অর্থনীতিতে কর্পোরেট আধিপত্য মোদীর ফ্যাসিস্ট মডেল
Corporate dominance in the economy

স্বাধীন ভারত এতো নির্লজ্জ কর্পোরেট তোষণ এর আগে কখনো দেখেনি। কিছুদিন আগে সংসদে বাজেট ভাষণে দেশের আর্থিক বৃদ্ধির জন্য খোলাখুলি ব্যক্তিগত পুঁজির পক্ষে সওয়াল ও তাকে বরণ করার ‘গুরুত্ব’ তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। আর পাশাপাশি, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার কর্ণধারদের ‘অকর্মন্যতা’ নিয়ে বিদ্রুপ ও শ্লেষ ব্যক্ত করেছেন সংসদের অভ্যন্তরে — কোনো প্রধানমন্ত্রী আজ পর্যন্ত যা করেননি। ইনক্লুসিভ বৃদ্ধির সমস্ত আবরণকে ছিন্নভিন্ন করে এবারের কেন্দ্রীয় বাজেট ভারতের অর্থনীতির উপর কর্পোরেট আধিপত্যকেই সবুজ সংকেত দিয়ে বসলো। এদিকে, কর্পোরেটদের তরফ থেকে নতুন কোনো শিল্পক্ষেত্র গড়ে তোলা বা তাতে পুঁজি বিনিয়োগের কোনো লক্ষণের বদলে উন্নত দেশগুলো থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি ডলার পাম্প করে পাঠানো হলো দেশের স্টক মার্কেটে। এটাকেই প্যান্ডেমিক পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন বলে চালাবার চেষ্টা করছে ক্ষমতার অলিন্দে পোষ মানা আমলাকুল।

এটা আজ স্পষ্ট যে মোদী সরকার এখন কর্পোরেট চালিত বিনিয়োগের মডেলকেই আর্থিক বৃদ্ধি হিসাবে আঁকড়ে ধরতে চাইছে সমস্ত ক্ষেত্রে বিরাট বিপর্যয়কে সামাল দিতে ব্যর্থ হওয়ার পর। আর, আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে পর্যন্ত এটাই হবে তার গতিমুখ।

ব্যক্তিগত পুঁজির পক্ষে এই সরকার তার পক্ষপাতের প্রমাণ দিতে জুলাই-আগস্ট ২০১৯এ সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে পাস করালো মজুরি বিধি বা ওয়েজ কোড। গোটা অর্থনীতি যখন চাহিদার অভাবে ধুঁকছে আম জনতার সংকুচিত ক্রয়ক্ষমতার দরুন, সেই সময় সাধারণ মানুষের হাতে নগদের জোগানকে বাড়ানোর বদলে ২০১৯ সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি কর্পোরেট করের উপর বিপুল ছাড় ঘোষণা করলো আর তা এতোটাই যা এর আগে কখনো করা হয়নি। বস্তুত, নতুন ম্যানুফ্যাকচারিং সংস্থাগুলোকে মাত্র ১৫ শতাংশ কর্পোরেট কর দিতে হবে — দুনিয়ায় কর্পোরেট কর যে সব দেশ আদায় করে তার মধ্যে সবচেয়ে কম! এরপর অতিমারীর সুযোগে কর্পোরেটদের স্বার্থে মোদী সরকার একের পর এক আইন পাস করালো।

গোটা দেশ যখন অতিমারীর মারাত্বক ছোবলে আক্রান্ত, তখন এই সরকার কর্পোরেটদের অবাধ মুনাফা লোটার সুযোগ করে দিতে ২০২০-র মে মাসের মাঝামাঝি আটখানা গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বড় ধরনের কাঠামোগত সংস্কার করে কর্পোরেটদের এই সমস্ত ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশকে আরও ত্বরান্বিত করে। কয়লাক্ষেত্রে উত্তোলন ও বিক্রি করার অনুমতি কর্পোরেট সংস্থাগুলোকে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন এতোদিন কয়লা ক্ষেত্রটিকে সরকারী কব্জায় রাখার যে লকডাউন নীতি ছিল, এবার তা আনলক করা হলো। এখানেই সরকার থামলো না। কয়লা ক্ষেত্রে কর্পোরেটদের বিনিয়োগ ও মুনাফাকে সুনিশ্চিত করতে এই শিল্পের পরিকাঠামো উন্নয়নে বিপুল সরকারি বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি কার্যত কয়লাশিল্পে জাতীয়করণের অবসান ঘটিয়ে কর্পোরেটদের বিপুল মুনাফা অর্জনের রাস্তা প্রশস্ত করে দিল। কয়লাশিল্পে আটকে না থেকে সমস্ত খনি খুলে দিল কর্পোরেটদের জন্য।

