ডবল ইঞ্জিনের সরকার লোপাট করে রোজগার
government eliminates income

ত্রিপুরা ও বিহার

বাংলার দুই প্রতিবেশী রাজ্যের দিকে চোখ ফেরানো যাক। দু’টোই বিজেপি শাসিত। চলছে ডবল ইঞ্জিনের সরকার। বিহারে এনডিএ ক্ষমতায় আসলে নাছোড় বেকারত্বের সমস্যা সমাধান করার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল নীতিশ-বিজেপি জোটের। এদিকে, সেন্টার ফর মনিটারিং অফ ইন্ডিয়ান ইকনমি জানাচ্ছে, ফেব্রুয়ারি ২০১৯ থেকে এখন পর্যন্ত বিহারে বেকারত্বের হার ১০ শতাংশের ও বেশি — এতো দীর্ঘ সময় ধরে বিহার রাজ্য এর আগে কোনোদিন এরকম সুউচ্চ  বেকারত্বের হার আগে কখনও দেখেনি। এর সঙ্গে যুক্ত হলো এক মর্মান্তিক ঘটনা। লকডাউন পরবর্তী সময়ে তীব্র আর্থিক সংকটে বেসামাল ও জর্জরিত ৫ জনের একটা গোটা পরিবার একসাথে আত্মহত্যা করলো বিহারের সাপৌল জেলার এক গ্রামে। আর, এই ঘটনা সামনে আসতেই আবার নতুন করে লকডাউন পরবর্তী চূড়ান্ত দুর্দশার একের পর উদাহরণগুলো সামনে চলে আসছে।

পাশ্ববর্তী রাজ্য ত্রিপুরা। বিরোধী দলগুলোর উপর স্টিমরোলার চালিয়ে যে কোনো প্রতিবাদী কন্ঠস্বরকে স্তব্ধ করার পাশাপাশি এবার সেখানে শুরু হয়েছে সরকারি স্থায়ী চাকরি লোপাটের রাষ্ট্রীয় অভিযান। ত্রিপুরার রাজ্য সরকার এবার সরকারি ক্ষেত্রে কর্মী নিয়োগের দায়িত্ব তুলে দিল বেসরকারি সংস্থার হাতে। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ত্রিপুরা রাজ্য সরকারের ডাইরেক্টরেট অফ এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিসেস অ্যান্ড ম্যানপাওয়ার প্ল্যানিং এক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে নানা ধরনের কাজে কর্মী নিয়োগের জন্য বেসরকারি সংস্থার কাছে আবেদন করেছে। পাঁচটি বেসরকারি সংস্থার সাথে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী একটা চুক্তি করেছেন, যারা গ্রুপ-ডি থেকে শুরু করে উচ্চতর স্তরে আধিকারিক পর্যায়ে ও সমস্ত ধরনের কর্মী নিয়োগ করবে। এমনকি, ত্রিপুরা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় যারা যারা সফল হয়েছেন, তাঁদের নামের তালিকা ও ওই বেসরকারি সংস্থার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। উল্লিখিত সরকারি দপ্তরের ডিরেক্টর জানিয়েছেন, ওই বেসরকারি এজেন্সিগুলো যতজনকে নিয়োগ করবে, সেই সংখ্যা ও বেতনের উপর রাজ্য সরকার তাদের মাসিক কমিশন দেবে।

এর আগে জানুয়ারি মাসে, রাজ্য শিক্ষামন্ত্রী রতন লাল নাথ বলেছিলেন, তাঁদের সরকার মোট ৬,৯৩৯ জনকে সরকারি চাকরি দিয়েছে, যার মধ্যে ২,৭৩৩ জন পান স্থায়ী চাকরি, ২,২৫০ জনকে নিয়োগ করা হয় ঠিকা কর্মী হিসাবে আর ১,৯৫৬টি সরকারি কাজ বাইরে আউট সোর্স করে দেওয়া হয়। শিক্ষামন্ত্রীর এই ঘোষণা নসাৎ করে দেয় খোদ মুখ্যমন্ত্রীর দাবি — তিনি তার ঠিক একমাস আগে, ২০২০-র ডিসেম্বরে বলেন যে তাঁর ৩২ মাসের সরকার ২৩ হাজার জনকে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ করে। ত্রিপুরার মতো এক শিল্পহীন রাজ্যে যুবসমাজ নির্ভর করে রয়েছেন সরকারি চাকরির উপর। শেষ সম্বলটাও এবার তুলে দিয়ে যুব সমাজের ভবিষ্যৎকে গভীর অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত করলো ত্রিপুরার বিজেপির সরকার।

মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে দেশব্যাপী এক অভূতপূর্ব “ডিজিটাল বিদ্রোহ” আছড়ে পড়তে দেখা গেল। বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে কর্মী নিয়োগের জন্য যে স্টাফ সিলেকশন কমিশনের পরীক্ষা হয়, তার ফলাফল বেরোনোর পর পরই একটা টুইটার ঝড় কাঁপিয়ে তোলে সামাজিক মাধ্যমকে। যুব সমাজকে কাজের সুযোগ দিতে অক্ষম কেন্দ্রীয় সরকার #মোদী জব দো বা #মোদী রোজগার দো এই মর্মে এক ঝড় বয়ে যায় যা কার্যত ছিল এক বিদ্রোহ।

