যুক্তরাষ্ট্রীয়তা ও গণতন্ত্রের ওপর নামানো তাদের সাম্প্রতিকতম হামলায় মোদী সরকার লোকসভায় একটা বিল পেশ করেছে। ঐ বিলের উদ্দেশ্য হল দিল্লীর নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতাকে চূড়ান্ত মাত্রায় নিয়ন্ত্রিত করা এবং সমস্ত কার্যকরী ক্ষমতাকে দিল্লীর লেফটেন্যান্ট গভর্ণরের হাতে সমর্পিত করা। দিল্লীর জাতীয় রাজধানী অঞ্চল সরকার (সংশোধনী) বিল ২০২১ “সরকারকে” সংজ্ঞায়িত করেছে দিল্লীর লেফটেন্যান্ট গভর্ণর রূপে, এবং বিলে বলা হয়েছে, রাজ্য আইনসভা যে সমস্ত প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেবে ও আইন প্রণয়ন করবে তার জন্য লেফটেন্যান্ট গভর্ণরের অনুমোদন প্রয়োজন। এই বিল দিল্লীর নির্বাচিত সরকারকে এক তুচ্ছ সত্তায় পরিণত করতে চায় এবং সমস্ত ক্ষমতা ন্যস্ত করতে চায় লেফটেন্যান্ট গভর্ণরের হাতে যিনি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি। এই বিলটা তাই সংবিধান নির্দেশিত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর আক্রমণ মাত্র নয়, তা নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বের বুনিয়াদি গণতান্ত্রিক নীতির ওপর হামলা।
সুপ্রিম কোর্টের ২০১৮ ও ২০১৯ সালের রায়কে নাকচ করার উদ্দেশ্যেই বিলটি আনা হয়েছে বলে মনে হয়। ঐ দুই রায়ে সুপ্রিম কোর্ট সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীনভাবে লেফটেন্যান্ট গভর্ণরের ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রিত করে বলেছিল যে, তিনি পুলিশ, আইন ও শৃঙ্খলা এবং জমির এক্তিয়ারের বাইরে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। কংগ্ৰেস ও বিজেপি উভয়েই দিল্লীকে পরিপূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল — যদিও কেন্দ্রের ক্ষমতায় থাকার সময় কোনো দলই তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করেনি। প্রধানমন্ত্রী মুখে “সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয়তার” উপদেশ দিতে পারেন — কিন্তু তিনি দিল্লীকে পরিপূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দিতে যেমন নারাজ, তেমনই এই যুক্তিতে দিল্লীর নির্বাচকমণ্ডলীর ইচ্ছাকে খারিজ করতে চান যে, তারা এর আগে পরপর দুটো বিধানসভা নির্বাচনেই বিজেপিকে পরাস্ত করার পথে গিয়েছিল।
এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা গভর্ণমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট ১৯৩৫ চাপিয়ে দিতে চাইলে স্বাধীনতা আন্দোলন সফলভাবে তাদের সেই প্রচেষ্টাকে প্রতিরোধ করেছিল, কেননা, ঐ আইন গভর্ণর জেনারেল ও ভাইসরয়-এর হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার কথা বলেছিল। মোদী সরকার আরো একবার ব্রিটিশ সরকারের মতোই আচরণ করছে, শুধু নির্বাচিত আইনসভার ওপর ভাইসরয়-এর স্থানে গভর্ণরকে বসানোর কথা বলছে।
দিল্লী বিলই যুক্তরাষ্ট্রীয়তার ওপর মোদী সরকারের আক্রমণের একমাত্র নজির নয়। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য নজিরের মধ্যে রয়েছে জিএসটি আইন; যে সমস্ত রাজ্যে ও কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চলে বিরোধী দলগুলোর সরকার রয়েছে, সেগুলোর পতন ঘটাতে রাজ্যপাল পদটির অপব্যবহারের চেষ্টা; পশ্চিম বাংলার মতো রাজ্যে রাজ্যপালের কার্যত বিরোধী দলের নেতার মতো আচরণ করা, নির্বাচিত রাজ্য সরকারকে হেয় করার কোনো সুযোগকেই হাতছাড়া না করা; কলকাতা পুলিশ কমিশনারের অফিসে সিবিআই-এর হানাদারি চালানো; পাঞ্জাবের রাজ্য আইনসভা তিনটে কর্পোরেটপন্থী কৃষি আইনের বিরোধিতা করলে পাঞ্জাবে মালগাড়ি যাওয়া বন্ধ করা; এবং দিল্লী পুলিশের কর্ণাটক গিয়ে দিশা রবিকে আটক করে কর্ণাটকের পুলিশ ও বিচার বিভাগীয় কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে তাকে কর্ণাটক থেকে দিল্লী নিয়ে আসা, তাদের সম্মতি নেওয়ার কথা না হয় ছেড়ে দেওয়াই হল।
