এ যাবৎ কোনো প্রধানমন্ত্রীর ব্রিগেড ভাষণে এতো কম জনসমাগম হয়নি। তাও মোদীকে বলতে শোনা গেল, জীবনে এতো বিপুল লোকসমাগম এর আগে নাকি তিনি কখনই দেখেননি। কপট আবেগে বাংলার মানুষের কাছে তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। এতোই নির্লজ্জ বেহায়া এই দলটি যে কয়েক বছর আগে ব্রিগেডে বাম দলগুলোর অভূতপূর্ব জনসমাবেশের ছবি নিজেদের ৭ তারিখের সমাবেশ বলে সামাজিক মাধ্যমে চালাবার চেষ্টা করে। তাঁদের এই জালিয়াতি ধরা পড়ে যায়, ওই ছবিতে লাল পতাকার উপস্থিতিকে ঢাকতে না পারার ফলে।
আসলে, মোদী যা বলেন, ঘোষণা করেন, নির্দ্বিধায় বলা যায়, তার বিপরীতটাই সত্য।
ঠিক যেমন, তাঁর আনা কৃষি আইন নাকি কৃষকদের মঙ্গলের জন্যই। অথচ, কৃষকরা জানেন, সেগুলো তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলবে। তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ভারতীয় সংসদের সামনে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে “গণতন্ত্রের ওই পবিত্র মন্দিরকে রক্ষা করার” প্রতিশ্রুতি দেন। আর, বিপরীতে সমস্ত গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর স্টিমরোলার চালিয়ে আজ কাশ্মীর সহ ধীরে ধীরে গোটা দেশই পরিণত হয়েছে আস্ত এক জেলখানায়। তিনি ব্রিগেডে দাঁড়িয়ে বাংলায় ‘আসল পরিবর্তনের’ স্লোগান আওড়ালেন। প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতেতে মিঠুন চক্রবর্তী ফিল্মী ডায়লগ দিয়ে আসল কথাটাই বলে দিলেন যে, তার দলটি হলো গোখরো সাপের মতো ভয়ংকর — এক ছোবলেই ছবি হয়ে যাবে যে কোনো প্রতিবাদী সত্ত্বা। বিজেপি’র সদ্য গজিয়ে ওঠা পোস্টার বয় শুভেন্দু অধিকারী খোলাখুলি জানালেন, বাংলাকে কাশ্মীর বানাবেন। আজ এই মুহূর্তে, মানবাধিকার সহ সমস্ত গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠিয়ে বিশ্বে সবচেয়ে বৃহৎ কারাগার হয়ে উঠেছে যে কাশ্মীর সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এক সাংবাদিকের পরিভাষায়, এখন চলছে গোটা দেশের কাশ্মীরীকরণ! আর, এইতো দিন কয়েক আগে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা জানালো, ভারত এখন এক ‘আংশিক স্বাধীন দেশ’।
মোদী রাজ্যবাসীকে বলেছেন, বাংলা চায় শান্তি, বাংলা চায় প্রগতি, বাংলা চায় উন্নতি। বাংলাকে নাকি তিনি সোনার বাংলা করবেন। অথচ, তাঁর আমলে দেশে চল্লিশ বছর পর অর্থনীতি গভীর মন্দার কবলে। যে এনএসএসও’র তৃতীয় ত্রৈমাসিকে ০.৪ আর্থিক বৃদ্ধিকে মোদী সরকার বিরাট এক ইতিবাচক লক্ষ্মণ হিসাবে ডুগডুগি বাজাচ্ছে, সেই এনএসএসও তাদেরই প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে যে এই সমস্ত আনুমানিক পরিসংখ্যানে বড়সড় সংশোধন করা হবে। গোটা দেশের মানুষ যখন বেলাগাম পেট্রল ডিজেল ও রান্নার গ্যাসের দাম বৃদ্ধি নিয়ে নাজেহাল, তখন ব্রিগেড ভাষণে ঘুণাক্ষরেও তার উল্লেখ করলেন না প্রধানমন্ত্রী।
নাটকীয়তার চরমে, মোদী তাঁর ৬৮ মিনিট ভাষণে কখনও গলা চড়ালেন, কখনো বা খাদে নামালেন, দু’হাতে হাজারো মুদ্রা সহযোগে। মঞ্চের একপাশে রাখা টেলিপ্রম্পটার দেখে ভাষণ দেওয়ার কারণেই মোদীকে কখনই মঞ্চের সোজাসুজি থাকা জনতার দিকে তাকিয়ে ভাষণ দিতে দেখা যায়নি। নির্লজ্জের মতো তিনি বাংলার উন্নতির প্রতিশ্রুতি দিলেন। কিন্তু, তাঁর আমলেই আর্থিক বৃদ্ধির হার ঐতিহাসিক তলানিতে। এজন্য কোভিড ১৯-র দোহাই দেওয়া চলবে না, কারণ ভারতের মতো আর কোনো দেশেরই এমন বেহাল দশা আর কোথাও হয়নি। মোদীর আমলে দেশের কর্মহীনতার হার অর্ধশতকের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে, আর, মনে রাখা দরকার তা কোভিড ১৯-র আগেই। গ্রামীণ ভারতে ভোগব্যয় সরাসরি হ্রাস পেয়েছে। তাঁর জমানাতেই ভারতের পরিসংখ্যান বিশ্বমঞ্চে সম্মানের গৌরব খুইয়ে পরিণত হয়েছে হাসির খোরাকে। ক্রমে ক্রমে তলিয়ে যাওয়া অর্থনীতির হাত ধরেছে ব্যক্তি স্বাধীনতা পরিসরের আতঙ্কজনক সংকোচন। আর এই দু’টোর ভয়ংকর মিশেল গোটা দেশকে এক গভীর বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
আশার কথা, কেন্দ্রীয় সরকারের আজ্ঞাবহ শীর্ষ আদালত দিল্লীর সীমানায় কৃষক আন্দোলনের সংহতিতে সামিল হওয়া মহিলাদের ঘরে ফিরে ঘরকন্নায় মনোনিবেশ করার পরামর্শকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে আবার দলে দলে সামিল হলেন আন্তর্জাতিক নারী দিবসে নতুন উদ্যমে। এবার, আন্দোলনরত কৃষক সংগঠন ও দেশের কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলো একযোগে শুরু করছে নানা কর্মসূচী – ১৫ মার্চ বেসরকারীকরণ বিরোধী দিবস। এখানে থেমে থাকছে না। কৃষক আন্দোলনকে নতুন রাজনৈতিক মাত্রা দিতে যে যে রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন সমাগত, সেই সেই রাজ্যে বিজেপি’র বিরুদ্ধে সর্বাত্মক রাজনৈতিক প্রচারে অবতীর্ণ হওয়ার সিদ্ধান্ত তাঁরা নিয়েছেন।
এই নতুন জাগ্রত জনমতই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আসল প্রতিষেধক। এই পথ ধরেই উপড়ে ফেলতে হবে তার বিষবৃক্ষ।
- অতনু চক্রবর্তী