ফ্যাসিস্ট কব্জার বিপদ থেকে বাংলাকে বাঁচানোর চ্যালেঞ্জ
The challenge is to save Bengal

সিপিআই(এম)-এর সাপ্তাহিক মুখপত্র ‘পিপলস ডেমোক্রেসি’র(পিডি) ১৪ মার্চ ২০২১ সংখ্যায় একটি রাজনৈতিক ভাষ্য প্রকাশিত হয়েছে যেখানে সিপিআই(এমএল)-কে পশ্চিমবঙ্গে “ভুল দিকে” যাওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। সিপিআই(এম) পলিটব্যুরোর ১১মার্চ ২০২১ তারিখের অনলাইন বৈঠকের সিদ্ধান্ত ‘পিবি বিজ্ঞপ্তি’ হিসেবে পত্রিকাটির ওই একই সংখ্যায় প্রকাশ করা হয়েছে। কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু, আসাম ও পুদুচেরির আসন্ন বিধানসভা নির্বাচন প্রসঙ্গে এই ‘পিবি বিজ্ঞপ্তি’-তে বলা হয়েছে, ‘সিপিআইএম মূলত বিজেপিকে হারানোর কাজেই উদ্যম কেন্দ্রীভূত করবে’। তাহলে কেন এবং কীভাবে সিপিআই(এম) মনে করছে যে সিপিআই(এমএল) পশ্চিমবঙ্গে ‘ভুল দিকে’ যাচ্ছে?

এই নির্বাচনে সিপিআই(এমএল) কী অবস্থান নিয়েছে তা প্রথমে পাঠক-পাঠিকাদের অবগত করা দরকার। কেরালা ও ত্রিপুরাতে সিপিআই(এমএল) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে না, কেরালায় এলডিএফ-কে এবং ত্রিপুরা স্বায়ত্তশাসিত জেলা পরিষদ নির্বাচনে বামফ্রন্টকে সমর্থন করছে। তামিলনাড়ু ও পুদুচেরিতে অল্প কয়েকটি আসনে (যথাক্রমে ১২ ও ১) সিপিআই(এমএল) স্বাধীনভাবে লড়ছে এবং বাকি আসনগুলিতে বিজেপি ও তার শরিকদের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া মূল জোটকে সমর্থন দিচ্ছে। আসামে সিপিআই(এমএল) ও সিপিআই(এম) একই বিরোধী জোটের অংশীদার (অবশ্য কার্বি আংলং জেলায় কংগ্রেস আসন সমঝোতা থেকে পিছিয়ে আসায় সিপিআই(এমএল) এই পাহাড়ি জেলায় স্বাধীনভাবেই লড়বে)।

পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই(এমএল) ১২টি আসনে স্বাধীনভাবে লড়ছে। কেউ যদি মনে করেন যে পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই(এমএল) সিপিআই(এম)-এর সাথে জোট ভেঙ্গে দিল তাহলে আমরা তাঁদের স্পষ্ট করে জানিয়ে রাখতে চাই যে বাংলায় কোনোদিনই সিপিআই(এমএল) ‘বামফ্রন্ট’-এর অংশীদার ছিল না এবং সিপিআই(এম)-এর সাথে কোনও দিনই কোনও নির্বাচনী বোঝাপড়া হয়নি, যদিও অনেক নির্বাচনেই সিপিআই(এমএল) বামফ্রন্ট প্রার্থীদের সমর্থন দিয়েছে, বিশেষত ২০১১ সালের পর থেকে যখন বামফ্রন্ট আর ক্ষমতায় নেই। যে ১২টি আসনে সিপিআই(এমএল) লড়ছে তার বাইরে সেই সমস্ত আসনেই আমরা বামফ্রন্ট প্রার্থীদের খোলাখুলি সমর্থন দিয়েছি যেগুলোতে বামফ্রন্ট ২০১৬’র নির্বাচনে জিতেছে কিন্তু দলত্যাগ করে টিএমসি বা বিজেপিতে চলে যায়নি (বামফ্রন্টের বিজয়ী ৩২ জনের মধ্যে ৮ জন এরকম দলত্যাগ করেছেন)। আমাদের এই অবস্থানে তো সিপিএমের কোনও সমস্যা হওয়ার কথা নয়!