যুক্তরাষ্ট্রীয়তার ওপর মোদী সরকারের প্রথম দিককার আক্রমণের একটা প্রকট নজির ছিল ৩৭০ ধারাকে বাতিল করা এবং জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্যের মর্যাদা হরণ করে তাকে একাধিক কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে ভাগ করার পদক্ষেপ। উল্লেখ্য, সংবিধান অনুসারে ৩৭০ ধারা বাতিলের জন্য জম্মু ও কাশ্মীরের সংবিধান সভার সম্মতির প্রয়োজন ছিল। একটু বাড়িয়ে বলে এই যুক্তিও দেওয়া যেত যে, জম্মু ও কাশ্মীরের নির্বাচিত বিধানসভাই হল সংবিধান সভা। কিন্তু ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভাকে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল এবং রাজ্যে কোন নির্বাচিত সরকার ছিল না। মোদী সরকার ঘোষণা করল, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি রাজ্যপালই জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণের ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করছেন এবং ৩৭০ ধারা বিলোপের জন্য তাঁর সম্মতিই কেন্দ্রের কাছে যথেষ্ট। রাজ্যের যে যুক্তরাষ্ট্রীয় অধিকারগুলোর ভিত্তিতে তারা ক্ষমতা ভোগ করতে বা ভোগ করার আশা করতে পারে, সেগুলোকেই আপ, টিডিপি, বিএসপি, এআইডিএমকে, বিজেডি এবং ওয়াইএসআর কংগ্ৰেস-এর মতো দলগুলো প্রাণপণে সমর্থন করে; এরাই কিন্তু মোদী সরকারের অসাংবিধানিক, গণতন্ত্র-বিরোধী এবং যুক্তরাষ্ট্রীয়তা-বিরোধী ৩৭০ ধারা বিলোপের পদক্ষেপকে উৎসাহিত করেছিল। গুরুত্বপূর্ণ এই আঞ্চলিক দলগুলোর যোগানো বৈধতাকে ঢাল করে ৩৭০ ধারা বাতিলের পদক্ষেপ বিজেপির যুক্তরাষ্ট্রীয় বিরোধী তাড়নাকে উদ্দীপিত করে এবং আজ আমরা যুক্তরাষ্ট্রীয়তার ওপর একের পর এক যে আক্রমণগুলো দেখতে পাচ্ছি তার পথ প্রশস্ত করে।
দিল্লী বিল যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতি সম্পর্কে বিমূর্ত কোনো তাত্ত্বিক বিতর্কের বিষয় নয়। এই বিল দিল্লীর নির্বাচকমণ্ডলীর অধিকারের ওপর সরাসরি আঘাত হানছে। এই বিল সুনিশ্চিত ভাবেই জানান দিচ্ছে যে, কোনো রাজ্যের ভোটাররা অ-বিজেপি সরকার নির্বাচিত করার স্পর্ধা দেখালে তাদের শাস্তি দিতে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা প্রয়োগে তারা দ্বিধা দেখাবে না। এই ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ কি আছে যে, ভোটারদের নিয়ন্ত্রিত করতে ও শাস্তি দিতেও বিজেপি এনআরসি-এনপিআর-সিএএ-র মতো আইনগুচ্ছকে ব্যবহার করতে চায়, এবং তা কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা ব্যবহার করে শাসক বিজেপির দৃষ্টিতে তাদের স্বার্থের প্রতি বৈরিভাবাপন্ন ভোটারদের ভোটাধিকার হরণ করা এবং ভোটারদের সম্পর্কে “সন্দেহ” জাগিয়ে তোলার মধ্যে দিয়ে?
আমরা সবাই দেখতে পাচ্ছি, মোদী-শাহর শাসনাধীনে বিজেপি কিভাবে সরকারের বিরোধিতাকারী ও প্রতিবাদী প্রতিটি নাগরিকের পিছনে ছুটে তাদের “দেশদ্রোহী” বলে ছাপ মেরে জেলে পুরছে, তা তারা ছাত্র, লেখক, কৃষক, সাংবাদিক যাই হোন না কেন। বিজেপি এখন আবার তার রাজনৈতিক স্বার্থকে জাতির রাজনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে একাকার করে তুলে গোটা নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতাকেই খর্ব করছে। শাসক শ্রেণীর বিরোধী দলগুলো গণতন্ত্রের রক্ষায় অদৃঢ় হতে পারে —তাদের নিজেদের সরকার বিপন্ন হলে তারা প্রতিবাদ করে, কিন্তু দানবীয় ও সংবিধান-বিরোধী আইনগুলোর ক্ষেত্রে, বেআইনি গ্ৰেপ্তারি এবং সংবিধানের ধারাগুলি স্বেচ্ছাচারীভাবে বাতিল করার ক্ষেত্রে তারা মুখ বুজে থাকে। ভারতের জনগণকে কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রীয় ও গণতান্ত্রিক নীতিমালাকে প্রতিটি আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। দিল্লীর যুক্তরাষ্ট্রীয়তা রক্ষার আন্দোলন ভারতে গণতান্ত্রিক অধিকারের সমগ্ৰ বিন্যাসের রক্ষার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হলে তবেই তা ফলদায়ী হতে পারে।
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৬ মার্চ ২০২১)