মানুষের মতামত শোনা হবে বলে রাজ্যের সমস্ত বিধানসভা কেন্দ্রে রথ ঘোরানোর কর্মসূচী নিয়েছিল বিজেপি। প্রতিটি রথে থাকার কথা ছিল একশটি করে ড্রপ বক্স! মোট প্রায় ত্রিশ হাজার বাক্স। লক্ষ্যমাত্রা নাকি দু’কোটি লোকের মত নেওয়া! নির্বাচনী ইস্তাহার তৈরির নামে। শুনে অবাক লাগারই কথা! কারণ কর্পোরেটমুখী সাম্প্রায়িক মুখের বিজেপি কবে আর মানুষের অভাব, অভিযোগ, দাবি বা মনের কথা শুনতে চেয়েছে! বরং পরিহাসের ব্যাপার হল, উল্টোটাই সত্য। শোনানো হয় কেবল প্রধানমন্ত্রী মোদী’র ‘মন কী বাত’। প্রশ্ন হল, মত শোনার রথ পরিক্রমা কি সারা হয়েছে? বাক্স কি আদৌ ছিল? সংখ্যায় কত? কি কি বিষয়ে জিজ্ঞাসা, অভিমত জমা পড়েছে? কর্মসংস্থানের প্রসঙ্গ কি উত্থাপিত হয়েছ?। কারণ, প্রশ্নটা একদিকে ভীষণ জ্বলন্ত, অন্যদিকে তার প্রত্যুত্তর দেওয়ার প্রশ্নে রাজ্যের মমতা সরকারের যাইই ব্যর্থতা থাক, কেন্দ্রের মোদী সরকারের ভূমিকা ভয়ঙ্কর প্রতারণামূলক। কারণ, ২০১৪-তে ক্ষমতায় আসার পরপরেই বছরে দু’কোটি হাতে কাজ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ধরা পড়ে গিয়েছিল। অমিত শাহ নিজেই পরে প্রশ্নের চাপের মুখে বলেছিলেন, ওটা ছিল ‘জুমলা’, মানে নির্বাচনী ইস্তাহারে নিছক বলার জন্য বলা। মোদী উপরন্তু করেছিলেন আরও ঠাট্টাতামাশা, বলেছিলেন — নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে পকোড়া ভাজার দোকান খোলায়! ২০১৯-এ ফের ক্ষমতায় আসার পর থেকে মোদী সরকার এ নিয়ে আর কোনও উচ্চবাচ্য করেনি। বরং বলতে শুরু করে, এমন ‘নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি’ প্রণয়ন করা হচ্ছে, যাতে কর্মসংস্থানের জন্য যুবশক্তি নিজেদের কাজের ব্যবস্থা নিজেরা করে নেবে, সরকারের ওপর নির্ভর হয়ে থাকতে হবে না। এভাবে কর্মসংস্থানের রাষ্ট্রীয় দায়দায়িত্ব অস্বীকারের বজ্জাতি চালিয়ে আসা হচ্ছে।
এখন পশ্চিমবাংলার নির্বাচনী পরিস্থিতির মুখে বিজেপি পড়েছে খুব মুশকিলে। মোদী সরকার খুব কয়লা চোর ধরার ধূয়ো তুলে সিবিআই হানা চালাচ্ছে। বুঝতে অসুবিধা হয়না স্রেফ বিজেপিকে সুবিধা পাইয়ে দিতে। অন্যদিকে খোদ কোল ইন্ডিয়াকে বেচে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শুধু তাই নয়, ছোটবড় মিলিয়ে প্রায় একশটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিক্রি করে দেওয়ার মতলব এঁটেছে। বেচে দেওয়া হবে ‘সেল’-রেল-ব্যাঙ্ক-বীমা-বিএসএনএল-এর হেফাজতে থাকা জমিজমা। কেন্দ্র কর্মসংস্থান করার ভাবনার ধারে-কাছে নেই। উল্টে ফন্দি আঁটছে উপরোক্ত সংস্থাগুলোর মোট প্রায় দু’হাজার একর জমি বেচে দেওয়ার। সরকারের লক্ষ্য কোষাগারে প্রায় আড়াই লক্ষ কোটি টাকা তোলা। সব কর্পোরেট পুঁজির কাছে দেওয়া।
