এবারের বাজেট ভাষণে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন ২টি সরকারি ব্যাঙ্ক প্রাইভেট মালিকানায় ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা করেন। ঠিক কোন দুটি ব্যাঙ্ক সে বিষয়ে নির্দিষ্ট উল্লেখ না হলেও সাম্প্রতিক কালে ব্যাঙ্ক সংযুক্তি (মার্জার) প্রক্রিয়ার বাহিরে থাকা ব্যাঙ্ক গুলির মধ্য থেকে কোন দুটি কে বেঁচে দেওয়া হবে। এই তালিকায় যে ব্যাঙ্ক গুলি আছে তা হল ইউকো ব্যাঙ্ক, ইন্ডিয়ান ওভারসিজ ব্যাঙ্ক, ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া, ব্যাঙ্ক অফ মহারাষ্ট্র এবং পাঞ্জাব এন্ড সিন্ধ ব্যাঙ্ক। এই ব্যাঙ্কগুলির সদর দফতর দেশের উত্তর, দক্ষিণ, পুর্ব, পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত এবং ৫১ বছর আগে সরকারের মাধ্যমে জনসাধারণের মালিকানায় এসেছিল। অর্থমন্ত্রী আরো জানান যে সরকার আইডিবিআই ব্যাঙ্ক বিক্রি করে দিতে চায় এবং সাধারন বীমা (জিআইসি) বেসরকারি হাতে তুলে দেবে।রাষ্ট্রায়ত্ত জীবনবীমা (এলআইসি) নিগমেও প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বর্তমান ৪৯ শতাংশ বাড়িয়ে ৭৪ শতাংশে নিয়ে যাওয়া হবে। যার অর্থ হল এল আই সি শুধু বেসরকারি হচ্ছে না এখন থেকে সেটি একটি বিদেশি সংস্থায় পরিণত হবে।
সংসদে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠের জোরেই বিজেপি সরকার এই সব পদক্ষেপ নিতে পারছে সে কথা বলাই বাহুল্য। আমাদের দেশে আধুনিক ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা গড়ে ওঠার এক ইতিহাস আছে। কলকাতা, মাদ্রাজ এবং বম্বে প্রেসিডেন্সিতে যে তিনটি ব্রিটিশ ব্যাঙ্কগুলি ছিল সেগুলি একত্রিত হয়ে ১৯২১ সালে ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (আইবিআই) গঠিত হয়। স্বাধীনতা আন্দোলন এবং তারমধ্যে সরকার নিয়ন্ত্রিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণের দর্শনই ১৯৫৫ সালে পন্ডিত নেহেরুর নেতৃত্বে ভারত সরকার ইম্পেরিয়াল ব্যাঙ্ককে ভারতের স্টেট ব্যাঙ্কে রূপান্তরিত করে। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সরকার ১৯৬৯ সালে ১৪টি এবং ১৯৮০ সালে আরও ৬টি প্রাইভেট ব্যাঙ্ক রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নিয়ে আসেন। এখানে উল্যেখ করাই যায় যে আর্থিক প্রতিষ্ঠান সহ দেশের প্রগতির জন্য সরকারি ক্ষেত্র নির্মানের আবশ্যকতা স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকেই কংগ্রেসের মঞ্চে উচ্চারিত হয়েছে। অন্যদিকে বর্তমান বিজেপি এবং পুর্বসুরী জন সংঘ শুরু থেকেই এর বিরোধিতা করেছে। পরিসংখ্যান বলছে ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৯ দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রথম ২২ বছরে ৫৫৯টি প্রাইভেট ব্যাঙ্ক ডুবেছে। বিগত পঞ্চাশ বছরে ৩৬টি বেসরকারি ব্যাঙ্ক সরকারি ব্যাঙ্ককে বিলীন করে দিয়ে সাধারণ গ্রাহকের আমানত এবং ক্ষুদ্র সঞ্চয় রক্ষা পেয়েছে।
মোট ৩০টি সরকারি ব্যাঙ্কের যায়গায় এখন ১২টি ব্যাঙ্ক কাজ করছে। সরকার ৪/৫টি হাতে রেখে সবই বেঁচে দিতে চায়। কারণ ‘সরকারে কাজ ব্যাবসা করা নয়’। অন্য একটি কারণ হল ভারত সরকার এই সব বিক্রি বাট্টার অর্থ দিয়ে বাজেট ঘাটতি মেটাতে চায়।ব্যাঙ্ক সরকারের জন্য আয় করতে পারছে না বা লোকসানে চলছে এমন নয়। ২০২০ মার্চ সরকারি ব্যানকের মোট মুনাফা ১ লক্ষ ৭৪ হাজার কোটি টাকা। কর্মচারীদের বেতন সহ সমস্ত খরচ মেটানোর পরই এই লাভের অঙ্ক। কিন্তু ২ লক্ষ কোটি টাকা অনাদায়ী ঋণের হিসাব মিটিয়ে ব্যাঙ্ক গুলির খাতায় ২৬০০০ কোটি টাকা লোকসান লেখা হল। নরেন্দ্র মোদী সরকারের ক্ষমতায় আসার পর থেকে আজ পর্যন্ত ১৮ লক্ষ কোটি টাকা এনপিএ হয়েছে। যার মধ্যে প্রায় ৬ লক্ষ কোটি টাকা আদায় হয়েছে অন্যদিকে আনুমানিক সাত লক্ষ কোটি টাকা সরাসরি খাতা থেকে বাদ (রাইট অফ) দেওয়া হয়েছে।
এবারের ধর্মঘটে সারাদেশে দশ লক্ষ ব্যাঙ্ক কর্মচারী প্রত্যক্ষ ভাবে অংশ নেন। পশ্চিমবাংলায় আট হাজারের অধিক ব্যাঙ্ক শাখা, দশ হাজার এটিএম এবং প্রায় ৩০ হাজার ব্যাঙ্ক মিত্র, যারা গ্রামে বাস গ্রামে কিয়ক্স পয়েন্টের মাধ্যমে পরিষেবা দেয় দুদিন কাজ বন্ধ রাখেন। অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীরাও ধর্মঘটী কর্মচারিদের সঙ্গে থেকেছেন। সমস্ত কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের সাথে সাথে কৃশান আন্দোলনের নেতারাও এই ধর্মঘটের সমর্থনে দাঁড়িয়েছেন। সরকার কৃষি কে করপোরেট দের হাতে দিতে চায়। ভারতীয় করপোরেট রা তাদের কৃষি ব্যাবসার জন্য টাকার যোগান পাবে সরকারি ব্যাঙ্ক গুলি কমদামে কিনে নিয়ে। সরকারি ব্যাঙ্কগুলিতে আজকের দিন পর্যন্ত দেশের মানুষ জমা রেখেছেন ১৫৬ লক্ষ কোটি টাকা। লোভী করপোরেট দের লক্ষ্য হল টাকাটা হাতিয়ে নেওয়া। বিজেপি সরকার তাই প্রভুর স্বার্থ রক্ষায় পরিকল্পনামাফিক এগুচ্ছে।