যে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্র এতোদিন ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে, সেটাকেও কর্পোরেশন বানানোর পুরো তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। বেসরকারীকরণের লক্ষ্যেই অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিগুলোকে কর্পোরেশনে পরিণত করার একের পর এক পদক্ষেপ নিতে শুরু করলো কেন্দ্রীয় সরকার। বিমান বন্দরগুলোকে ব্যক্তিগত ক্ষেত্রের হাতে তুলে দেওয়ার পাশাপাশি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলোতে বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থাগুলো সঁপে দেওয়া হলো ব্যক্তিগত ক্ষেত্রের কব্জায়।

পারমানবিক শক্তি ও মহাকাশ ভিত্তিক পরিষেবার দরজা এই প্রথম উন্মুক্ত হলো কর্পোরেটদের জন্য। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া বিপুল পরিমাণ কর্পোরেট ঋণ আদায়ে বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থাগুলোকে যাতে ‘বিব্রত’ না করা হয় তার জন্য ইন্সলভেন্সি অ্যান্ড ব্যাঙ্করাপ্টসি কোডকে কার্যকর করা থেকে বিরত রাখা হলো জুন মাসের প্রথম দিকেই। এরপর এলো তিন তিনটে কৃষিআইন ও তিনটে শ্রমকোড। সেই কৃষি আইনের বিরুদ্ধে মাসাধিক চলমান কৃষক আন্দোলন আজ নতুন এক প্রবণতা। এ নিয়ে ইতিমধ্যেই সর্বত্র ব্যাপক চর্চা হয়েছে। স্বাধীনতার পর এই প্রথম শ্রম আইন তৈরি হোল ‘সহজ শর্তে ব্যবসা করার’ বনিয়াদের উপর।

এবারের বাজেট কর্পোরেটদের জন্য দু’হাতে উপঢৌকন এনে দিল। যখন ব্যাপক রাজকোষ ঘাটতি ও আর্থিক সংকটে সরকার জেরবার, তখনো এই বাজেট কর্পোরেট কর-এ হাত দিল না। বাড়ালোনা এক পয়সাও। বরং, জনগণের সম্পত্তি, যেমন রেল-রাস্তা-তেল-গ্যাসপাইপ লাইন-বন্দর-বিমানবন্দর প্রভৃতি পরিকাঠামো ক্ষেত্রগুলো, যা এতোদিন কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর অধীনে ছিল তা ব্যক্তিগত ক্ষেত্রের কাছে তুলে দেওয়ার কথা ঘোষণা করলো। আর, এইভাবে, গোটা অর্থনীতিকে কর্পোরেটদের একচেটিয়াকরণের অধীনে আনতে এবারের বাজেট বাড়তি এক হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ালো। বাজেট ১৩টি সেক্টরের ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিগুলোর জন্য ১.৯৭ লক্ষ কোটি টাকা ধার্য করলো উৎপাদন ভিত্তিক ইন্সেন্টিভ প্রকল্পের নামে, আগামী পাঁচ বছরের জন্য।

মুষ্ঠিমেয় কর্পোরেটদের কব্জায় গোটা অর্থনীতিকে তুলে দেওয়ার সাথেই ওতোপ্রোতভাবে যুক্ত দেশের সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থহীন করে তোলা। ইন্দিরার জরুরি অবস্থায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সমস্ত অধিকার হরণ করা হয়। আর, এবার ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে যে কোন নাগরিকের মতপ্রকাশের একান্ত ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। ধীরে ধীরে গোটা দেশটাই পরিণত হচ্ছে জেলখানায়। শুরু হয়েছে ভারতের কাশ্মীরীকরণ। ঔপনিবেশিক আমলের রাষ্ট্রদ্রোহ আইন, সামান্য কয়েকটি টুইটের জন্য আদালত অবমাননার চোখ রাঙানি ভারতের যেন নতুন এক স্বাভাবিক। দিন কয়েক আগে সদ্য প্রাক্তন অটর্নিজেনারেল মুকুল রোহতাগি বললেন, দিশা রবিকে রাষ্ট্রোদ্রহ মামলায় গ্রেপ্তার করাটা সংবিধান বিরোধী কাজ হয়েছিল।

এই মোদী সরকারকে সর্বাত্মকভাবে প্রতিরোধ করাটাই আজ পথের দাবি।

- অতনু চক্রবর্তী 

খণ্ড-28
সংখ্যা-8