১৫ মার্চ ২০২১। বিকেল ৫:০০-৫:৩০ টা। হটাৎ করেই গেরুয়া টি-শার্ট পরিহিত কিছু মানুষ এক এক করে ঢুকে পরলেন বই পাড়ার কফি হাউজের দু’তলা, তিন তলায়। কয়েকজন আবার ভিতরে ঢুকে গায়ে গলিয়ে নিলেন গেরুয়া জামা, যার বুকে লেখা ‘মোদী পাড়া’। কফি হাউজ জুড়ে বিভিন্ন টেবিলগুলো ধীরে ধীরে তাদের দখলে চলে এলো। এদের মাঝেই দেখা গেল একটি চেনা মুখ। সামাজিক মাধ্যমে বিজেপি’র ট্রোল আর্মির অন্যতম চেহারা ও মোদীর ডিজিটাল প্রচারের সামনের সারিতে থাকা ‘কুখ্যাত’ তেজিন্দর বগগা, যিনি প্রথম প্রচারের আলোয় আসেন আদালত চত্বরে ঢুকে আইনজীবী প্রশান্তভূষণের উপর হামলা করে। তারপর নানান সময়ে সামাজিক মাধ্যমে বিরোধী যে কোনো স্বরকে তীব্র আক্রমণ করে কুৎসিত পোস্ট, ফেক নিউজ, হুমকি, শাসানি দেওয়ার পুরস্কার স্বরূপ ২০২০ সালে দিল্লি থেকে বিজেপির হয়ে নির্বাচনে লড়েন ও আপ-এর কাছে হেরে যান। এই তেজিন্দর বগগা-র নেতৃত্বেই ‘মোদী পাড়া’ ডিজিটাল ক্যাম্পেন চলে ফেসবুক সহ নানান মাধ্যমে। ১৫ মার্চ বগগা ও তার অনুগামীদের দলবল প্রথমে কফি হাউজে ঢোকেন, বিভিন্ন টেবিলে বসেন, কথা বার্তা বলেন, প্রচার চালান, ছবি তোলেন। তাদের শারীরিক ভাষা ও প্রচারের ধরন ছিল কফি হাউজের চেনা ছবির একেবারেই পরিপন্থী। এর পরেই তাদের কয়েকজন সটান চলে যান নীচে সিঁড়ির কাছে যেখানে বিভিন্ন পোস্টারের মাঝেই লাগানো ছিল ‘নো ভোট টু বিজেপি’-র পোস্টার। কালি দিয়ে সেই পোস্টার নষ্ট করতে ও পোস্টার ছিঁড়তে শুরু করেন তারা। সেই সময়ে কফি হাউজে উপস্থিত কয়েকজন এর প্রতিবাদ করতেই ভিতরে বসে থাকা বাহিনী এসে শুরু করে তাণ্ডব। যখন বলা হয় যে ‘আপনারা কেন পোস্টার নষ্ট করছেন, আপনাদের পোস্টার আপনারা পাশের খালি জায়গায় লাগান’, তখন তাদের তরফ থেকে জবাব আসে ‘বেশ করছি ছিঁড়ছি, যা পারিস করে নে’। আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে, উচ্চগ্রামে ৩০-৪০ জন মিলে শুরু হয় ‘মোদী মোদী’, ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগান। কফি হাউজ তখন হতচকিত। চিরকাল নানা রাজনৈতিক আলোচনা, মত বিনিময়, তর্ক বিতর্ক দেখে অভ্যস্ত মুক্ত চিন্তার পরিপোষক কফি হাউজ এই ধরনের উদ্ধত- উগ্র শরীরী ভাষার সাথে একেবারেই পরিচিত নয়। এর পরেই প্রতিবাদীদের মধ্যে থেকে পাল্টা আওয়াজ ওঠে ‘ক্ষুদিরামের মাটিতে নাথুরামের ঠাই নেই’, ‘রবি ঠাকুরের মাটিতে দাঙ্গাবাজদের ঠাই নেই’। লেজ গুটিয়ে পালায় নেতা ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। ঘটনার প্রতিবাদে পরের দিন ১৬ মার্চ ওই জায়গাতেই বিক্ষোভ সভার ডাক দেওয়া হয়, যোগ দেন কয়েকশো মানুষ। সভা ও মিছিল থেকে স্পষ্ট বুঝিয়ে দেওয়া হয় বহু লড়াইয়ের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার আমরা যে কোনো মূল্যে রক্ষা করবো। বাঙলার বুকে থেকে এই ফ্যাসিস্ত শক্তির কোনো জায়গা নেই। গেরুয়া বাহিনী যে যে জায়গায় পোস্টার নষ্ট করে, দিগুণ পোস্টারে ভরিয়ে দেওয়া হয় সেই সমস্ত দেওয়াল।