স্টাফ সিলেকশন কমিশন হচ্ছে দেশের মধ্যে অন্যতম খুবই প্রতিযোগিতা মূলক এক পরীক্ষা, যা দেবার জন্য ফি বছর লক্ষ লক্ষ আবেদন পত্র জমা পড়ে, কিন্তু দিনের পর দিন এই সরকারি ক্ষেত্রেও চাকরির সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে মারাত্মক হারে। ২০১৪ সালে যে সরকারি শূন্য পদের সংখ্যা ছিল ১৫,৫০০ মোদী আসার পর তা সংকুচিত হয়ে দাঁড়িয়েছে ৮,৫০০-তে। পাশাপাশি বেড়েছে এই পরীক্ষাকে ঘিরে নানা কেলেঙ্কারি, সময়মতো পরীক্ষার ফল না প্রকাশ করা, ভুলভাল গ্রেডিং  ইত্যাদির মতো নানা ঝুড়ি ঝুড়ি অভিযোগ।

এ প্রশ্নে এখন আর কোনো বিতর্ক নেই যে মোদীর জমানায় ভারতে আজ কর্মহীনতা পৌঁছেছে আতঙ্কজনক এক অবস্থায়। সিএমআইই-র রিপোর্ট অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে তা ৭ শতাংশ হারকেও টপকে গেছে। দেশের মোট কর্মসংস্থানের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের দপ্তরগুলো সাকুল্যে ১৪ শতাংশ কর্মসংস্থান জুগিয়েছে। বাদ বাকি জোগায় রাজ্য সরকারগুলো। মূলত গণনিরাপত্তা ও সামাজিক সুরক্ষা সংক্রান্ত কাজগুলোর সঙ্গেই তা যুক্ত রয়েছে। রাজ্য সরকারগুলোর ক্ষেত্রে মোট শূন্যপদের সংখ্যা হচ্ছে ৩৮.৮ লক্ষ, তাও এটা ২০১৪ সালের পরিসংখ্যান। তারপর থেকে লাগাতারভাবে শূন্যপদের সংখ্যা বেড়েছে, অবলুপ্ত হয়েছে বিপুল পরিমানে সরকারি পদ। এখনো পর্যন্ত সরকার (তা রাজ্যই হোক বা কেন্দ্র) শূন্য পদগুলো পূরণ করার পদক্ষেপ নিলে বেশ কিছু যুব চাকরি পেতো। “ওয়াই পাব্লিক এমপ্লয়মেন্ট ইজ ক্রুসিয়াল ফর অ্যা হেলথি ইকিউটিবল সোসাইটি’’ প্রবন্ধে অর্থনীতিবিদ জয়তী ঘোষ উল্লিখিত তথ্য দিয়ে দেখিয়েছেন ভারতে সরকারি কর্মসংস্থানের কাঠামোটাই ভারসাম্যহীন ও গলদে ভরা। ২০১৭-১৮-র মধ্যে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোতে কর্মসংস্থান ২.২ লক্ষ হ্রাস প্রাপ্ত হয়, আর এই কর্মী হ্রাসের সবচেয়ে বড় কোপ পড়েছে সাধারণ কর্মীদের উপর, উপরতলার ম্যানেজার বা সুপারভাইজার পদের সাথে যুক্ত কর্মীরা নন। এটাও দেখা যাচ্ছে, সমস্ত কেন্দ্রীয় সরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় কন্ট্রাক্ট/ক্যাজুয়াল, দিন মজুরের সংখ্যা বেড়েছে হুহু করে। ২০১৭-১৮ সালের মধ্যে এই অনেক কম মজুরির ভিত্তিতে কর্মরত অ সুরক্ষিত, অনিশ্চিত ধরনের কর্মীর সংখ্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে মোট কর্মীবাহিনীর এক তৃতীয়াংশের ও বেশি। একটা ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যাক। আইসিডিএস-র অধীনে কর্মরত মোট ১২.৯ লক্ষ অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও ১১.৬ লক্ষ অঙ্গনওয়াড়ি হেল্পার কেন্দ্রীয় সরকারি প্রকল্প ও সংস্থায় কর্মরত মোট কর্মীর তুলনায় ৬০ শতাংশ। এই বিপুল সংখ্যক অসুরক্ষিত অনিয়মিত কর্মীরাই সরকারি সংস্থার সিংহভাগ অংশ। যারা দিনের পর দিন, বছরের পর বছর সরকারি কর্মীদের সমান সুযোগ সুবিধা থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত হয়ে পরিষেবা দিয়ে চলেছেন কোনো রকম সরকারি স্বীকৃতি ছাড়াই।

সিএমআইই আরেকটা তথ্য দিয়ে দেখিয়েছে, বর্তমান ভারতে ৪৮ শতাংশ শহুরে যুবক, যাদের বয়স ২০ থেকে ২৪-র মধ্যে, তারা কর্মহীন। আর, ২৫ শতাংশ স্নাতক কাজ পাচ্ছেন না। অর্থাৎ মোদীর ভারতে যে যতবেশি শিক্ষিত, সে ঠিক ততটাই বেকার হয়ে পড়ছেন।

কাজ, রোজগার দেওয়া তো দূরে থাক, ডবল ইঞ্জিনের সরকার, মোদীর কেন্দ্রীয় সরকার কেড়ে নিচ্ছে কাজ, চাকুরির সমস্ত সুযোগ, যা এতোদিন কোনক্রমে বেঁচে বর্তে ছিল। আগামী চার বছরের মধ্যে আরও ১০০ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে বেসরকারি ক্ষেত্রের হাতে তুলে দিয়ে, গোটা দেশকেই হাতে গোনা কয়েকজন সাঙ্গ্যাতের কাছে সঁপে দেওয়ার অভিযানে নেমেছে মোদী সরকার। আর, এই নির্লজ্জ বেহায়া বিজেপি সোনার বাংলা বানানোর আষাঢ়ে গপ্পো ও বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করার কথা বলে রাজ্য দখল করার ষড়যন্ত্রে নেমেছে। এর বিরুদ্ধে রাজ্যবাসীকে সতর্ক থাকতে হবে।

- অতনু চক্রবর্তী  

খণ্ড-28
সংখ্যা-10