এর বাইরে বাকি আসনগুলিতে সিপিআই(এমএল)-এর অবস্থান নিয়ে তাহলে তাদের সমস্যা। এই আসনগুলিতে দল বা প্রার্থী নির্দিষ্ট না করে বিজেপিকে পরাজিত করতে সক্ষমতম বা সবচেয়ে সম্ভাবনাময় অবিজেপি প্রার্থীকে ভোট দিতে আবেদন জানিয়েছে সিপিআই(এমএল)। অবাক কাণ্ড হলো, পিডি ভাষ্যে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে এই অবস্থান “ইঙ্গিত করছে” যে “২০০’র বেশি আসনে তাদের (সিপিআইএমএলের) সমর্থন টিএমসি-র দিকে”। এরকম ব্যাখ্যার অর্থ কী? এর অর্থ কি এই যে, সিপিএমের নিজস্ব হিসেবে ২০০-র বেশি আসনে মূল লড়াইটা বিজেপি আর টিএমসির মধ্যেই? সবশেষে পিডি ভাষ্য উপসংহার টেনেছে: “এটা দুর্ভাগ্যের বিষয় যে সিপিআই(এমএল) আশ্চর্যজনকভাবে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের চেয়ে টিএমসি-কে বেটার বিজেপি-বিরোধী শক্তি মনে করছে”।

সিপিআই(এমএল)-এর অবস্থান থেকে এমন আশ্চর্যজনক সিদ্ধান্তে কীভাবে পৌঁছনো সম্ভব! বামফ্রন্ট বা বামফ্রন্ট, কংগ্রেস ও নবগঠিত ইণ্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের (যারা এখন শোনা যাচ্ছে এক অন্য পার্টির নামে প্রার্থী দিচ্ছে) বৃহত্তর নির্বাচনী জোটে না থাকা সত্বেও সিপিআই(এমএল) অন্তত দুই ডজন আসনে বামফ্রন্ট প্রার্থীদের সমর্থন করছে, কিন্তু সিপিআই(এম) তো তার বিনিময়ে একটি আসনেও সিপিআই(এমএল)-কে সমর্থন দেয়নি। বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে কংগ্রেস বা আইএসএফ-কে সিপিআই(এমএল)-এর থেকে ‘বেটার’ ফোর্স সিপিএম মনে করে কি না সে প্রশ্নও তাহলে উঠতে পারে। পশ্চিমবাংলায় বিজেপির ক্ষমতায় আসার বাস্তব বিপদ সম্পর্কে উদ্বিগ্ন শক্তিগুলির সিংহভাগের কাছে নির্বাচনী সংগ্রামে কার কতটা সাধ্য রয়েছে তা মূল প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। একদিকে বেশ কিছু বিরোধী দল বিজেপির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে টিএমসি-কে সমর্থন দিয়েছে, অন্যদিকে বিজেপিকে বাদ দিয়ে কাকে ভোট দিতে হবে তা “নো-ভোট-টু-বিজেপি” অভিযান ও সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার বিজেপি-বিরোধী প্রচারাভিযান নির্বাচকমণ্ডলীর বিবেচনা ও পছন্দের ওপর ছেড়ে রেখেছে।

ভারতীয় গণতন্ত্রের এই সঙ্কটকালে পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই(এম)-এর কৌশলগত লাইন ও রাজনৈতিক ভূমিকার নিদারুণ সংকীর্ণতা ও সীমাবদ্ধতাকে সিপিআই(এমএল) প্রশ্নবিদ্ধ ও উন্মোচিত করেছে – এটাই বোধকরি সিপিআই(এম)-এর আসল মাথাব্যাথার জায়গা। পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এলে সংঘ-বিজেপির ফ্যাসিস্ট হামলা কী মাত্রায় বেড়ে যাবে তা অনুধাবন করা তো তেমন কিছু কঠিন ব্যাপার নয় (এখানে এটাও স্মরণ করিয়ে দেওয়া ভালো যে আমরা এই প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে কখনই ফ্যাসিস্ট শব্দটিকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখছি না, পিডি ভাষ্যটিতে বারবার যেরকম করা হয়েছে, কেন করেছেন তা লেখক বা সম্পাদকই ভালো বলতে পারবেন)। মাত্র এক দশক আগেও পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় থাকা একটি দল, ইতিহাসের গতিতে রাজ্যে স্বাধীনতাপূর্বকাল থেকে দশকের পর দশক ধরে গড়ে ওঠা কমিউনিস্ট গণভিত্তি ও প্রভাবের সবচেয়ে বড়ো ধারক সিপিআই(এম)-এর মতো একটি দল রাজ্যে বিজেপির এই বিপজ্জনক বৃদ্ধির ব্যাখ্যা কেবলমাত্র টিএমসি-র ঘাড়ে দায় চাপিয়েই সেরে ফেলতে পারে না। টিএমসি-র ক্ষমতায় থাকাকেই যদি পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির উত্থানের একমাত্র কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয় তাহলে একই যুক্তিতে ত্রিপুরায় বিজেপির উত্থানের জন্য তো সিপিআই(এম)-কেই দায়ী করতে হয়।

