১০ মার্চ ত্রিপুরায় সিপিআই(এমএল) লিবারেশান রাজ্য সম্পাদক পার্থ কর্মকার এক প্রেস বিবৃতিতে বলেন, আসন্ন ত্রিপুরা স্বশাসিত জেলা পরিষদ (টিটিএডিসি) নির্বাচনে গণতন্ত্র প্রিয় নির্বাচক মন্ডলীর কাছে আহ্বান — ফ্যাসিবাদী বিজেপিকে যে কোনও মূল্যে পরাস্ত করুন। কোনও বিভেদমূলক শক্তিকে ভোট নয়। গণতন্ত্র, ঐক্য ও উন্নয়নের জন্য বিরোধী বামফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থীদের ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করুন।
এখন করোনা মহামারী প্রকোপ কমেছে। এমন সময়ে এক বছর পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে আমাদের রাজ্যে এডিসিতে নির্বাচন হচ্ছে এবং দেশে পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সারা দেশে ও রাজ্যে যে কোন নির্বাচনে গণতন্ত্র প্রিয় ভোটারদের কাছে ফ্যাসিবাদী বিজেপিকে পরাস্ত করা আজ সাধারণ লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছে। কারণ দ্বিতীয় বার ক্ষমতাসীন হয়ে মোদি সরকার উন্নয়নের নাম করে দেশের সমস্ত সরকারি ও জাতীয় সম্পদকে একে একে দেশী বিদেশী কর্পোরেট কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দিতে আগ্রাসী হয়ে উঠেছে এবং তার জন্য ক্ষমতার কেন্দ্রীকরন বাড়িয়ে তুলেছে। সংসদের ভিতরে বা বাইরে যে কোন বিরোধীতাকে অবদমিত করে চলেছে। এর বিরুদ্ধে জনগণের স্বত:স্ফূর্ত ক্রোধকে ও গণতান্ত্রিক পথে যে কোনও প্রতিবাদ আন্দোলনকে রাষ্ট্র বিরোধী বলে ক্ষমতার বুলডোজার চালিয়ে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিতে চাইছে। অন্যদিকে আরএসএস দেশের সংবিধান ও প্রজাতন্ত্র কে ধ্বংস করে একটি ফ্যাসিবাদী মধ্যযুগীয় ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য আধুনিক ভারতের ভিত্তি মূলে আঘাত করে চলেছে। একটি বেসরকারি সংগঠিত শক্তি হিসাবে আরএসএস বেআইনিভাবে সরকারি ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। যার ফলে দেশে ও রাজ্যে আজ গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকার বিপন্ন। আইনের শাসন নেই। জঙ্গলরাজ কায়েম হয়েছে। আরএসএস-বিজেপির রাজত্বে শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র-যুব, নারী ও সব অংশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু, দলিত, আদিবাসী ও জনজাতি জনগণের অধিকার আজ আক্রান্ত ও বিপন্ন। জনগণ আজ বিজেপির শাসন থেকে মুক্তি চাইছেন। তাই গণতন্ত্র ও উন্নয়নের শত্রু ফ্যসিবাদী বিজেপিকে যে কোন মূল্যে আজ পরাস্ত করা সময়ের দাবি।
তাছাড়া, গত তিন বছরে বিজেপি জোট শাসনে ভিশন ডকুমেন্টে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির একটিও বাস্তবে রূপায়িত হয়নি। এডিসির হাতে আরো বেশি অর্থনৈতিক ক্ষমতা প্রদান করা তো দূরের কথা রাজ্য বাজেটে ফি-বছর বরাদ্দকৃত অর্থের পুরোটা এডিসি পায়নি। এডিসির নাম বদল করে ত্রিপুরা টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল করা এবং আসন সংখ্যা আটাশ থেকে পঞ্চাশ করা কোথায় হারিয়ে গেল? মানুষ জবাব চাইছে। এডিসি এলাকায় একশটি মডেল ভিলেজ, মিনি সেজ্ গঠন করা, সবার জন্য খাদ্য, বিশুদ্ধ পানীয় জল, আবাসন, স্বাস্থ্য সেবা সুনিশ্চিত করা বাস্তবে মিথ্যাচার হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বিহারের পরেই দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেকারত্ব, ৪২ শতাংশ ত্রিপুরাতে। অথচ সরকারি শূণ্যপদ পূরণ করতে, ব্যাকলগ বজায় রাখতে, বেকার এসটি যুবকদের জন্য বিশেষ কর্মসংস্থান প্রকল্প চালু করতে বিজেপি জোট সরকার ব্যর্থ প্রমানিত হয়েছে। অপরিকল্পিত ও নিষ্ঠুর লকডাউনের ফলে মানুষ কাজ ও রোজগার হারিয়েছে। এই তিন বছরে এডিসি এলাকায় জনজাতিরা সবদিক থেকে পিছিয়ে পড়েছে এবং বিশেষভাবে শিক্ষায় পিছিয়ে পড়েছে। বিদ্যালয়ে ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। অথচ সব শিক্ষার্থীদের কাছে পঠন পাঠনের বই নেই। