একথা বুঝিয়ে বলার দরকার পড়ে না, কি দেশজুড়ে, কি এই রাজ্যে নারী সমাজের অবস্থা কি করুণ! শরীর-মনের অপুষ্টি, অভাব, অযত্ন যেন ঝলসে দিচ্ছে। নিত্যসঙ্গী হাড়ভাঙা খাটুনি। পরিবারের অন্যদের দেখভাল করার জেরে নিজের দিকে তাকানোর ফুরসতই মেলে না। বিশ্রাম মেলা ভার। তার ওপর ঘরে-বাইরে লেগেই থাকে লিঙ্গজাত বৈষম্য-পীড়ন-নিপীড়ন। অধিকার চাইলে পাওয়া যায় না, অন্তত সহজে তো নয়ই। প্রতিটা প্রশ্নে প্রয়োজন হয় পুরুষের তুলনায় বেশি লড়ে যাওয়ার। এইসব নিয়েই চলছে নারীজীবন।
সুপ্রীম কোর্টে ক্ষতিপূরণ পাওয়া না পাওয়া সংক্রান্ত এক মামলা চলাকালীন গত ৫ জানুয়ারি সংশ্লিষ্ট বিচারপতিদ্বয় মন্তব্য করেন, গৃহকর্তার অফিসে শ্রম দেওয়ার যা মূল্য গৃহকত্রীর গৃহশ্রমের মূল্য তার থেকে কিছু কম গণ্য হতে পারে না, দুটিই সম মূল্যের। বিচারপতিদের একজন আরও বলেন, ২০১১ সালের জনগণনা রিপোর্টে প্রকাশ হয়ে গিয়েছিল ভারতে ১৫৯.৮৫ মিলিয়ন মহিলার কাছে গৃহশ্রমই মুখ্য জীবিকা, যেখানে তুলনায় পুরুষদের মুখ্য শ্রম হিসাবে গৃহশ্রমে থাকার সংখ্যাটি বহু পিছনে, ৫.৭৯ মিলিয়ন। ‘টাইম ইউজ ইন ইন্ডিয়া-২০১৯’ শীর্ষক সাম্প্রতিক এক তথ্য পরিসংখ্যান রিপোর্টে আরও জানা যায়, গড়ে একজন মহিলা গোটা দিনে গৃহস্থালী কাজের জন্য বিনা মূল্যে পরিষেবা দিয়ে থাকেন ২৯৯ মিনিট, আর গড়ে একজন পুরুষ সারা দিনের মধ্যে একই কাজে সময় দেন ৯৭ মিনিট মাত্র। একইরকমভাবে পরিবারের মহিলারা অন্যান্য সদস্যদের দেখভাল করতেই বিনা মূল্যে সময় ব্যয় করেন যেখানে দিনে ১৩৪ মিনিট, সেখানে তুলনায় পুরুষেরা সময় দিয়ে থাকেন গড়ে ৭৬ মিনিট। শতাংশের বিচারে মহিলাদের দিনপ্রতি উপরোক্ত দু’ধরনের বিনা পারিশ্রমিকে শ্রমসময় দেওয়ার চিত্রটি যেখানে যথাক্রমে ১৬.৯ ও ২.৬, সেখানে পুরুষ প্রদত্ত সংশ্লিষ্ট শ্রম সময়ের ভাগটি হল যথাক্রমে ১.৭ ও ০.৮ মাত্র। এই তথ্য পরিসংখ্যানই দেখিয়ে দেয় গৃহশ্রমে ও বিশেষ করে পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য বিনা পারিশ্রমিকে শ্রমসময় ব্যয় করার ক্ষেত্রে লিঙ্গজাত প্রভেদ কত প্রকট ও ব্যাপক।
অন্যদিকে ঘরের বাইরের জগতে কর্মক্ষেত্রের ক্ষেত্রে? কর্মসংস্থানের প্রশ্নে? বলাবাহুল্য সেখানেও লিঙ্গগত বৈষম্যই প্রধান প্রবণতা। আর, ২০২০-র অতিমারী ও লকডাউনজাত কাজ উধাও হয়ে যাওয়া বা কাজ থেকে বসিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাও হয়েছে একইরকম। পুরুষ কর্মীদের তুলনায় মহিলা কর্মীদের কাজ থেকে ছেঁটে দেওয়া হয় ৫ গুণ বেশি! লক ডাউনে কর্মহীন হয়ে যাওয়া মহিলারা স্বনিযুক্তি শ্রমের উপায়ও বিশেষ কিছু পাননি। স্বনিযুক্তির বন্দোবস্ত করে উঠতে পেরেছিলেন স্থায়ী বেতনের কর্মীদের মাত্র ২ শতাংশ, অস্থায়ী বেতন কর্মীদের