দিল্লী সীমান্তে কৃষকদের ঐতিহাসিক অবস্থান আন্দোলন ১০০ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার (এআইকেএসসিসি) সর্বভারতীয় নেতৃত্ব আন্দোলনের বার্তাকে সরাসরি পশ্চিমবাংলা সহ পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে পৌঁছে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। এই লক্ষ্যে সর্বপ্রথম কলকাতার রামলীলা পার্কে ১২ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় পশ্চিমবঙ্গ কৃষক-মজুর মহাপঞ্চায়েত। মহাপঞ্চায়েত অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে সর্বভারতীয় কৃষক নেতারা কলকাতা প্রেস ক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলন করার পর সেখান থেকে রামলীলা পার্ক পর্যন্ত এক মহামিছিলের আয়োজন করেন। এই মিছিলের পুরোভাগে ছিল একাধিক ট্রাক্টর-যেগুলির সওয়ার হয়েছিলেন সুদূর পাঞ্জাবের লায়ালপুর থেকে আগত কৃষক নারী-পুরুষ, এমনকি শিশুরাও। এ ছিল মহানগরী কলকাতায় এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। আর এই মিছিলে দক্ষিণ বাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে আসা কৃষিজীবী মানুষের সঙ্গে সঙ্গে সামিল হয়েছিলেন ছাত্র-যুব, নাগরিক সমাজ। লাল ঝান্ডার পাশাপাশি হলুদ ও সবুজ ঝান্ডার এই বর্ণময় মিছিলের আর এক অবিষ্মরণীয় দিক ছিল কলকাতার স্থানীয় পাঞ্জাবী জনগণের বিশেষত শিখদের বড় আকারে অংশ গ্রহণ। বলতে কি, শিখ সম্প্রদায়ের মানুষেরা ১৯৮৪ সালের পর এইদিন আরও একবার কলকাতার জনজীবনে নজর টানলেন। ১৯৮৪-তে নজরে এসেছিল তাঁদের অশ্রুসজল, ভয়ার্ত মুখ আর এবার নজরে এসেছিল তাঁদের খুশীতে উজ্জ্বল মুখগুলি — যা বলছিল, ‘আমরাই পারি। অন্নদাতা কৃষকদের সামনে থেকে আমরাই পেরেছি মোদি সরকারকে হেলিয়ে দিতে।’
কৃষক-মজুর মহাপঞ্চায়েতের মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন বলবীর সিং রাজওয়াল, যোগেন্দ্র যাদব, গুরনাম সিং চাডুনি, মেধা পাটকর, রাজারাম সিং, অতুল অঞ্জন, ডঃ সুনীলম, সত্যবান, হিমাংশু তেওয়ারি, হান্নান মোল্লা প্রমুখ সুখ্যাত কৃষক নেতারা। সভার শুরুতেই বাবুনি মজুমদারের উদাত্ত কণ্ঠে গান, ‘মরা গাঙে তোলরে তুফান কিষাণ জোয়ারে’ — মহাপঞ্চায়েতের চমৎকার আবহ গড়ে দেয়। সভা পরিচালনা করেন কার্তিক পাল, অমল হালদার ও অভিক সাহা। সভার প্রারম্ভিক বক্তা ছিলেন বলবীর সিং রাজওয়াল। তিনি তাঁর দীর্ঘ ভাষণে তিন কৃষি আইনের সর্বনাশা দিকগুলি বিস্তারে ব্যাখ্যা করার সাথে সাথে দিল্লী সীমান্তে লাগাতার অবস্থানের সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন এবং মোদি সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণা প্রকাশ করেন। শ্রী রাজওয়ালের সাথে সাথে প্রত্যেক বক্তাই জানিয়ে দেন, তাঁরা শুধু সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলনের বার্তা শোনাতেই এরাজ্যে আসেননি, তাঁরা এসেছেন এরাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে কৃষক বিরোধী বিজেপিকে চূড়ান্তভাবে পরাস্ত করার আহ্বান জানাতে। মেধা পাটকর তাঁর সাবলীল কণ্ঠে আওয়াজ তোলেন, ‘খেতি বাঁচাও, দেশ বাঁচাও।’ হান্নান মোল্লা বলেন, ‘মোদি-অমিত শাহেরা বলছেন, এই আন্দোলন নাকি শুধু পাঞ্জাবীদের আন্দোলন। তাহলে দেশের ৬০০টি স্থানে ‘রেল রোকো’ হল কীভাবে?” তিনি উল্লেখ করেন, এ রাজ্যেও কৃষকরা ফসলের সরকার ঘোষিত দাম পান না। রাজারাম সিং বলেন, ‘চুক্তি চাষ ব্যাপক হারে চালু হলে কার্যত কোম্পানিরাজ কায়েম হবে যেখানে বর্গাদাররাও চাষের অধিকার হারাবেন। এমএসপি-র গ্যারান্টি না থাকায় ভবিষ্যতে সরকার ফসল না কিনলে খেতমজুর ও দরিদ্র মানুষরা আর রেশন পাবেন না।’
মহাপঞ্চায়েতের মঞ্চ থেকে নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুরেও এই ধরনের মহাপঞ্চায়েত সংগঠিত করার ঘোষণা করা হয়েছে। স্পষ্টতই কৃষক-মজুদের এই মহাপঞ্চায়েত বিজেপির বঙ্গ বিজয়ের পথে এক রাশ কাঁটা বিছিয়ে দিয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কৃষক নেতারা এরপর আসাম, উরিষ্যা, কর্নাটক প্রভৃতি রাজ্যগুলিতেও সফর করবেন এবং অন্নদাতা কৃষকদের স্বার্থে বিজেপিকে সর্বতোভাবে রুখে দেওয়ার বার্তা দেবেন।