সিবিআই, এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টোরেট (ইডি) ও আয়কর বিভাগের জন্য অনেকে এখন ত্রিশূল অভিধাটি ব্যবহার করে থাকেন। বিরোধী কোনো দল বা নেতাকে দমিয়ে রাখতে, ভয় দেখাতে, তাদের সক্রিয়তা বন্ধ করতে মোদী সরকার তাদের ত্রিশূল দিয়ে বিদ্ধ করছে, দুর্নীতি দমনে যুক্ত কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলোকে তাদের পিছনে লেলিয়ে দিচ্ছে। অখিলেশ যাদবের এসপি, মায়াবতীর বিএসপি থেকে মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেস, চন্দ্রবাবু নায়ডুর টিডিপি, কমল হাসানের এমএনএম-এর মত বিরোধী পক্ষের দলগুলো এই তিন কেন্দ্রীয় সংস্থার হানাদারির মুখে পড়েছে। এই অভিযোগও এমনকি উঠেছে যে, কেরলে সোনা পাচার কাণ্ডে ইডি এক অভিযুক্তকে চাপ দেয় যে তিনি যেন কেরলের সিপিআই(এম) মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নের নাম নিয়ে তাঁকে এই দুর্নীতিতে জড়ান। বিরোধী পক্ষের নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমনের কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলোর অভিযান যে পুরোদস্তুর মোদী সরকার তথা বিজেপির রাজনৈতিক স্বার্থ প্রসূত তা নিয়ে আজ আর প্রশ্নের কোনো অবকাশ নেই।
এরই পাশাপাশি তাদের সঙ্গে দুর্নীতির কোনো যোগ না থাকাটাকেও বিজেপি জাহির করতে চায়। কিন্তু নিজেদের নিষ্কলুষ বলে প্রদর্শিত করতে চাইলেই কি আর কলঙ্ক চাপা থাকে। আগেও বিজেপির বিরুদ্ধে, তার নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল (পাঠক, রাফাল যুদ্ধ বিমান ক্রয়ে, এক ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর বাজেয়াপ্ত হওয়া খাতাপত্রে নরেন্দ্র মোদী গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তাঁকে ২৫ লক্ষ টাকা দেওয়ার উল্লেখ, নোটবন্দীর মাত্র কয়েক দিন আগে অমিত শাহর পরিচালনাধীন গুজরাটের কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্কে ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোটে বেশ কয়েকশো কোটি টাকা জমা হয়ে কালো টাকাকে সাদা করার মতো দুর্নীতির অভিযোগ স্মরণ করুন)। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সর্বোচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের অপরাধী সাব্যস্ত হওয়া থেকে অব্যাহতি ঘটে। সম্প্রতি আবারও বেশ কয়েকটি দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, যাতে নাম জড়িয়েছে নরেন্দ্র মোদী সহ বিজেপি নেতৃবৃন্দের ও তাদের চালিত প্রশাসনের। অভিযোগগুলোকে বিচার করা যাক।
সুইডেনের বাস-ট্রাক প্রস্তুতকারী সংস্থা স্ক্যানিয়া নিজেরাই তদন্ত করে জানিয়েছে যে, ২০১৩ থেকে ২০১৬-র মধ্যে ভারতের সাতটা রাজ্যে বাস সরবরাহের বরাত পেতে তারা সরকারী কর্তাদের ঘুষ দিয়েছিল। তাদের তদন্ত রিপোর্ট জানিয়েছে – “এই অশিষ্ট আচরণের মধ্যে রয়েছে ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ, ব্যবসার অংশীদারের এবং মিথ্যা উপস্থাপনার মাধ্যমে ঘুষ প্রদান।” ভারতে স্ক্যানিয়ার এজেন্ট এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে দু-দফায় কালো প্ল্যাস্টিক ব্যাগে ২৫ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়েছিল বলেও জানানো হয়েছে।
