ঝাঁক বেঁধে ঐ পদ্মবনে — কীসের টানে?
Swarming in the Padma forest

ঝাঁক ঝাঁক অভিনেতা অভিনেত্রীরা যাচ্ছেন বিজেপি’তে। কারণটা কী? ঘেঁটে যাওয়া রাজনৈতিক পরিমণ্ডল, না দিশাহীনতা, না সুবিধাবাদ? লকডাউনে যাকে দেখা গেল শ্রমজীবী ক্যান্টিনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিতে, তিনিই সম্প্রতি যোগ দিলেন বিজেপিতে; যিনি লকডাউন পর্বে চাঁচাছোলা ভাষায় আক্রমণ করলেন বিজেপি’কে, সুবিধাবাদী ট্রেন্ডকে -- তিনিও মানুষকে চমকে দিয়ে যোগ দিলেন বিজেপিতে। নির্বাচনের নামে এ যেন অদ্ভুত এক আইপিএল-এর দলবদল চলছে বাংলায়। কারণগুলো একটু খুঁটিয়ে দেখা যাক।

চিত্রতারকাদের হঠাৎ করে রাজনীতিতে আসা (বা টেনে আনা) এবং বিধায়ক, সাংসদ বনে যাওয়া -- এটা আমরা তৃণমূল জমানাতেই দেখেছি। বিজেপিও দাবি করতে পারে সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করছে মাত্র, অর্থাৎ গ্ল্যামার দুনিয়াকে ভর করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার উদ্দেশ্যটা নিরীহ। কিন্তু যাইই বলুক, ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের থাবায়, রূপোলি দুনিয়াকে তাদের গেরুয়া ছাতার তলায় নিয়ে আসাকে অত সহজভাবে নেওয়া যাচ্ছে না।

পদ্মবনের তারকাদের ভ্রমরগুঞ্জন: “ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা খুব খারাপ, কোভিড-১৯’র কারণে বিশেষ করে। ডবল ইঞ্জিন সরকার হলে সুরাহা হতে পারে”। “ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ পাওয়া, টিঁকে থাকার জন্য শাসকদলের রাজনৈতিক চাপের মধ্যে থাকতে হয় যা অনভিপ্রেত”, আবার উল্টো সুরে কেউ বলেছেন, “এখন সেখানে শাসকদলের নিয়ন্ত্রণ ক্ষীয়মান; অতএব –” ইত্যাদি ইত্যাদি।

গেরুয়া বাহিনী অনেক দিন ধরে বাংলার মসনদকে নিশানা করে রেখেছে এবং সুচিন্তিত পরিকল্পনা নিয়েই এগোচ্ছে। তাদের বুদ্ধি-বিবেচনা, কৌশল অনুযায়ী বাঙালির তথাকথিত ‘মন জয়ের’ চেষ্টার কোনো কমতি নেই। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, তারা না জানে বাংলার নাগরিক সংস্কৃতি, না জানে গ্রাম বাংলার শিশিরমাখা মাটির সংস্কৃতি! কিন্তু জনমানসকে বুঝতে গেলে যেমন তার নিজস্ব সংস্কৃতিকে বুঝতে হবে, তেমনি সেই জনমানসকে নিজের ইচ্ছেমত ভেঙে চুরে তৈরি করতে গেলে, সেই সংস্কৃতির ক্ষেত্রকে কব্জায় আনতে হবে। তারা ‘চাপিয়ে দেওয়ার’, ‘দখল করা’র রাজনীতিতেই বিশ্বাসী। তাই সংস্কৃতির সবচেয়ে জোরালো মাধ্যম বাংলার ছোট এবং বড় পর্দার জগতে অনুপ্রবেশের জন্য তারা মুখিয়ে ছিল। টলি-পাড়া! যেখানে বেশ অনেকদিন ধরেই চলছে ক্ষমতা ও টাকার খেলা। সেখানে নীতি-আদর্শের জায়গা নেই, বলাই বাহুল্য।

