সম্প্রতি দু’টি মামলার শুনানি গ্রহণ কালে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এস এ বোবডে ধর্ষণ সম্পর্কে এমন মন্তব্য করেন যা যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করে, সমালোচনা, বিক্ষোভ ও বিতর্কের জন্ম দেয়। একটি খোলা চিঠিতে ৫,২০০-র বেশি স্বাক্ষরকারী, যাদের মধ্যে নারী আন্দোলনের অনেক কর্মী-বিশিষ্ট নাগরিক-লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবী রয়েছেন, বোবডের মন্তব্যের সমালোচনা করে অবিলম্বে প্রধান বিচারপতির পদ থেকে তাঁর পদত্যাগের দাবি জানিয়েছেন। সিপিএম নেত্রী বৃন্দা কারাট প্রধান বিচারপতিকে চিঠি লিখে তাঁর মন্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানান। ভারতের বার কাউন্সিল আবার বৃন্দার চিঠিকে অনভিপ্রেত এবং অসৎ উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছে বলে বিবৃতি জারি করে এবং বৃন্দা কারাটও আবার বার কাউন্সিলের বিবৃতির পাল্টা জবাব দেন। প্রথমে ধর্ষণ নিয়ে প্রধান বিচারপতির মন্তব্য দুটি বিচার করা যাক।
এক তরুণী মহারাষ্ট্র বিদ্যুৎ উৎপাদন সংস্থার এক ইঞ্জিনিয়ার, রোহিত সুভাষ চহ্বানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন — তিনি যখন নাবালিকা ছিলেন ঐ ব্যক্তি তাঁকে বারবার ধর্ষণ করে। তাঁর নির্দিষ্ট অভিযোগ – হাত-পা বেঁধে ধর্ষণ করা হয়, মুখ খুললে চোখে অ্যাসিড ঢালা, পুড়িয়ে মারা, বাবা-ভাইকে খুনের হুমকি দেওয়া হয়। মেয়েটি আত্মহত্যা করতে গেলে তার মা ধর্ষণের কথা জানতে পারেন। এরপর অভিযুক্তর মা ধর্ষিতার মা-বাবাকে প্রস্তাব দেয় – মেয়েটি পূর্ণ বয়স্কা হলে, অর্থাৎ ১৮ বছর বয়স হলে অভিযুক্ত তাকে বিয়ে করবে। কিন্তু অভিযুক্ত সেই প্রতিশ্রুতি না রেখে অন্য আর একটি মেয়েকে বিয়ে করে। অভিযুক্ত দায়রা আদালতে আবেদন জানান, তিনি সরকারি কর্মী, ফলে পকসো আইনে তাঁকে গ্ৰেপ্তার করা হলে তিনি চাকরি খোয়াবেন, তাই তাঁকে গ্ৰেপ্তারি থেকে রেহাই দেওয়া হোক। দায়রা আদালত তাঁর আর্জি মঞ্জুর করলেও বম্বে হাইকোর্ট দায়রা আদালতের সিদ্ধান্তকে ‘জঘন্য’ বলে অভিহিত করে গ্ৰেপ্তারি থেকে অব্যাহতি দিতে অস্বীকার করে এবং বম্বে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে অভিযুক্ত সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানালে মামলার শুনানি হয় প্রধান বিচারপতির বেঞ্চে। শুনানি চলাকালে প্রধান বিচারপতি অভিযুক্তকে জিজ্ঞাসা করেন – “আপনি কি ওঁকে বিয়ে করবেন?” তিনি আরো বলেন – “আপনি ওঁকে বিয়ে করতে রাজি হলে আমরা সাহায্য করতে পারি। তা না হলে আপনাকে চাকরি খুইয়ে জেলে যেতে হবে।” অভিযুক্ত ইতিমধ্যেই বিবাহিত, আর তাই প্রধান বিচারপতির প্রস্তাবে সায় দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। বোবডে