মোদী সরকারের বানানো সর্বনাশা কৃষি আইনগুলো বাতিলের দাবিতে ভারতে চলমান কৃষক আন্দোলন চতুর্থ মাসে প্রবেশ করল। এই তিন মাসে এই আন্দোলন বিপুল সৃজনশীল উদ্যম, সাহসিকতা, উদ্ভাবনী শক্তি এবং দৃঢ়তার সাক্ষর রেখেছে। দিল্লীতে কৃষকদের ঢোকার পথে অবরোধ সৃষ্টি করে সরকার অঙ্কুরেই আন্দোলনকে বিনাশ করতে চেয়েছিল, কিন্তু কৃষকরা রাজ্যের সীমানাগুলোর দখল নিয়ে এবং বিশাল এলাকা জুড়ে প্রতিবাদ স্থল স্থাপন করে পাল্টা লড়াইয়ে নামেন। দিল্লীর রামলীলা ময়দানে কৃষকদের তাঁবু ফেলতে না দিয়ে মোদী সরকার রাজধানীকে ঘিরে চারটে প্রতিবাদ স্থলের আবির্ভাবকেই সুনিশ্চিত করে দেয়।
আন্দোলন সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছয় প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন, যেদিন দিল্লীর জনগণ রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে কৃষকদের অবিস্মরণীয় ট্রাক্টর মিছিলকে অভিনন্দিত করেছিলেন। কিন্তু সরকার ও তার বশংবদ গোডি মিডিয়া গোটা মিছিলটাকে পর্যবসিত করে বিচ্ছিন্ন একটা ঘটনায়, যাতে গুটিকয়েক ব্যক্তি লালকেল্লা ময়দানে একটা খালি খুঁটিতে শিখ ধর্মীয় নিশান লাগায়। আন্দোলনটাকে দেশ-বিরোধী নৈরাজ্য ও ষড়যন্ত্র রূপে কলঙ্কিত করে সংবাদ মাধ্যম ঝড় ওঠায়, এবং সরকার যেমন দানবীয় আইনের অধীনে মিথ্যা অভিযোগ দায়েরের তার মার্কামারা অস্ত্রের ওপর ভর করে, তারই সাথে আবার পুলিশী নিপীড়ন ও সংগঠিত গুণ্ডা বাহিনীর যৌথ হানাদারিকেও নামিয়ে আনে। কয়েক ঘন্টার জন্য মনে হয়েছিল যে, সরকার বুঝি বা ভারতীয় কৃষকদের অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানকে বশীভূত করতে সক্ষম হয়েছে।
অসাধারণ দৃঢ়তা দেখিয়ে কৃষক আন্দোলন সংকটের সেই পর্যায় কাটিয়ে ওঠে। উত্তর ভারত জুড়ে বিস্তৃততর ও গভীরতর সমর্থন নিয়ে কৃষক আন্দোলন পুনরায় নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করেছে এবং ভারতের অন্যান্য অংশেও তার অনুরণন আগের চেয়ে আরো জোরালো হয়েই ধ্বনিত হচ্ছে। আন্দোলনের এক শক্তিশালী নেতা হিসেবে রাকেশ টিকায়েতের উত্থান এবং পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা ও রাজস্থানে কিসান পঞ্চায়েতগুলোতে ব্যাপক সংখ্যক কৃষকদের অংশগ্ৰহণ সরকারকে আবারও রক্ষণাত্মক অবস্থানে ঠেলে দিয়েছে। পুরোদস্তুর দমন নামিয়ে আন্দোলন দমনের পথকে অসম্ভব করে তুলেছে কৃষকদের ঐক্য ও শক্তি। টিকায়েতের চোখের জলের আবেগময় প্রভাবের মোকাবিলা করতে গিয়ে মোদী ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ এবং ‘কৃষি আইনগুলো ক্ষতিকারক নয়’ বলে এক প্রতারণমূলক আখ্যান ফাঁদার পথে যান।
এই লক্ষ্যেই চালিত হয়েছিল সংসদের উভয় কক্ষে দেওয়া মোদীর দীর্ঘ ভাষণগুলি। তিনি দাবি করেন, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য এবং মাণ্ডিগুলো আগের মতোই চলবে, কৃষি আইনগুলো ফসল বিক্রির ক্ষেত্রে আরো বিকল্প যুগিয়ে কৃষকদের ক্ষমতায়ন ঘটাচ্ছে মাত্র। রাজ্য সভায় তিনি কৃষক নেতাদের এবং কৃষক আন্দোলনের অন্যান্য সমর্থকদের ‘আন্দোলনজীবী’ ও ‘পরজীবী’ বলে ধিক্কার দেন। এ ব্যাপারে কোন সংশয় নেই যে, আন্দোলনকে তিনি ঝামেলা বলে এবং আন্দোলনের নেতাদের অশান্তি সৃষ্টিকারী বলেই গণ্য করেন। এটা বস্তুত ভারতের গণতন্ত্রকে ‘বিরোধী মুক্ত’ করা, অথবা বিরোধী মতকে নিকেশ করে গণতন্ত্রকে স্বৈরতন্ত্রে পরিণত করার তাঁর অভিপ্রায়কে পেশ করার আর একটা পন্থা মাত্র। লোকসভায় তিনি কৃষকদের আন্দোলনকে পবিত্র বলে অভিহিত করলেও রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির মতো ‘অশুচি’ দাবি তোলার জন্য আন্দোলনের তীব্র ভর্তসনা করেন।