পশ্চিমবঙ্গে টিএমসি-র রাজত্ব নিশ্চিতভাবেই একদিকে সন্ত্রাস, হিংসা ও দুর্নীতি আর অন্যদিকে পপুলিস্ট শ্লোগান ও কল্যাণমূলক বিভিন্ন প্রকল্পের মিশ্রণ। সিপিআই(এম)-এর কর্মী-সমর্থক এমনকি বিধায়কদেরও বিজেপিতে যোগদানের পরিঘটনাকে প্রথমে দেখা হয়েছিল টিএমসি-র সন্ত্রাসের ফল হিসেবে – টিএমসির বিরুদ্ধে কোনও কার্যকর প্রতিরোধ খাড়া করার অবস্থায় সিপিআই(এম) আছে বলে যেহেতু কেউ মনে করছিল না তাই বাম সমর্থকরা বিজেপিতে যাচ্ছে এমনটাই শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু ২০১৬র পর থেকে সিপিআই(এম)-এর ক্ষয় বিপজ্জনক মাত্রায় বৃদ্ধি পায় এবং ২০১৯-এর নির্বাচনে এসে মাত্র একজন সিপিআই(এম) প্রার্থীরই জামানত রক্ষা পায়, আর সিপিআই(এম)-এর ভোট শতাংশ নেমে আসে এক অঙ্কে (৭%)। ত্রিপুরার অভিজ্ঞতা অন্তত পশ্চিমবঙ্গের সিপিআই(এম)-কে শিক্ষা দিতে পারত। কিন্তু না। দলের এক বিপুল অংশ “আগে রাম, পরে বাম”-এর ফাঁদে ধরা দেয়। এমনকি ২০১৯ নির্বাচনে ধাক্কার পরেও আত্মঘাতী “একুশে রাম, ছাব্বিশে বাম” ফর্মুলা নাকচ করার কোনও গম্ভীর প্রচেষ্টা সিপিআই(এম)-এর তরফ থেকে চোখে পড়ছে না।

পিডি ভাষ্য আমাদের বলছে যে পশ্চিমবঙ্গের জনগণের মনোযোগ আকর্ষণ করতে হলে সবার আগে আপনাকে আপনার টিএমসি-বিরোধী বিশ্বাসযোগ্যতা তুলে ধরতে হবে। নিশ্চিতভাবেই এই দিকটায় সিপিআই(এম)-এর এক বিন্দু খামতি নেই! তথাপি সিপিআই(এম) ভোটাররা ক্রমাগত টিএমসি-র সম্ভাব্য শক্তিশালী বিকল্প হিসেবে বিজেপির দিকেই সরে যাচ্ছে। এখনও কি সময় হয়নি সিপিআই(এম)-এর, পুনর্বিবেচনা করে নিজেদের অভিমুখ সংশোধন করে নেওয়ার? টিএমসি-বিরোধী পরিচয়পত্র নয়, প্রশ্ন হলো বিজেপি বিরোধিতার ধার কতটা থাকছে। পিডি ভাষ্য আমাদের বলছে যে সিপিআই(এম) বিজেপির বিপদকে খাটো করে দেখছে না বা বিজেপি ও টিএমসি-কে সমানও বলছে না। তবু বাস্তব জীবনে সিপিআই(এম)-এর বাচন লক্ষ্য করে যেকোনও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকই সিপিআই(এম) নেতাদের অজস্র উক্তি, বিবৃতি বা মিছিলের শ্লোগান সামনে এনে হাজির করতে পারবেন যেখানে বিজেপি ও টিএমসি-কেই প্রধান বিপদ হিসেবে দেখা হচ্ছে বা তৃণমূলকে ক্ষমতাচ্যুত করেই বিজেপির বিরুদ্ধে লড়া যায় এই বক্তব্য সমানে তুলে ধরা হচ্ছে।