মাত্র ১০ শতাংশ, আর দিনমজুর মহিলাদের মাত্র ২১ শতাংশ। এমনকি অতিমারী অবস্থায় চলে যাওয়া কাজ ফেরত পাওয়ার প্রশ্নেও মহিলা কর্মীদের “না” করে দেওয়া হয়েছে পুরুষ কর্মীদের তুলনায় অনেক বেশি, ১১ গুণ! কর্মক্ষম মাত্র যে ১০ শতাংশ মহিলা কাজ পেয়েছিলেন প্রাক অতিমারীপর্বে, লক ডাউন উঠে গেলে কাজ ফিরে পেয়েছেন তার মাত্র ৫৩ শতাংশ, প্রায় অর্ধেকাংশই কাজ ফিরে পাননি। এই কাজ হারাদের মধ্যে রয়েছেন দিন মজুর, ঠিকা চুক্তির, অস্থায়ী, স্থায়ী, বেতনভোগী, বড় অঙ্কের বেতনপ্রাপ্ত, নিরক্ষর, সাক্ষর, সাধারণ শিক্ষিত, মধ্যমেধার ও উচ্চ শিক্ষিত তথা সব বর্গের মহিলা শ্রমজীবী। এত ব্যাপক অংশেরও বেশি গুণ কাজ ছাঁটাইয়ের অর্থ হল, তাদের আবার পরিবারে বিনা পারিশ্রমিকে আরও বেশি শ্রমসময় দিতে ঘরে ঢুকে থাকতে বাধ্য করা। শ্রমের বাজার থেকে উৎখাত হয়ে বিজেপির ভাষায় শ্রমসেবা দানে ‘সুশীলা গৃহলক্ষী’ হয়ে থাকতে বাধ্য হওয়া।
উপরোক্ত তথ্য প্রকাশ করেছেন আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী-পুরুষ সমন্বয়ে তিন সদস্যের এক গবেষক টিম। ভারতে শ্রমের বাজারে অতিমারী উত্তর পরিস্থিতিতে লিঙ্গগত কি পড়ছে সেটাই ছিল তাঁদের গবেষণাপত্রের বিষয়। তাঁরা কাজ করেছেন সিএমআইই-সিপিএইচএস-এর প্রাক লকডাউন (ডিসেম্বর ২০১৯-জানুয়ারি ২০২০), লক ডাউন (এপ্রিল-মে ২০২০) ও লক ডাউন উত্তর (অগাস্ট-সেপ্টেম্বর ২০২০) — এই তিনটি পর্বের তথ্য নিয়ে। এই গবেষণা ফলচিত্রের অনুরূপ পরিণাম পশ্চিমবঙ্গের পটভূমিতেও মেলে।
সামনে রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন। এই নির্বাচনে রাজ্যের কাজ হারানো মহিলাদের কাজে ফেরানো ও নতুন মহিলা কর্মপ্রার্থীদের কর্মসংস্থানের অধিকার বা দাবি এক জ্বলন্ত বিষয়। তাই এ বিষয়ে কেন্দ্রের ও রাজ্যের শাসকপক্ষ কে কি এপর্যন্ত করেছে তার হিসাব মাথায় রাখতে হবে। সেইমতো উচিত শিক্ষা দিতে সমানাধিকারের চেতনায় জোট বাঁধতে হবে। পশ্চিমবঙ্গে ৭ কোটি ২০ লক্ষ নির্বাচক জনতার ৪৯ শতাংশ মহিলা। কিন্তু মহিলাদের কাজের ও তথা সমকাজে সমমজুরির অধিকার কেবল মাত্র মহিলাদের ইস্যু নয়, এটা সমাজের সমস্ত সংবেদনশীল জনমানুষেরই সোচ্চার হওয়ার বিষয়। তাই ব্যাপকতম নির্বাচকমন্ডলীকেও তিক্ত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পরিস্কার বুঝে নিতে হবে। কোন সরকার — কোন রাজনৈতিক দলের নীতিগুচ্ছ নারী কর্মশক্তির কর্মসংস্থানের বিষয়ে সবচেয়ে ব্যর্থ, অপদার্থ, নিস্পৃহ, উদাসীন, বিরোধী? সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত সত্য, কর্পোরেট পুঁজি এবং আরএসএস দোসর বিজেপি হচ্ছে সমস্ত দিক থেকে নারী বিরোধী। তাই আসন্ন নির্বাচনে বিজেপিকেই সবচেয়ে উচিত শিক্ষা বুঝিয়ে দেওয়া দরকার।