অবশ্য গ্ৰেপ্তারি থেকে তাঁকে চার সপ্তাহের জন্য রেহাই দেন। এর আগে আমরা অন্য বিচারপতিদের কাছ থেকে ধর্ষিতাকে বিয়ে করার প্রস্তাব ধর্ষককে দিতে শুনেছি। ২০২০ সালের জুন মাসে অপরাধী সাব্যস্ত হয়ে জেল খাটা এক ধর্ষক কেরল হাইকোর্ট আবেদন জানায় – তাকে জামিন দেওয়া হোক যাতে সে ধর্ষিতাকে বিয়ে করতে পারে! ঐ একই মাসে উড়িষ্যা হাইকোর্ট ধর্ষিতাকে বিয়ে করার জন্য এক ধর্ষককে জামিন দেয়। এবার নারীর পক্ষে চরম অপমানজনক, অমর্যাদাকর প্রস্তাব এল বিচারবিভাগের একেবারে সর্বোচ্চ স্তর থেকে। (ধর্ষকের প্রতি প্রধান বিচারপতির প্রস্তাব বলে এখানে যা উল্লেখ করা হয়েছে তা সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে নেওয়া। যে বার কাউন্সিল প্রধান বিচারপতির সমর্থনে অত্যন্ত তৎপরতা দেখিয়েছে তারাও কিন্তু বলেনি যে, প্রধান বিচারপতি এই ধরনের প্রস্তাব ধর্ষককে দেননি। প্রধান বিচারপতি এখন যদিও বলছেন যে, তাঁর কথা ভুলভাবে বিবৃত হয়েছ। ধর্ষককে তিনি শুধু জিজ্ঞাসা করেছিলেন – “তুমি কি বিয়ে করতে যাচ্ছ?”)
অন্য একটি মামলায় এক অভিযোগকারিণী জানান – তিনি ও বিনয় প্রতাপ সিংহ নামে জনৈক ব্যক্তি মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করে স্বামী-স্ত্রীর মতো বসবাস করতে থাকেন। কিন্তু ঐ ব্যক্তি তাঁর ওপর চরম যৌন অত্যাচার চালাতে থাকে, যৌনসঙ্গমের সময় হিংস্র আচরণ করে। যৌন অত্যাচার এমন পর্যায় পৌঁছয় যে, যৌনাঙ্গে ক্ষত নিয়ে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। এলাহাবাদ হাইকোর্টের কাছে আবেদনে সুবিধা না হলে অভিযুক্ত সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়। ঐ মামলায় বোবডে মন্তব্য করেন – “একজন পুরুষ ও এক মহিলা যখন স্বামী-স্ত্রী হিসাবে বসবাস করছেন তখন পুরুষটি যতই হিংস্র আচরণ করুন না কেন, তাই বলে কি তাঁর সঙ্গে মহিলার শারীরিক সম্পর্ককে ধর্ষণ বলা যাবে?” তিনি গ্ৰেপ্তারি থেকে অভিযুক্তকে আট সপ্তাহের রেহাই দেন। দম্পত্য জীবনে ধর্ষণ গ্ৰাহ্য হওয়ার মতো কোনো আইন ভারতে না থাকলেও প্রধান বিচারপতির মন্তব্য অসংবেদনশীল এবং অভিযোগকারিণীর যন্ত্রণা ও মর্মপীড়ার প্রতি মমত্বহীন বলে প্রতিভাত হয়েছে।
বার কাউন্সিল তাদের ৪ মার্চের বিবৃতিতে এই যুক্তির অবতারণা করে যে, শুনানি চলাকালে বিচারপতিদের মন্তব্য রায়ের অংশ নয়, ফলে সেগুলির আইনি গ্ৰাহ্যতা নেই, আর তাই সেগুলির সমালোচনা এবং সামাজিক মাধ্যমে সেই সমালোচনার প্রচার আদালত অবমাননারই শামিল। বার কাউন্সিলের বিবৃতিতে বৃন্দা কারাতের বিরুদ্ধে ‘অনুচিত রাজনৈতিক সুবিধা’ আদায়ের অভিযোগ আনা হয়েছে। বার কাউন্সিলের সমালোচনাকে খণ্ডন করে বৃন্দা কারাত বলেছেন, “মন্তব্যগুলোর আইনি গ্রাহ্যতা না থাকতে পারে, কিন্তু সেগুলো