স্পষ্টতই, সরকার চায় না যে কৃষকরা অ-কৃষি বিষয় নিয়ে অথবা অ-কৃষক নাগরিকরা কৃষকদের সম্পর্কে কোনো কথা বলুক। অন্যভাবে বললে, এর মধ্যে নিহিত অভিপ্রায়টা হল কৃষকদের বিচ্ছিন্ন করা এবং কৃষকদের সমর্থনে দাঁড়ানো অন্যদের ভয় দেখানো। এই রণকৌশল চূড়ান্ত রূপেই অনুসৃত হয়ে চলেছে। রিহানা এবং গ্ৰেটা থুনবার্গের টুইটগুলোর প্রতি মোদী সরকার যে ন্যক্কারজনক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে এবং তথাকথিত থুনবার্গ টুলকিট ঘটনায় জলবায়ু পরিবর্তন আন্দোলনের কর্মী দিশা রবিকে যে গ্ৰেপ্তার করেছে তা সচল এই রণকৌশলের দুটি ভয়াবহ দৃষ্টান্ত বৈ অন্য কিছু নয়। দিশা রবিকে গ্ৰেপ্তার করে সরকার বোধকরি এক ঢিলে অনেক কিছুকেই নিশানা করছে। এর মধ্যে দিয়ে ভারতের নিজের পরিবেশ আন্দোলনকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে যে, তারা যেন কৃষক আন্দোলনের পাশে না দাঁড়ায় এবং কর্পোরেট স্বার্থের বিরোধিতা না করে।
আমাদের ভুললে চলবে না যে — নয়া শ্রম বিধি, কৃষি আইন এবং পরিবেশ সুরক্ষা বিধিগুলোর বিপর্যয় ঘটানো সবই পারস্পরিকভাবে সংযুক্ত, সেগুলো ভারতের শ্রমিক, কৃষক ও পরিবেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে কর্পোরেট স্বার্থকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সরকারের একেবারে হালফিলের আইনি বন্দোবস্ত। দিল্লী পুলিশ সমস্ত রীতিকে বিসর্জন দিয়ে যেভাবে বেঙ্গালুরু থেকে পরিবেশ আন্দোলনের এক কর্মীকে গ্ৰেপ্তার করে দিল্লীর জেলে আটক করে, সে কথা বিবেচনা করলে আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, সমস্ত সাংবিধানিক নিয়ন্ত্রণ ও যুক্তরাষ্ট্রীয় রীতিনীতিকে অগ্ৰাহ্য করাটাকে কেন্দ্রীয় সরকার তার স্বভাব করে তুলেছে। দিশা রবির গ্ৰেপ্তারির মধ্যে দিয়ে সবাইকে এই বার্তাই দিতে চাওয়া হল যে, ভারতের কৃষকদের ও ভারতের সংবিধানের বিরুদ্ধে চালানো তাদের যুদ্ধে মোদী সরকার যতদূর ইচ্ছে ততদূর যেতে কোনো দ্বিধা করবে না।
আমরা যারা কৃষকদের সমর্থন করছি এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে আইনের শাসনের সাংবিধানিক ভিত্তিকে রক্ষা করছি, তাদের কাছে চ্যালেঞ্জটা হল মোদী সরকারের শয়তানসুলভ এই রণকৌশলকে পরাস্ত করা। কৃষকদের দিকে বাড়ানো সংহতিকে দুর্বল করে তোলাটা যদি সরকারের অভিপ্রায় হয়, তবে তার প্রত্যুত্তর হবে সংহতিকে আরো জোরদার করে তোলা। সরকার যদি কৃষি আইনগুলো সম্পর্কে প্রতারণামূলক প্রচারের বন্যায় ক্ষুদ্র কৃষকদের ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায়, তবে আমাদের কাজ হবে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক এবং কৃষি শ্রমিকদের সমস্ত অংশের কাছে আন্দোলনের বার্তা পৌঁছে দেওয়া। সরকার যদি মনে করে থাকে যে আন্দোলনটাকে জাট ক্ষমতার প্রর্দশন হিসাবে তুলে ধরে তারা অন্যান্য সামাজিক গোষ্ঠীগুলোকে আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন করে তুলতে পারবে, তবে আমাদের কাজ হল আন্দোলনের বৃহত্তর সামাজিক বিন্যাসকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা। ভারতে যাঁরাই কর্পোরেট আগ্ৰাসন ও ফ্যাসিবাদী আক্রমণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিজেদের অধিকারের জন্য লড়াই করছেন, কৃষকদের বিজয় সেই সমস্ত ভারতীয়দেরই বিজয় বলে পরিগণিত হবে।
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১)