নতুন প্রকল্পের অনুমতি দিয়েছেন। এর থেকে বোঝা যায় পরিবেশ ও জলবায়ু রক্ষার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলি পুরো উদাসীন।

নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রকাশিত বিভিন্ন পার্টির ইস্তাহারে পরিবেশের নামমাত্র উল্লেখ রয়েছে, কিংবা কোনও উল্লেখই নেই। তৃণমূল কংগ্রেসের ইস্তাহারের সূচীপত্রে ১০টি বিষয়ের উল্লেখ আছে – অর্থনীতি, সামাজিক ন্যায় ও সুরক্ষা, যুব, খাদ্য, কৃষিকাজ ও কৃষি, শিল্প, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আবাসন, বিদ্যুৎ রাস্তা ও জল – পরিবেশের কোনো নামগন্ধ নেই। অথচ নদীগুলি থেকে নির্বিচারে বালি খনন, রাণিগঞ্জ অঞ্চলে কয়লা খনন, বেলাগাম জলাভূমি ভরাট করা এবং বায়ু ও শব্দ দূষণের কারণে মানুষের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা, পরিবেশ প্রবল ভাবে বিপন্ন।

বিজেপি’র ইস্তাহারে ঘাটাল, কান্দি এবং উত্তরবঙ্গে বন্যা নিয়ন্ত্রণের তথাকথিত মাস্টারপ্ল্যানের উল্লেখ আছে। আর ‘নমামি গঙ্গে’ প্রকল্পে বরানগর, বালি এবং হাওড়ার কাজের উল্লেখ আছে। ‘নমামি গঙ্গে’ একটা বিরাট ধাপ্পা! গঙ্গাকে পরিষ্কার ও অবিরল রাখা যদি সত্যি অগ্রাধিকার পেতো, তাহলে হিমালয় জুড়ে যত্রতত্র বাঁধ, পাকা রাস্তা বানানো বন্ধ হতো। বিজেপি ‘নমামি গঙ্গে’ প্রকল্পের কথা আওড়ায়, ওদিকে গঙ্গাকে রক্ষা করার জন্য হরিদ্বারের মাতৃসদন আশ্রমে একের পর এক সর্বত্যাগি সাধু বাঁধ নির্মাণ বন্ধ করার জন্য অনশন করে আত্মত্যাগ করছেন – স্বামী নিগমানন্দ, অধ্যাপক জিডি আগরওয়াল, যিনি সেন্ট্রাল পলিউশন কন্ট্রোল বোর্ডের প্রথম মেম্বার-সেক্রেটারি ছিলেন। স্বামী আত্মবোধনন্দজীর অনশন চলাকালীন তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর প্রতিবাদে আশ্রম প্রধান স্বামী শিবানন্দজী ১৪ মার্চ থেকে অনশন করছেন।

বামফ্রন্টের ইস্তাহারে পরিবেশ অপেক্ষাকৃত বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। পনেরো পাতার এই ছোট পুস্তিকাটিতে দশ নম্বর পাতায় পরিবেশের ওপর একটি অনুচ্ছেদ আছে। এতে জীববৈচিত্র্য, জলাশয় জলাভূমি, ইকোলজি রক্ষা ও অরণ্যভূমি রক্ষা ও বিস্তারের কথা বলা হয়েছে। নিষ্কাশিত বর্জ্য নিয়ন্ত্রণে এবং যানবাহনের দূষণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্লাস্টিক ব্যবহারে জনচেতনা বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে, সৌর শক্তির ব্যবহার এবং জল সংরক্ষণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। সামাজিক বনসৃজনে উৎসাহ দেওয়ার কথা আছে। সব ধরনের দূষণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং মানুষকে পরিবেশ রক্ষায় যুক্ত করার সংকল্প আছে। এটা অনস্বীকার্য যে অন্য দলগুলির তুলনায় অন্তত খাতায় কলমে পরিবেশের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা বেশি।

কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ইদানিংকালে পরিবেশ সংক্রান্ত সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয়, ইআইএ (এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট), খসড়া বিজ্ঞপ্তি, ২০২০ সম্পর্কে তাঁরা কোনও মন্তব্য করেননি। ‘একুশের ডাক মানুষের দাবি’ যা একটি নাগরিক কনভেনশনে আলোচনার মাধ্যমে নির্মিত তাতে এই বিষয়টি উল্লেখিত হয়েছে। একুশের ডাক মানুষের দাবিতে পরিবেশ নিয়ে এক পাতা জুড়ে আলোচনা রয়েছে যার সর্বাগ্রে রয়েছে ইআইএ খসড়া বিজ্ঞপ্তি বাতিল করার ডাক। কনভেনশনে এই খসড়া বিজ্ঞপ্তি বাতিল করার দাবি জানানো হয় কারণ এটা “পরিবেশের প্রশ্নকেই তামাদি করে দিতে চায়”। যদিও কীভাবে তামাদি হচ্ছে সেটার কোনও ব্যাখ্যা নেই।