বাজপেয়ীর জমানায় যেহেতু কিছুদিনের জন্য টিএমসি এনডিএ-তে যোগ দিয়েছিল তাই সিপিআই(এম) টিএমসি-কে এখনও কার্যত এনডিএ-র শরিক হিসেবেই ধরতে চায়। বাস্তব বিষয়টা হল টিএমসি-বিজেপি জোট কোনোদিনই বাংলায় পায়ের তলায় মাটি পায়নি। প্রকৃতপক্ষে ২০০৪ লোকসভা নির্বাচন ও ২০০৬ বিধানসভা নির্বাচন বিজেপি ও টিএমসি উভয়ের জন্য সবচেয়ে খারাপ ছিল আর সিপিআই(এম) ২০০৬-এর বিধানসভা নির্বাচনেই অদ্যাবধি সর্বোচ্চ ফল করেছিল। পিডি ভাষ্য আমাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চায় যে এমনকি ২০১৪ সালেও মোদি টিএমসি-কে সম্ভাব্য জোটসঙ্গী হিসেবে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। কথাটা সত্যি। কিন্তু বাস্তবে ঘটনা অন্যভাবে এগিয়েছে। প্রতিবেশী বিহার রাজ্যে নীতীশ কুমার যখন এনডিএ-তে ফিরে গেছেন, পশ্চিমবঙ্গের সরকার কিন্তু সে পথে চলতে অস্বীকার করেছে। আজকের পরিস্থিতি যখন আকালি দল বা শিবসেনার মতো পূর্বতন এনডিএ শরিকদের বিজেপি থেকে দূরে সরে আসতে বাধ্য করছে তখন টিএমসি-কে বিজেপির সাথে এক বন্ধনীভুক্ত দেখিয়ে কার কোন উদ্দেশ্য সাধিত হতে পারে?

বিজেপি-বিরোধী লড়াইয়ে দোদুল্যমান শক্তি হিসেবে টিএমসিকে উন্মোচিত করা এবং বিজেপি-বিরোধী লড়াইয়ের অবিচল অগ্রণী শক্তি হিসেবে বামপন্থীদের প্রতিষ্ঠা করা এক জিনিস, কিন্তু টিএমসি ও বিজেপিকে একাসনে বসিয়ে এমনকি ‘বিজেমূল’ হিসেবে দলা পাকিয়ে দেওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। ২০১৯-এ বিজেপির পুলোয়ামা-পরবর্তী উগ্র প্রচারাভিযানের মাঝেও টিএমসি ৪৩%-এর বেশি ভোট টেনেছিল। এই ভোটাররা কারা? বাংলার গ্রাম ও শহরের দরিদ্র জনতার বৃহৎ অংশ, লক্ষ লক্ষ মহিলা ও রাজ্যের সংখ্যালঘু মুসলমান ভোটারদের বিপুল অংশ। এঁদের একটা বড় অংশ অতীতে বামপন্থীদের সমর্থক ও ভোটার ছিলেন, এবং বর্তমান সময়েও তাঁরা বিজেপির সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণের রাজনীতি মেনে নিতে রাজি নয়। জনতার যে অংশ ইতিমধ্যেই বিজেপির বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে প্রভাবিত ও বিবশ হয়ে পড়েছে তাদের সাথে এই বিজেপি বিরোধী গণভিত্তিকে একাকার করে কেন দেখব?

পিডি ভাষ্য আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে এটা পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার নির্বাচন হচ্ছে। অবশ্যই তাই। রাজ্য বিধানসভারই নির্বাচন, এবং রাজ্য সরকারকে অবশ্যই দায়বদ্ধ করতে হবে। কিন্তু আমাদের এ কথাও তো স্মরণে রাখতে হবে যে এই বিধানসভা নির্বাচনটি হচ্ছে ২০২১ সালে, যখন মোদি সরকার দ্রুতই সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করছে আর সংবিধানকে ও সংবিধানের অন্তর্বস্তু — ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও বিবিধতা — কে সমানে পদদলিত করে চলেছে। বর্তমানে বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলির মধ্যে অন্যতম হল পশ্চিমবঙ্গ এবং বিজেপি তা দখল করতে মরিয়া। পশ্চিমবঙ্গের প্রগতিশীল ঐতিহ্য ও মৈত্রীর ভাবধারা আজ বিপন্ন, আর বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা দখল করলে গোটা দেশে বিরোধী পরিসর আরও সংকুচিত হবে এবং দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেই কারণেই গোটা দেশের মানুষ পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের দিকে আকুলভাবে তাকিয়ে আছে। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের এই অভূতপূর্ব সর্বভারতীয় গুরুত্বকে খাটো করা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির নিদর্শন ছাড়া আর কীই বা বলা যায়!