গত বছরে অতিমারী পরিস্থিতিতে পর্যায় ভিত্তিক শ্রম সমীক্ষায় ধরা পড়ে লক ডাউনের পরিণামে যথেষ্ট বেড়ে যায় শহরাঞ্চলের বেকারির তীব্রতা। ২০১৯-র অক্টোবর-ডিসেম্বর ত্রৈমাসিকে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বেকারি ছিল ৭.৯ শতাংশ। ২০২০-র জানুয়ারি-মার্চে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯.১ শতাংশ। আর তার পরের এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকে বেকারি পৌঁছে যায় ২০.৯ শতাংশে! মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে ছেয়ে যায় প্রায় তিনগুণ বেকারি বৃদ্ধিতে। সব বয়সী বেকাররাই এর শিকার হন। বিশেষ করে ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী বেকারির হার ছিল ৩৪.৭ শতাংশ। এপ্রিল-জুন পর্যায়ে বেকারি বৃদ্ধির প্রথম তিন স্থানে ছিল মহারাষ্ট্র, ঝাড়খন্ড ও মধ্যপ্রদেশ; যথাক্রমে ৩৫.৬, ৩২ ও ২৮.৯ শতাংশ। কোনও রাজ্য ১০ শতাংশের নীচে থাকেনি। পশ্চিমবঙ্গেও এই সমস্যা পৌঁছায় বেশ চড়া মাত্রায়। বিশেষ করে পরিযায়ী শ্রমিকদের এক উল্লেখযোগ্য অংশ রাজ্যে ফিরে আসে, কাজ হারিয়ে, মজুরি না পেয়ে, বিপর্যস্ত হয়ে; ঘরে ফিরেও সেই একই দূর্ভোগ, পোহাতে হয় জীবিকার উপায় না মেলা জীবন। লক-ডাউন উঠে যাওয়ার পরেও অবস্থার কোনও গুণগত পুনরুজ্জীবন হয়নি। সঙ্গত অধিকার, সুরক্ষা ও মর্যাদা সম্পন্ন কাজের সুযোগ বা পরিবেশ ফিরে পাওয়ার প্রবাহ শতাংশের বিচারে এখনও হতাশাব্যঞ্জক। এই পরিণতির দায় অস্বীকার করতে পারেনা রাজ্য সরকার। তবে সবচেয়ে দায়ী কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। লক ডাউন পর্বে কেন্দ্র বিমুখ ছিল কাজ হারানো শ্রমজীবীদের প্রতি, বিশেষ করে পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি।
সেই বিজেপি এখন এরাজ্যে ক্ষমতা দখলের জন্য মরীয়া, তাই যা বিশ্বাসযোগ্য নয় তাও বলছে। মিথ্যাচার ও ছলনার আশ্রয় নিচ্ছে। বলছে ক্ষমতায় আনলে সবার হাতে কাজের ব্যবস্থা করবে! কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত খোলার জন্য ডবল ইঞ্জিনের সরকার চাই! কৈ বন্ধ হয়ে থাকা একটিও নির্দিষ্ট সংস্থা নিয়ে, যেমন ডানলপ খোলার ব্যাপারে কোনও নির্দিষ্ট কথা তো দিচ্ছে না। কোনও নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে বন্ধ কলকারখানা, যেমন বন্ধ চা বাগান খোলার তো নির্দিষ্ট কোনও প্রতিশ্রুতি নেই। একদিকে কারখানা বন্ধের জন্য কেবল শ্রমিক আন্দোলনকে কাঠগড়ায় তোলা, অন্যদিকে বিজেপিকে ‘ক্ষমতায় আনলে সব মুশকিল আসান হবে’ — এহেন মোহ বিস্তারের জন্য কতই না অপচেষ্টা। বিজেপি এমনকি সাংবাদিক সম্মেলনে ‘চাকরির প্রতিশ্রুতি’ দেওয়া কার্ড প্রকাশ করেছে, বাড়ি বাড়ি বেশ কিছু বিলি করেছে, এমনকি ‘আবেদনপত্র’ও পূরণ করিয়েছে! এভাবে কর্মসংস্থানের জ্বলন্ত দাবি নিয়ে ধোঁকাবাজি ও বশীকরণের অবৈধ কারবার চালাচ্ছে, এই হচ্ছে বিজেপি। এই বিজেপিকে তাই বুঝে নিতে হবে, বুঝিয়েও দিতে হবে — ভোট নয়, ভোট নয়।