ইআইএ ২০০৬তে কোনও অঞ্চলে প্রকল্প নির্মাণের আগে সেখানকার মানুষদের সম্মতি নেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। এরজন্য গ্রাম সংসদ ডেকে মতামত নেওয়া হতো। নিয়মগিরিতে বারোটি গ্রাম সভা সম্মতি না দেওয়াতে বেদান্তর প্রজেক্ট খারিজ হয়ে গেছিল। ২০২০-র খসড়াতে এই নিয়ম লঘু করে দেওয়া হয়েছে। আগে গ্রামসভার শুনানির জন্য ৩০ দিন দেওয়া হতো, সেটা কমিয়ে ২০ দিন করে দেওয়া হয়েছে। এইসব প্রজেক্ট প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত। এই কারণে সময় কমিয়ে দেওয়ার অর্থ, কম মানুষের শুনানিতে অংশগ্রহণ করা। এটা কোম্পানির মালিকের পক্ষে সম্মতি আদায় করা সুবিধাজনক করে দিয়েছে। একটি বিস্ময়কর শর্ত হচ্ছে কোনো কারখানা দূষণ ছড়ালে এলাকার মানুষ সেটার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে পারবে না! নাগরিক সমাজ, এনজিও, পরিবেশবিদরাও অভিযোগ জানাতে পারবে না। একমাত্র মালিক বা কোনও সরকারী সংস্থা যারা সমীক্ষা বা মূল্যায়ন করে তারা যদি নিজেরা সরকারকে জানায় যে দূষণ হচ্ছে, গ্যাস লিক হওয়ার সম্ভাবনা আছে, বর্জ্য জমিতে পড়ে উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে ইত্যাদি, তাহলে সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। এর চেয়ে হাস্যকর কিছু হতে পারে! মালিক, বা তার তাঁবেদার সরকারী সংস্থা, কখনো নিজেদের গাফিলতির কথা আগ বাড়িয়ে সরকারকে জানাবে? এর অর্থ কোনও এলাকায় দূষণ ঘটলে বাসিন্দাদের মালিক বা নির্দিষ্ট সরকারী সংস্থার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে। তারা সমস্যার সুরাহার ব্যবস্থা না করলে তাঁদের হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে হবে।

এছাড়া বহু দূষণ সৃষ্টিকারী শিল্পকে পরিবেশ মন্ত্রক বা পর্ষদের অনুমতি নেওয়ার আর কোনও প্রয়োজনই নেই। যেমন- ছোট, মাঝারি সিমেন্টের কারখানা, খনিজ পদার্থ নিষ্কাশন, ওষুধের বড় কারখানা, হাইওয়ে চওড়া বা দীর্ঘায়িত করা (২৫-১০০ কিমি), কয়লা এবং অন্য জ্বালানির তল্লাশ ইত্যাদি। আমরা জানি যে বীরভুমের দেউচা-পাঁচামিতে কয়লার খোঁজ পাওয়া গেছে। নতুন ইআইএ অনুযায়ী এই প্রকল্প শুরু করার জন্য এলাকার বাসিন্দাদের সাথে আলোচনার কোনো প্রয়োজন নেই। কোন প্রকল্প শুরু করার আগে ইআইএ করতে হবে বা পরিবেশ সংক্রান্ত অনুমতি নিতে হবে এরকম কোন বাধ্যবাধকতা আর নতুন খসড়া অনুযায়ী থাকবে না। যুক্তি হল কাজে গতি আনতে হবে, কবে অনুমতি মিলবে তার জন্য কি শিল্প বসে থাকবে? ‘ইজ অফ ডুয়িং বিজনেস!’ চটজলদি যাতে কাজ হয় তার জন্য শিল্পপতিদের সর্বাত্মক ভাবে সাহায্য করতে হবে। চুলোয় যাক পরিবেশ!

কোনো প্রকল্প সম্প্রসারণ এবং আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়েছে। ২৫%-এর অধিক করতে হলে ইআইএ করতে হবে, ৫০%-এর অধিক হলে জনতার শুনানির ব্যবস্থা করতে হবে। এই ক্ষেত্রেও জনতার সম্মতির গুরুত্বকে লঘু করা হয়েছে। কমপ্লায়েন্স অর্থাৎ কাজ সন্তোষজনক হচ্ছে কি না সেটার ওপর নজরদারিও শিথিল করা হয়েছে। আগে বছরে দুটো রিপোর্ট দিতে হতো, এখন সেটা একবার দিলেই হবে।

সরকারের মোদ্দা কথা পরিবেশ রক্ষার এতো সব আইন করার ফলে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্ষতি হচ্ছে। ইদানিং কালের আরও অনেক আইনের মতো শিল্পপতিদের লাগামছাড়া সুবিধা করে দেওয়ার জন্যই এই ইআইএ খসড়া রচিত হয়েছে। এতে জল-জঙ্গল-জমীন উজাড় হয়ে যাবে, লক্ষ লক্ষ মানুষ, বিশেষ করে আদিবাসীরা, জমিহীন, বাস্তুহীন, নিঃস্ব হয়ে পড়বে। এই ইআইএ বর্জন করার ডাক তোলা আবশ্যিক। এটা আশ্চর্যজনক যে পরিবেশের ওপর প্রভাব যাচাই করার জনবিরোধি এই প্রস্তাবিত খসড়া সম্পর্কে বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলির কোনো হেলদোল নেই।

- সোমনাথ গুহ 

খণ্ড-28
সংখ্যা-11