বস্তুত কলকাতার কলেজ পাড়ায় খোদ কফি হাউজে এই ধরনের আক্রমণ একেবারেই কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সারা দেশজুড়েই মুক্ত চিন্তা, খোলামেলা পরিবেশ যেখানে বহু মতের আদান-প্রদান হয়ে এসেছে সুস্থ-গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়; ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে সেগুলোই হয়েছে বিজেপি সঙ্ঘ পরিবারের অন্যতম নিশানা। দেশের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিই হোক বা শিল্প সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র; বারবার নানা কুৎসা, মিথ্যা প্রচার, ফান্ড কাট, আরএসএস-এর পেটোয়াদের নিযুক্ত করে, সাধারণ ছাত্র ছাত্রীদের হেনস্থা করে সবক সেখানোর চেষ্টা চলছে। পরিকল্পিতভাবে সিস্টেম্যাটিক আক্রমণ নামিয়ে আনা হচ্ছে। আর এতেও না হলে হয়েছে সরাসরি হামলা, মিথ্যা মামলা, গ্রেপ্তারি। জেএনইউ, জামিয়া মিলিয়া, আলীগড়, বেনারস, যাদবপুর, হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়, এফটিআইআই উদাহরণ ভুরি ভুরি। বিজেপি-আরএসএস-র আক্রমণের ধরন বহুমুখী, যার পরিকল্পনা চলছে বহু বছর ধরে। ক্ষমতায় এসে একদিকে কৃষি আইন, শ্রম কোড, নয়া শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে কৃষক শ্রমিক ছাত্রদের অধিকার কেড়ে নেওয়া, সিএএ–এনআরসি লাগু করে নাগরিকতার অধিকার কেড়ে নেওয়া, যেকোনো বিরোধী মত প্রকাশের অধিকারের উপরে আঘাত, সংবিধানকে নস্যাৎ করে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙ্গে ফেলার ষড়যন্ত্র এগুলো হচ্ছে সরাসরি দিনের আলোয়; প্রয়োজনে আইন বা সাংবিধানিক ধারা বদলে ফেলে। সংখ্যালঘু, দলিত ও মহিলাদের উপর নিপীড়নকে ‘নিউ নরমাল’ বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর এই অর্থনৈতিক রাজনৈতিক হামলার পাশাপাশি নিরন্তর চলছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দখলদারি। দেশের বহু ভাষার-বহুত্ববাদী সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে ‘হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তানের’ ফর্মুলা চাপিয়ে দেওয়ার ছক চলছে। আর এখানেই বিজেপি দেশের আর পাঁচটা শাসক দলের থেকে আলাদা। এই ফ্যাসিস্ত বিজেপিকে ভারতবর্ষের সমস্ত পরিসর থেকে ছুঁড়ে ফেলা তাই আজ দেশকে রক্ষা করার প্রাথমিক শর্ত।
কলকাতার কলেজপাড়া বইপাড়া স্বাধীনতার আগের সময় থেকে বহু গণআন্দোলনের সাক্ষী। শিক্ষা সংস্কৃতি মননের জগতেও বিশেষ জায়গা নিয়ে আছে এই অঞ্চল। শ্রমজীবী, ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, সাহিত্যিক, শিল্পী বিভিন্ন মানুষকে দুই বাহু প্রসারিত করে গ্রহণ করেছে এই এলাকা। বিবিধ রাজনৈতিক মতের আদান-প্রদান চলেছে একই টেবিলে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিকভাবে। নিজের মত প্রকাশ করতে দুবার ভাবতে হয়নি কাউকে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলেছে নির্মাণ ও বিনির্মাণ। মগজে কার্ফু নামানো হিন্দুত্ববাদি গেরুয়া বাহিনী এখানে কোনো দিনই কল্কে পায়নি। আর তাই এবার তাদের নিশানায় এসেছে কফি হাউজ। তাদের নিশানার আসবে রাজ্যের সমস্ত গণতান্ত্রিক মুক্ত চিন্তার পরিসর। যারা বাংলার বহুত্ববাদী সংস্কৃতি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, যারা মিছিল করে গিয়ে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙ্গে, যারা সিলেবাস থেকে রবি ঠাকুরের লেখা বাদ দেয়, বিশ্বাসঘাতকতা আর ব্রিটিশদের দালালি করা ছাড়া যাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে কোনো ভূমিকা নেই; তাদের কোনো জায়গা এই প্রীতিলতা-সূর্য সেন-সুভাস বোস-ক্ষুদিরাম-এর মাটিতে নেই। আক্রমণ নয়, শেষ কথা বলে প্রতিবাদ প্রতিরোধ। আগামী নির্বাচনে তাই ফ্যাসিস্ত বিজেপিকে একটিও ভোট নয়।