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ্য বই নগদ অর্থ দিয়ে কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। নোট বই গরীবরা কিনতে পারেনি। সরকারি ও সরকারি অনুদান প্রাপ্ত বেসরকারী বিদ্যালয়ে স্টাইপেন্ড বন্ধ। রেগা প্রকল্পে গড়ে ৬০-৭০ দিনের কাজ হয়েছে। ১৫০ দিনের কাজ তো দূরের কথা। অন্যায়ভাবে অনেকের সামাজিক ভাতা বন্ধ বা কেটে দেওয়া হয়েছে। পাট্টা প্রাপ্ত জমিতে কেন্দ্রীয় প্রকল্প সৃষ্টি করে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ কককরা হয়নি। রোজগার কমেছে। কিন্তু নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, খাদ্যসামগ্রী ও ঔষধপত্রের দাম আকাশছোঁয়া। তাই সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। সর্বনাশা নয়া কৃষি আইনের ফলে দেশে কোম্পানিরাজ কায়েম হবে। উপজাতিরা সংরক্ষিত এলাকার মধ্যে জমি থেকে উচ্ছেদ হবেন। তাঁরা খাদ্যের অধিকার হারাবেন। জনজাতিদের জন্য এডিসি একটি সংবিধান সম্মত রক্ষাকবচ হিসাবে বাস্তবে আর এর কোন অর্থ থাকবে না। তাছাড়া ঘরে বাইরে শাসক বিজেপি দলের ভিতরে ও জোটের মধ্যে সংকট বেড়েই চলেছে। তাই এই নির্বাচনে বিজেপিকে পরাস্ত করতে সবাইকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
পাশাপাশি রাজ্যে আঞ্চলিক দলগুলি প্রথমে তিপ্রাল্যান্ড ও এখন গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড গড়ার দাবি তুলেছে। তারা বলছেন যে, কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে তারা এই দাবি আদায় করবেন। যার সাথে বাস্তবের কোন মিল নেই। বরং এই দাবিগুলি তাদের মধ্যেকার রাজনৈতিক সংকটকে প্রতিফলিত করেছে। কেননা কেন্দ্রীয় সরকার তার হাতে ক্ষমতা অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত করার ফলে যেখানে দেশে আজ যুক্তরাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক কাঠামো আক্রান্ত। রাজ্যগুলির অধিকার ও অস্তিত্ব বিপন্ন। সেখানে আঞ্চলিক স্বশাসিত সংস্থাগুলির ক্ষমতাবৃদ্ধির কোনো প্রশ্ন নেই। তাই বিজেপি কোনো প্রতিশ্রুতি পূরণ করেনি। অথচ এই প্রশ্নে এই দলগুলোর কোন বক্তব্য নেই। আর সংবিধান অক্ষত থাকলে পরে আমরা ত্রিপুরা স্বশাসিত জেলা পরিষদকে সময়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করে আরো বেশী ক্ষমতাসম্পন্ন করে তুলতে পারব। তাছাড়া তাদের এই দাবিগুলি স্বাভাবিকভাবেই জাতি উপজাতিদের মধ্যে বিভেদ ও অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি করেছে। অতীতে অনেক বাঁধা বিপত্তি থাকলেও ত্রিপুরায় আজকের এডিসি জাতি-উপজাতি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ফসল। আবারো এক সাধারণ ঐক্যের মধ্য দিয়েই রাজ্যের উন্নয়নের স্বার্থে এডিসিকে সময়ের সাথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তাই যারা বিভেদ তৈরি করে তাদের ভোট দেবেন না।
দেশ ও রাজ্যে এই সংকটকালীন সময়ে আমরা সিপিআই(এমএল) লিবারেশন, ত্রিপুরা রাজ্য কমিটি এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। যাতে বিজেপি বিরোধী অভিমুখে বিশেষত বিরোধী বাম ভোট ভাগ না হয়। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ব্যপক বামপন্হী ঐক্য শক্তিশালী হয়ে উঠে। তাই জনগণের গণতন্ত্র, ঐক্য ও উন্নয়নের দাবিতে বিরোধী বামফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থীদের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করছি এবং বামপন্থী প্রার্থীদের ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করার জন্য নির্বাচক মন্ডলীর কাছে আহ্বান করছি।