অবশ্যই সামাজিক দিক থেকে পশ্চাদপদ দৃষ্টিভঙ্গিগুলোতে বৈধতা প্রদান করে”। ভারতের মতো পিতৃতন্ত্রের আধিপত্য সমন্বিত সমাজে এই মন্তব্যের যথার্ততাকে অস্বীকার করা যাবেনা। ধর্ষকের প্রতি ধর্ষিতাকে বিয়ের প্রস্তাবকে ধিক্কার জানিয়ে প্রতিবাদীদের খোলা চিঠিতে বলা হয়েছে, ঐ মন্তব্য “ধর্ষকের কাছে এই বার্তাই দেবে যে, বিবাহ হল ধর্ষণের একটা লাইসেন্স; এবং ঐ লাইসেন্স পেয়ে ধর্ষক পরবর্তী সময়ে তার দুষ্কর্মের ওপর থেকে অপরাধের কলঙ্ক চিহ্ন মুছে ফেলতে এবং অপরাধকে বৈধ করে তুলতে পারবে”। আর দাম্পত্য সম্পর্কের মধ্যে যৌন হিংসার ক্ষেত্রে বোবডের মন্তব্যকে খণ্ডন করে তাঁদের পর্যবেক্ষণে প্রতিফলিত হয়েছে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা ভারতীয় নারীর নির্মম ও অবদমিত বাস্তবতা : “এই মন্তব্য শুধু স্বামীর চালানো যে কোনো ধরনের যৌন, দৈহিক এবং মানসিক হিংসাকে বৈধ করে তোলে না, তা ভারতীয় নারীরা বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে কোনো আইনি অবলম্বন ছাড়াই যুগ-যুগ ধরে যে নির্যাতন সহ্য করে আসছে তাকেও স্বাভাবিক করে তোলে”।
নারীকে, তার শরীরকে পুরুষের সম্পদ রূপে গণ্য করার পশ্চাদমুখী চিন্তাধারা ভারতীয় সমাজে প্রবল ভাবেই বিদ্যমান। এই ধ্যানধারণার বশবর্তী হয়েই পুরুষ নারীকে গৃহকোণে আটকে রাখতে, তার আত্মঘোষণাকে নিয়ন্ত্রিত করতে এবং এমনকি তার ওপর বলপ্রয়োগ করতেও উদ্যত হয়। এই ধরনের আচরণ যে মনুবাদ থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করে তা এক অবিসংবাদী বাস্তব। মনুবাদের প্রতি তাদের আনুগত্য বিজেপি গোপন করে না। কেন্দ্রে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর নারীর ওপর পুরুষের প্রভুত্বকামিতার প্রবণতা তীব্রতর হয়েছে। বিজেপি শাসিত কয়েকটি রাজ্যে লাভ জিহাদ আইনের প্রবর্তন নারীর স্বাধীনতায়, জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার তার অধিকারে আরো বিপর্যয় ঘটিয়েছে। প্রধান বিচারপতির কণ্ঠে ভারতীয় সমাজে ব্যাপ্ত পুরুষতন্ত্রের প্রাবল্যেরই প্রতিধ্বনি। নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনে মধ্যস্থাকারীর ভূমিকার চেয়ে পুরুষের সাপেক্ষে নারীর সমানাধিকারকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ভূমিকাই প্রধান বিচারপতির কাছ থেকে প্রত্যাশিত। নিজেদের অধিকার আদায়ে, আর্থ-সামাজিক অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে এতদিন লড়াই চালিয়ে নারীরা যেটুকু অগ্ৰগতি অর্জন করেছেন, প্রধান বিচারপতির মন্তব্যে ঘড়ির সেই কাঁটাকে বিপরীতমুখী করার আভাস। সংঘ পরিবারের যাবতীয় প্রয়াস সত্ত্বেও তা কখনই সফল হতে পারবে না, নারীদের তীব্র প্রতিবাদের মুখে পড়াটা তার অনিবার্য নিয়তি হয়ে রয়েছে।