বস্তুত আজ বিজেপিই পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনকে শুধুমাত্র রাজ্যের প্রসঙ্গে সীমাবদ্ধ রাখতে মরিয়া। ওরা জানে যে এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের ভেতরে পরিবর্তনের ডাক সর্বাগ্রে বিজেপি-কেই লাভবান করবে। গভীর হতে থাকা সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ এবং একটা নতুন পার্টিকে চান্স দেওয়ার আহ্বান উভয়ই বিজেপির অনুকুলে কাজ করছে। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনকে জাতীয় প্রসঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার এবং মোদি সরকার ও বিজেপিকে আড়ালে রাখার এই বিজেপি প্রণোদিত কমন সেন্সকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েই বামেদের নির্বাচনী প্রচারাভিযান চালিত হওয়া দরকার। কিন্তু ২৮ ফেব্রুয়ারী বামফ্রন্ট-জাতীয় কংগ্রেস-আইএসএফ-এর ব্রিগেড সমাবেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন বার্তা ছড়াল। এমনকি চলমান ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের বিশেষ প্রেক্ষাপটে এবং মূল্যবৃদ্ধি, কর্পোরেট আগ্রাসন ও বেকারত্বের তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের মাঝে দাঁড়িয়ে ব্রিগেড সমাবেশ বার্তা দেয় যে পশ্চিমবঙ্গকে বিজেপির হাতে পড়া থেকে বাঁচানোর চেয়েও টিএমসি সরকারকে অপসারণ করাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আর ব্রিগেড সমাবেশ কার্যত যে দলটির লঞ্চিং প্যাড হয়ে উঠল সেই আইএসএফ-এর রাজনৈতিক ঘোষণার মূল অভিমুখ তো প্রায় পুরোপুরি রাজ্য সরকারের বিরোধিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

পিডি ভাষ্য আমাদের আরও স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছে যে টিএমসি কোনো আরজেডি নয়। একটি কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে স্বাধীন বিরোধীপক্ষের ভূমিকা পালন করতে গিয়ে আমাদের সবক’টি প্রধান রাজ্যেই অনেক মূল্য চোকাতে হয়েছে, তা সে আরজেডি শাসিত বিহার, কংগ্রেস শাসিত আসাম, বিজেপি শাসিত ঝাড়খণ্ড হোক বা বামফ্রন্ট শাসিত পশ্চিমবঙ্গ। বিহারে আমরা অনেকগুলি গণহত্যার শিকার হয়েছি। কিন্তু বাম-শাসিত পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় যথাক্রমে ১৯৯৩-এ বর্ধমানের করন্দা গণহত্যা ও ১৯৮০-র হুরুয়ার গণহত্যাও কম নৃশংস ছিল না। বিহারে সামন্তী শক্তি ও আমাদের বিরুদ্ধবাদী রাজনৈতিক দলের জিঘাংসায় আমরা বেশ কিছু নেতাকে হারিয়েছি, এবং আসাম, ঝাড়খণ্ড আর পশ্চিমবঙ্গেও। আরজেডি শাসিত বিহারে মনি সিং, চন্দ্রশেখর ও মঞ্জু দেবীর মতো কমরেড, বিজেপি শাসিত ঝাড়খণ্ডে কমরেড মহেন্দ্র সিং, কংগ্রেস শাসিত আসামে কমরেড অনিল বরুয়া আর গঙ্গারাম কোল এবং বাম শাসিত পশ্চিমবঙ্গে আব্দুল হালিম — রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের দ্বারা খুন হওয়া অগ্রণী কমরেডদের কয়েকজন। কিন্তু ভারতীয় গণতন্ত্রের বনিয়াদ ও বাম আন্দোলনের সামনে প্রধান বিপদ হিসেবে বিজেপিকে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে এই হত্যাকাণ্ডগুলি কখনই আমাদের অন্ধ করে রাখতে পারেনি। পৃথিবি জুড়ে সব ফ্যাসিস্ট শক্তির মূল নির্ধারক বৈশিষ্ট্য হল রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র-বহির্ভূত শক্তির দ্বারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও মতাদর্শগত প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ, বৈষম্য ও হিংসা ছড়ানোর রাজনীতি। ভারতকে হিন্দু প্রভুত্ববাদী জাতিতে পরিণত করার লক্ষ্যে বিজেপির উদ্ধত আগ্রাসী অভিযানই আজ গণতন্ত্রের সামনে সবচেয়ে বড় বিপদ।