এই পরিস্থিতিটা একদিনে তৈরি হয়নি। বর্তমান শাসকদলের ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তা যথেষ্ট অস্বস্তিকরভাবে দৃশ্যমান হয়েছে ক্রমশ। সামাজিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অনুষঙ্গেই সেটা এসেছে। এই প্রক্রিয়ার দুটো দিক আছে - একটা পদ্ধতিগত আর একটা ব্যবহারিক অনুশীলনগত। তৃণমূলের বিভিন্ন নেতৃত্ব বিভিন্ন সময় নির্বাচনের প্রেক্ষিতে ভোটদাতাদের পাশাপাশি একটি সমান্তরাল ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেন। তা কি শুধুই পেশীশক্তি? তাহলে ‘খেলা হবে’ জাতীয় ন্যারেটিভ কি জন্য? এই সিস্টেমটার ধারক ছিল সিপিএম। পেশীর জোর তো বটেই, এর সঙ্গে কাজ করে আরও তিনটি ব্যাপার। এক, সামাজিক পুঁজি। যেমন রাতবিরেতে অসুস্থ শিশুর জন্য অটো জোগাড় করে আস্থাভাজন হওয়ার মতো নানা কাজ। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘দান-ধ্যানের’ কালচার যা অধিকারের লড়াইকে বহু ধাপ পিছিয়ে দেয়। অ্যাম্বুলেন্স বা রেশনের চাল পাওয়া মানুষের ‘অধিকার’, শাসকদলের দাক্ষিণ্য নয়!

দুই, পৃষ্ঠপোষণ, অর্থাৎ সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের সাহায্য পেতে পার্টির চ্যানেলে যেতে হবে। তিন, নজরদারি। সামাজিক নেটওয়ার্কের মধ্য দিয়ে খবর রাখা কে কোন দলের সঙ্গে আছেন এবং বেচাল করলে তার উপযুক্ত শাস্তি। গ্রামের মতো মৌখিক সমাজে নিজের পলিটিকাল আইডেনটিটি সাধারণ মানুষের পক্ষে লুকিয়ে রাখা শক্ত। তৃণমূল এই সংস্কৃতির বাহক। কিন্তু সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের বৃহত্তর আন্দোলনের আগে পর্যন্তও, সিপিআই(এম) এই তিন তন্ত্রকেই অটুট রেখেছিল। ফলত রাজনৈতিক মতাদর্শ ও লড়াইয়ের প্রশ্নটা ক্রমশ ‘ক্ষমতার রাজনীতির’ দাপটে আর ‘পাইয়ে দেওয়ার নীতি’র প্রশ্রয়ে গুরুত্ব হারিয়ে একসময় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। তাই মানুষ তথা যুবসমাজ যেরকম তফাৎ খুঁজে পায়নি সিপিএম-তৃণমূলের মধ্যে, সেরকমই এখনও তফাৎ খুঁজে পাচ্ছে না তৃণমূল বা বিজেপির মধ্যে। রাজনীতির গ্রগণযোগ্যতার মাপকাঠি হিসেবে মানুষ তাই জেনেছে -- ফি বছর ‘ভোটে জেতা’। এই নতুন তারকারাও তার ব্যতিক্রম নন।

ভোটের পাটিগণিত ছেড়ে আদর্শের রাজনীতিতে জোর দেননি উপরের কোনও দলই। দুর্বৃত্তায়নের যে সূচনা হয়েছিল মরিচঝাঁপি থেকে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম দিয়ে; তা তৃণমূলের আমলে সংঘটিত হয়েছে ভাঙড়ে, সম্প্রতি কমরেড মইদুলের হত্যা, এসএসসি চাকরি প্রার্থীদের উপর চলা অত্যাচার ইত্যাদি অজস্র উদাহরণে। এবং মাত্রাটা বেড়েই চলছে। নিজেই স্বৈরাচারী চরিত্রে অবতীর্ণ হচ্ছে তৃণমূল। পাশাপাশি ফ্যাসিবাদী বিজেপিকে কার্যকরিভাবে রুখতে তৃণমূল যত ব্যর্থ হচ্ছে, ততই ‘গণতন্ত্র পুনরদ্ধারের’ নামে বিজেপি এই বাংলায় তার পায়েরতলার মাটিকে আরও মজবুত করেছে।

