শুরু হতে চলেছে দু’মাস ব্যাপী আট দফায় রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন। এক কথায় দীর্ঘতম নির্বাচন প্রক্রিয়া। স্বাধীনতার পরে এমন দুর্যোগপূর্ণ নির্বাচনের পরিস্থিতি বোধহয় আর আসেনি। সরকার পরিবর্তনের আভাস থাকা নির্বাচনের কতিপয় নজির এ রাজ্যের ইতিহাসে আছে। যেমন, ১৯৬৭, ১৯৭৭ ও ২০১১-র নির্বাচন; যে নির্বাচনগুলোতে ফলাফল প্রকাশের আগে থাকতেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল মানুষ কি চাইছে, গণরায় কি হতে যাচ্ছে। বিপরীতে, ১৯৭২-এর নির্বাচনেও পরিণাম প্রকট ভাবে উন্মোচিত হয়েছিল ফলাফল প্রকাশের অনেক আগে থাকতেই, যদিও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ তা চায়নি। তেমনি এবারের বিধানসভা নির্বাচনে বাংলার দখল নিতে আগ্রাসী হয়েছে এমন এক রাজনৈতিক দল যাকে সুগভীর বিবেচনাবোধে কিছুতেই বরদাস্ত করা যায় না। হ্যাঁ, বিজেপি হচ্ছে সেই শক্তি যার পেছনে রয়েছে আরএসএস, যার জনমোহিনী মায়া বিস্তারের জন্য গুচ্ছ গুচ্ছ বিজ্ঞাপনী প্রতিশ্রুতি থাকতে পারে, কিন্তু তার অবলম্বন হল বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতি, চূড়ান্ত লক্ষ্য হল কর্পোরেট রাজ ও হিন্দু রাষ্ট্র তৈরি করা। বিজেপি বলছে, পশ্চিমবাংলার মানুষজন একবার সুযোগ দিক, পাঁচবছরে ‘সোনার বাংলা’ বানিয়ে দেবে। বিপরীতে বুঝতে হবে, মানুষকে বোকা বানানোর সুযোগ ওদের দেওয়া যায় না।
১৯৯১ সালে কেন্দ্রের নরসীমা রাও সরকারের আমলে নয়া অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণের সময় আদবানি বলেছিলেন, আমাদের পছন্দের নয়া উদারবাদী নীতি কংগ্রেস চালু করে দিল। তারপর গত তিন দশকে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে একাধিক রাজ্যে। তার প্রতিটি শাসিত রাজ্যকে কেমন ‘সোনা’য় মুড়ে দিয়েছে তা ভুলে গেলে চলবে না। সর্বোপরি, সাত বছর চলছে কেন্দ্রে মোদী শাসনের দুর্ভোগ। সরকারী দায়-দায়িত্ব সব ছেঁটে ফেলা হচ্ছে। রাজস্বের সিংহভাগ কেন্দ্রের কব্জায়, অথচ তার বিনিয়োগের ব্যাপারে ক্রমশ হাত গুটিয়ে ফেলা হচ্ছে, নয়ত আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে মিথ্যাচারের। গোটা অর্থনীতিতে এখন কর্পোরেট ক্ষমতার দাপট। ক্রমশ কেড়ে নেওয়া হচ্ছে অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বাসস্থান-কর্মসংস্থানের অধিকার এবং তার সাথে নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা-গণতন্ত্র ও মানবাধিকার। একদিকে ক্ষুধার বিশ্বসূচকে ভারতের স্থান নেমেই চলেছে, অন্যদিকে অতিমারী পরিস্থিতিতেও ধনকুবের বৃদ্ধির হারে বিশ্বকে ছাপিয়ে যাচ্ছে ভারত। প্রশ্ন হল, এহেন উৎকট ‘উন্নয়ন’-এ জনস্বার্থের স্থান কোথায়? সবই তো কর্পোরেট সর্বস্ব। তাহলে, এই পরিণতির জন্য দায়ি যে বিজেপি তাদের আবার বাংলার দখল পেতে সুযোগ দেওয়া হবে কেন?
১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দিয়ে সংবিধান স্বীকৃত ধর্মনিরপেক্ষতার বনিয়াদ ধূলিসাৎ করার সূচনা করেছিল বিজেপি। এই অপরাধকে খোলাখুলি মদত জুগিয়েছিল বিজেপির তদানীন্তন উত্তরপ্রদেশ সরকার। তারপর থেকে তার রাজ্যে রাজ্যে ক্ষমতা দখল, কেন্দ্র দখলের জোরে তীব্র ও ব্যাপক আকার ধারণ করেছে একদিকে সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদী রাজনৈতিক-সামাজিক সন্ত্রাস-হিংসা; অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন। গুজরাটে এই শতকের গোড়ায় মোদী সরকার ক্ষমতায় এসেছিল দু’সহস্রাধিক সংখ্যালঘু জনতার গণহত্যার পথ বেয়ে। টানা বিজেপি শাসিত গুজরাটে মুসলিম ও দলিতদের দিন কাটে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে। উত্তরপ্রদেশের যোগীরাজ সরকার হল এক কথায় সব দিক থেকে সবচেয়ে নৃশংসতার নজির। যে রাজ্যে মুসলিম-দলিত ও নারী সমাজের কোন স্বাধীনতা কার্যত স্বীকার করা হয় না, চালু হচ্ছে একের পর এক ফতোয়ার ‘অনুশাসন’। মধ্যপ্রদেশে বিজেপি শাসন কলঙ্কিত হয় একবার মেডিক্যাল কলেজে দুর্নীতিতে, এমনকি তার সমস্ত সাক্ষী লোপাটে কাশ্মীর-কায়দায় গণ নিখোঁজ (গুম) করণের অভিযান চালিয়ে; পরের বার কংগ্রেসী বিধায়ক ভাঙিয়ে ক্ষমতা দখল করে। আসামে আবার এসেছে নির্বাচন, বিগত বিজেপি শাসন এনআরসি-র নামে ঊনিশ লক্ষাধিক নাগরিককে বেনাগরিক করে ফেলে রেখেছে বন্দীশিবিরে। ত্রিপুরায় বিজেপি সরকার উঠিয়ে দিচ্ছে সরকারী চাকরি, পেনশন। আর, কেন্দ্রের মোদী শাসন তো সর্দারিতে ‘সেরার সেরা’। শ্রমিক-কৃষক বিরোধী, পরিযায়ী শ্রমিক বিমুখ, শিক্ষা-স্বাস্থ্য বিমুখ, গণতন্ত্র ও সংবিধান বিরোধী নানা কৃতকর্মের অপরাধে অপরাধী।
এতকিছু দেখার পর ঠেকে শেখার কোনো মানে হয় না। মতাদর্শ ও রাজনীতির বিচারে প্রধান এই আগ্রাসী প্রতিপক্ষকে কোনোভাবেই গৌণ বা লঘু করে দেখার দুর্বলতা দেখানো যায় না। সেটা হবে চরম নির্বুদ্ধিতা, কান্ডজ্ঞান লোপ পাওয়ার মতই। শাসকশ্রেণীর বাকি কোনও অংশের সঙ্গে বিজেপির কোনো তুলনা হয় না। কোনও শাসনের বিকল্প ফ্যাসিবাদী বিজেপিকে হতে দেওয়া যায় না। বরং বাংলার নির্বাচনে বিজেপিকে রুখে দিতে হবে। তার মধ্য দিয়ে বাকি ভারতেও এক নতুন বার্তা দেওয়া যাবে।