একটি স্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে আমরা বিহারে ১৫ বছর ধরে চলা আরজেডি রাজত্বে ধারাবাহিকভাবে বিরোধীপক্ষের ভূমিকা পালন করেছি, ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট শাসিত বাংলাতেও করেছি। আরজেডি শাসনের বিরোধিতা করলেও নীতীশ কুমার বিজেপির সাথে হাত মেলানোর পর কখনোই আমরা তাঁর দিকে সহযোগিতার কোনো হাত বাড়িয়ে দিইনি। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের বাইরে আমরাই একমাত্র বাম দল যাদের বাম জমানায় টিএমসি’র সাথে রাজনৈতিক সহযোগিতার কোনও ইতিহাস নেই। সিপিআই(এম)-কে সরিয়ে ক্ষমতায় আসার পর মমতা ব্যানার্জী আমাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছেন এমন কোনও উদাহরণ স্মরণ করতে পারবেন না। আজ তিনি যদি আমাদের বিজেপি-বিরোধী সুদৃঢ় অবস্থানের জন্য ধন্যবাদ জানান তাহলে তা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে যাওয়াকেই দেখিয়ে দিচ্ছে। বামফ্রন্টকে সরিয়ে তৃণমূলের ক্ষমতায় আসা আর আজ তৃণমূলকে সরিয়ে বিজেপির ক্ষমতায় আসার বিপদ – এই দুই পরিস্থিতির গুণগত পার্থক্য কি ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে?

আর এটাও অদ্ভুত যে সিপিআই(এমএল)-কে মমতা ব্যানার্জির ধন্যবাদ জানানোর কথা পিডি উল্লেখ করলেও বিজেপি নেতারা যে ২০১৯-এ বিজেপিকে সহযোগিতা করার জন্য সিপিআই(এম)-এর নেতা-কর্মীদেরদের প্রকাশ্যে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন এবং ২০২১-এ আরও বেশি সহযোগিতার আবেদন জানিয়ে চলেছে সে বিষয়ে পিডি কোনও মন্তব্য করেনি। আজ যখন পশ্চিমবঙ্গ ফ্যাসিস্ট কব্জায় চলে যাওয়ার ভয়ানক বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে তখন একটি কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে আমাদের প্রধান কাজই হল এই আসন্ন বিপদ থেকে বাংলাকে বাঁচানো।

আমরা আশা করেছিলাম যে ২০১১-পরবর্তী এবং আরও বেশি করে ২০১৪-পরবর্তী পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক বিন্যাস বৃহত্তর বাম ঐক্য বিকশিত ও সংহত করার অনুকুল পরিবেশের জন্ম দেবে। কিন্তু হায়! প্রথমে কংগ্রেস ও তারপর নবগঠিত আইএসএফ-এর সাথে জুড়ে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের ছক কষতে গিয়ে বামপন্থার পুনর্জাগরণের অভিঘাতকেই সিপিআই(এম) লঘু করে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে বামেরা আবার উঠে দাঁড়াতে পারে কেবলমাত্র লড়াইয়ের ময়দানে এক জোরালো বিজেপি-বিরোধী ভূমিকা পালনের মাধ্যমেই। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গ তার ঐতিহাসিক কর্তব্য পালন করুক — এই প্রত্যাশা নিয়ে সারা দেশের বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তি যখন পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীদের দিকে তাকিয়ে আছে তখন দুর্ভাগ্যবশত সিপিআই(এম) তার টিএমসি-বিরোধী পরিচিতি নিয়ে আচ্ছন্ন। আমরা তবু আশা রাখব যে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বিজেপির এই ডাবল ইঞ্জিন অভিযানকে রুখে দেবে, আর ফ্যাসিস্ট হামলার জবাব দিয়ে গণতন্ত্রের সুদৃঢ় ও অবিচল চ্যাম্পিয়ন হিসেবে বাংলার বামপন্থীদের বলিষ্ঠ ভূমিকা আবার সামনে আসবে।

খণ্ড-28
সংখ্যা-11