দ্বিতীয় দিকটা হল, প্র্যাকটিসগত। পশ্চিমবঙ্গ বলতে ‘কোট-আনকোট’ বাঙালিকে বুঝি আমরা। আর বাঙালি বলতে আমাদের কেবল ‘শিক্ষিত, নম্র বা সংস্কৃতিবান’ ভাবমূর্তি, নরম-সরম, সাংস্কৃতিক সফিস্টিকেটেড ইমেজ বুঝি না -- সেটা বুর্জোয়া, উচ্চবিত্তদের তৈরি। তার বাইরে বাংলার ছাত্রযুব-নারী সমাজের একটা লড়াকু দিক আছে। গ্রামবাংলার খেটে খাওয়া মানুষও চিরকালই লড়াকু। রাজনৈতিক জমি দখলের লড়াইয়ে বাংলার কৃষকদের সঙ্গে পাঞ্জাব, কেরল বা ভারতের অন্য জায়গার কোনও পার্থক্য নেই। কিন্তু এই বার্তা, এই লড়াইয়ের ইতিহাস, যারা শাসকশ্রেণীর দলগুলোর সঙ্গে-প্রভাবে থাকাকে শ্রেয় মনে করেন তাদের কতজনের কাছে পৌঁছায়? বা পৌঁছলেও ‘সুশীল মাপকাঠি’ থেকে বেরিয়ে ‘লড়াই করা’ মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর কথা কতটা ভাবতে পারেন! টলি তারকারাও এই সিস্টেমেরই অংশ। এই সিস্টেম তাদের প্রভাব, প্রতিপত্তি, সামাজিক সম্মান মানে শাসকগোষ্ঠীর দেওয়া সম্মান, অর্থ ইত্যাদি এত কিছু পাইয়ে দেওয়ার মোহে আচ্ছন্ন করে, কোনও কোনও জীবিকার নিরাপত্তার পূর্বশর্তও হাজির করে। আর যারা রাজনীতি বলতে ওই ‘পাইয়ে দেওয়ার নীতিই’ বুঝেছেন তারা শিরদাঁড়া সোজা রাখবেন কি করে? এরসঙ্গে আরও একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া চলে -- তা হলো ‘ডিফেমেশান’। যারা এই মানদন্ড মানবেন না তারা ‘সুবিধাবাদী’ হিসেবে ট্যাগড্ হবেন। নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন, অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত মানুষ যারা বিজেপি’র নীতির বিরুদ্ধে বলেছেন তাদের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে সবকিছু নিয়ে চলেছে ধারাবাহিক কুৎসা। মানুষকে তাদের কথাই শোনানো হবে যারা কেন্দ্রের শাসকদল অর্থাৎ বিজেপি’র অনুগত। তাই কি ঝুঁকিহীন, মসৃণ জীবন পেতে পদ্ম-অনুগামী হওয়া নয়! এই ক্ষেত্রের মানুষগুলোকে বিজেপি’র আজ বড্ড দরকার। ছায়া জগতকে কাজে লাগিয়ে ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের রক্তাক্ত নখ-দাঁত আড়াল করা, মানুষের দেশজোড়া প্রতিবাদকে চাপা দিতে নানা কল্পকাহিনীর মোহিনী জাদুর মায়ায় মানুষকে ভুলিয়ে রাখা, আর তার সঙ্গে সাড়ম্বর আয়োজনে নিজের মনুবাদী দর্শনকে সমাজ জীবনে গেঁথে দেওয়া! এই দুরভিসন্ধির প্রয়োজনেই।

এই পুরো ফাঁপা সিস্টেমের বিরুদ্ধে দরকার আদর্শের রাজনীতি যা একমাত্র বামপন্থাই পারে। কিন্তু সে তো দীর্ঘ দৌড়ের ব্যাপার। বাংলার ভাগ্যাকাশে এখন সবচেয়ে বড় বিপদ হল ফ্যাসিবাদী শক্তি বিজেপি’র ধেয়ে আসা। টলিউডেরও শিয়রে সংকট। ছলে-বলে-কৌশলে অনুপ্রবেশ করতে মরীয়া ফ্যাসিবাদী শক্তি। তাই এখন তৃণমূল বিরোধিতায় বিজেপি’র সঙ্গে প্রতিযোগিতায় না নেমে দরকার বিজেপি’র বিরুদ্ধে শক্তিশালী লড়াই।

- সৌমি জানা   

খণ্ড-28
সংখ্যা-8