ভারতে ২০২১-এর আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপিত হল বিষণ্ণ ও ভয়াল পরিস্থিতিতে। ভারতের বর্তমান শাসকরা “নারীর ক্ষমতা”, “নারীর ক্ষমতায়ন” এবং “নারীর কীর্তি”র মতো ছেঁদো বুলি তুলে ধরেন, তার সাথেই নারীর সামাজিক ভূমিকা সম্পর্কে এমন মনোভাব ব্যক্ত করেন যা একেবারেই মার্কামারা ফ্যাসিস্ট ধ্যানধারণারই শামিল। কিন্তু সারা ভারতে নারী আন্দোলনের কাছে নারী দিবস ছিল তাদের ঐক্যকে জোরদার করা এবং একেবারে তাদের অস্তিত্বের ওপরই নামিয়ে আনা অভূতপূর্ব মাত্রার আক্রমণকে প্রতিরোধ করার এক উপলক্ষ। কেন্দ্রে মোদী সরকার এবং বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপি সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ায় নারী আন্দোলন এমন আক্রমণের মুখে পড়েছে যার নজির অভূতপূর্ব।
নারী দিবসে প্রধানমন্ত্রী টুইট করে তাঁর ভাষায় যা “অজেয় নারী শক্তি” এবং “আমাদের দেশের নারীদের বহু কীর্তি দেশের গর্ব” তাকে অভিবাদন জানান। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের বার্তা একেবারে নাজি ও মনুবাদীদের নির্দেশ-পুস্তিকা থেকে তুলে আনা। প্রশংসার ছদ্ম আবরণে ব্যক্ত হলেও ঐ বার্তা ছিল নারীদের প্রতি এক নৈতিক উপদেশ, যাতে নারীদের জন্য হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের নির্দিষ্ট করে দেওয়া সামাজিক ভূমিকা ও কর্তব্যমালাকেই মনে পড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, নারীদের অবশ্যই “পরিবার ও গৃহকে নির্মাণ করতে হবে, শিশুদের লালন-পালন করতে হবে এবং তাদের সু-নাগরিকে পরিণত করতে হবে”, যাতে তারা “এক আদর্শ পরিবার, আদর্শ সমাজ এবং আদর্শ রাষ্ট্র গঠনে” অবদান রাখতে পারে। এই বার্তার মধ্যে রয়েছে সেই নাজি শ্লোগানেরই প্রতিধ্বনি যাতে নারীদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল যে জাতির সেবায় তারা যেন “শিশু, রন্ধনশালা, চার্চ”-এর মধ্যে নিজেদের গণ্ডিবদ্ধ করে রাখে। তাঁর এই বার্তায় রয়েছে ২০০৯ সালে লেখা তাঁর এক নিবন্ধেরই নির্যাস, যাতে তিনি এই যুক্তিতে বিধানসভা ও সংসদে নারীদের সংরক্ষণের বিরোধিতা করেছিলেন যে, পুরুষরা রাজনৈতিক এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে নারীদের স্বাধীনতাকে অবাধ করে তুললে তাতে পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটি বিপন্ন হয়ে পড়বে এবং নারীরাও দানবে পরিণত হবে।
যোগী শাসিত উত্তরপ্রদেশকে বিজেপি হিন্দু রাষ্ট্রের এক পরীক্ষাগার রূপেই জাহির করে। এই রাজ্যে কিন্তু বারবারই ভয়াবহ ধর্ষণের ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে, আর ধর্ষকদের রক্ষা করতে এবং ধর্ষণের পর বেঁচে যাওয়া নারীদের, ধর্ষিতার পরিবারের সদস্যদের এবং ন্যায়বিচারের জন্য আন্দোলনকে হুমকি দিতে ও দমিয়ে রাখতে পুলিশ ও বিজেপি নেতারা পরস্পরের সঙ্গে হাত মেলায়। উত্তরপ্রদেশ আবার হল সেই রাজ্য যা ভিন্ন-ভিন্ন ধর্মের নারী ও পুরুষের মধ্যে বিবাহকে নিয়ন্ত্রিত ও প্রতিহত করতে আইন প্রবর্তনে পথ দেখায়, যে আইন নাজি জার্মানি এবং বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে বিবাহ নিরোধক কুখ্যাত আইনকে মনে পড়িয়ে দেয়।
৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবসের দিনেই ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ধর্ষণে অভিযুক্ত এক ব্যক্তির উদ্দেশ্যে করা তাঁরা এই মন্তব্যের ন্যায্যতা প্রতিপাদনে উঠেপড়ে লাগলেন —”তুমি কি ওকে বিয়ে করবে (ধর্ষিতাকে)? যদি রাজি হও আমরা সাহায্য করতে পারি। অন্যথায় চাকরি খুইয়ে তোমাকে জেলে যেতে হবে।” প্রধান বিচারপতির সমর্থনে এগিয়ে এসে ভারত সরকারের প্রতিনিধি সলিসিটর জেনারেল ঘোষণা করলেন, ধর্ষিতাকে বিয়ে করবে কিনা সে কথা ধর্ষণে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জিগ্যেস করাটা প্রধান বিচারপতির পক্ষে “পুরোপুরি বৈধ” ছিল। প্রায় ১০০০০ স্বাক্ষরকারী এক খোলা চিঠিতে দাবি জানিয়েছিলেন, বোবডে প্রধান বিচারপতির পদ থেকে পদত্যাগ করুন, কেননা, ঐ পদে থেকে ধর্ষণ সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য সমস্ত নারীকে হেয় প্রতিপন্ন করেছে ও তাদের বিপন্নতা বাড়িয়েছে। ঐ চিঠি প্রকাশের পরও প্রধান বিচারপতির মন্তব্যের সমর্থনে এই যুক্তিগুলো নামানো হল যা কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে হয়ে দেখা দিল। তাঁদের মন্তব্যের জন্য প্রধান বিচারপতি এবং সলিসিটর জেনারেল কোনো ধরনের অনুশোচনা প্রকাশ তো করলেনই না, বিপরীতে, যেটাকে কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না তাকে সমর্থন করতে দুজনে একজোট হলেন। ভারতে বিচার বিভাগের দিক থেকে যে সমস্ত আইনগ্রাহ্য নজির রয়েছে এবং যে সমস্ত প্রথা চলে এসেছে, সেগুলোর কোনো তোয়াক্কা না করে ভারতের বর্তমান প্রশাসন ও বিচার বিভাগের এই দুই প্রতিনিধি এই অভিমতের প্রতিই অনড় রইলেন যে, ধর্ষণে অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তির জামিনের আবেদনের নিষ্পত্তি করতে গিয়ে অভিযুক্ত ধর্ষিতাকে বিয়ে করতে রাজি আছে কিনা সে সম্বন্ধে তাকে জিগ্যেস করাটা প্রাসঙ্গিক।
প্রধান বিচারপতির এই আখ্যানটাই আমাদের বলে দিচ্ছে যে, নারীদের বুনিয়াদি অধিকার ও মর্যাদা কিভাবে বিপজ্জনক মতাদর্শের কবলগ্রস্ত হয়ে পড়েছে যে মতাদর্শই আজ ভারতীয় রাষ্ট্রের স্তম্ভগুলোকে গ্রাস করেছে এবং সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছে। কুৎসিত ও উৎকট নারী বিদ্বেষের স্বাক্ষর রেখেও পার পেয়ে যাবার সামর্থ্য বোবডের মতো ব্যক্তিদের রয়েছে। এই ধরনের ব্যক্তিরা ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের শীর্ষে আসীন হলে নারীদের স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত করতে পারবে বলে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের ওপর আস্থা রাখা যাবে কিভাবে, যে স্বাধীনতা প্রতিদিনই বিজেপি-নেতৃত্বাধীন সরকার এবং বিজেপি নিয়ন্ত্রিত আইনসভার হাতে আক্রান্ত হচ্ছে?
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ঐতিহ্য শুরু হয় এক শতকেরও বেশি সময়কাল আগে যখন নারী শ্রমিক এবং কমিউনিস্ট মতাদর্শের নারীরা তাঁদের অধিকার ও সমতার আত্মঘোষণা করেছিলেন। আজ সারা ভারতে নারী শ্রমিকরা, সরকারি প্রকল্পগুলোতে নিয়োজিত, কারখানাগুলোতে ও মাঠেঘাটে, পুরসভাগুলোতে কাজ করা নারীরা আইনি সুরক্ষাগুলোর বিলুপ্তির বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। যে দুঃসহ পরিস্থিতিতে তাঁদের কাজ করতে হয় তা ঊনবিংশ শতকের পুঁজিবাদকেই মনে পড়িয়ে দেয়। আদানি ও আম্বানীর মতো মোদীর যে স্যাঙাতরা “কোম্পানিরাজ”-এর প্রতিনিধি হয়ে রয়েছেন, তার হানাদারির হাত থেকে কৃষির রক্ষায় কৃষকদের যে আন্দোলন চলছে তার সম্মুখ সারিতে রয়েছে নারী কৃষকরা। নারীরা সিএএ আইন বিরোধী লড়াইয়েও নেতৃত্ব দিয়েছেন, যে আইন নাগরিকত্ব সম্পর্কে ধর্মনিরপেক্ষ-বিরোধী এবং গণতন্ত্র-বিরোধী এক ধারণার প্রবর্তন ঘটিয়ে ভারতীয় সংবিধানকেই ওলটপালট করে দিচ্ছে। এই উল্লেখযোগ্য আন্দোলনগুলোতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সুধা ভরদ্বাজ, সোমা সেন, সফুরা ইসরত, গুলফিসা, নাতাশা, দেবাঙ্গনা, দিশা রবি, নিকিতা জেকব ও নোদীপ কউর-এর মতো মেয়েরা; মোদী সরকার ইউএপিএ-র মতো দানবীয় আইনে তাদের জেলে পুরছে।
জলবায়ু পরিবর্তন আন্দোলনের কর্মী তরুণী গ্ৰেটা থুনবার্গের কথাগুলো সহজ করে বললে দাঁড়ায়, আন্তর্জাতিক নারী দিবসে এবং অন্য প্রতিটা দিবসে নারীরা যা চায় তা অভিবাদন বা উদযাপন নয় — বরং তা হল সমানাধিকার ও স্বাধীনতা, এবং সমানাধিকার ও স্বাধীনতা আদায়ের লক্ষ্যে ফ্যাসিবাদ ও নারীবাদী-বিরোধী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে তাদের লড়াইয়ে সমর্থন প্রদান।
(এম এল আপডেট সম্পাদকীয়, ৯ মার্চ ২০২১)