স্ক্যানিয়ার সঙ্গে বাস সরবরাহের চুক্তি হয় গুজরাতের সিদ্ধি বিনায়ক লজিস্টিকস লিমিটেড-এর। স্ক্যানিয়ার থেকে কেনা বাস ২০১৪ সালে মোদীর নির্বাচনী প্রচারে ব্যবহার কর হয়েছিল বলেও প্রকাশ পেয়েছে। এই বাস কেনা ও অন্যান্য প্রকল্পের জন্য সিদ্ধি বিনায়ক ব্যাঙ্ক অব মহারাষ্ট্র থেকে প্রচুর টাকা ঋণ নিয়েছিল, এবং অপরিশোধিত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ৮৩৬ কোটি টাকা। ঋণ পরিশোধের জন্য ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ সিদ্ধি বিনায়ককে চিঠি দিলে কোম্পানির প্রধান কর্তা রূপ চাঁদ বইদ উত্তরে জানান – “নিম্ন স্বাক্ষরকারী শ্রী নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর দলের লোকজনের ৩ডি প্রচারের জন্য বিশেষভাবে তৈরি বাসের যোগারযন্ত্রের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এর জন্য প্রায় দু-মাস সময় লাগে (ফেব্রুয়ারি ও মার্চ)। এই সময় কালে আমি ব্যবসার কোনো কাজে মনোযোগ দিতে পারিনি।” ব্যাঙ্ক ঋণ পরিশোধ করার কোনো আগ্ৰহ এই উত্তরের মধ্যে ধরা পড়ছে না। বিপরীতে রূপচাঁদ বইদের এই মনোভাবই সুস্পষ্ট হচ্ছে যে, নরেন্দ্র মোদীর নাম নিলে, তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা জাহির করতে পারলে ব্যাঙ্ক ঋণ পরিশোধ করার কোনো দায় থাকবে না, এবং ঋণ পরিশোধের জন্য ভবিষ্যতে কেউ আর তাগাদাও দেবে না। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছাকাছি থাকা এই ধরনের ব্যক্তিরাই যে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলোর অনুৎপাদক সম্পদকে পাহাড় প্রমাণ করে তুলেছে তা আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য।
উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী ত্রিবেন্দ্র সিং রাওয়াত গত ৯ মার্চ মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করেন। বলা ভালো, তাঁর দল বিজেপিই তাঁকে অপসারিত করে। তাঁর প্রতি দলের বিধায়কদের অনাস্থা, ক্ষোভই তাঁর অপসারণের কারণ বলে বলা হলেও তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে প্রকাশ পেয়েছে। অভিযোগ, ত্রিবেন্দ্র সিং রাওয়াত যখন ঝাড়খণ্ডে বিজেপির দায়িত্বশীল ছিলেন, সেই সময়, অর্থাৎ ২০১৬ সালে জনৈক অমৃতেশ সিং চৌহান হরেন্দ্র রাওয়াত ও তাঁর স্ত্রী সবিতা রাওয়াতের অ্যাকাউন্টে ২৫ লক্ষ টাকা জমা করেন। এই সবিতা রাওয়াত হলেন ত্রিবেন্দ্র সিং রাওয়াতের শ্যালিকা। অমৃতেশ সিং চৌহানকে ঝাড়খণ্ডের গৌ-সেবা আয়োগের প্রধান করা হবে, এই সুবিধা পাওয়ার আশ্বাসেই চৌহান ঐ দুই ব্যক্তির অ্যাকাউন্টে টাকা জমা করেন।
মেশ কুমার শর্মা নামে এক সাংবাদিক ফেসবুকে একটি ভিডিও তুলে দিলে দুর্নীতির এই অভিযোগ সামনে আসে। টাকা জমা করার প্রমাণ হিসেবে উমেশ শর্মা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ, কথোপকথনের রেকর্ড, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা জমার রসিদের প্রতিলিপি দাখিল করেন।
সাংবাদিক উমেশ শর্মা এই অভিযোগ আনলে অমৃতেশ সিং চৌহানের জমা করা টাকায় যাঁরা লাভবান হয়েছেন বলে অভিযোগ, তাদের অন্যতম হরেন্দ্র রাওয়াত পুলিশের কাছে এফআইআর দায়ের করে বলেন, উমেশ শর্মার অভিযোগ মিথ্যা এবং মুখ্যমন্ত্রী ত্রিবেন্দ্র সিং রাওয়াতের সঙ্গে তাঁর কোনো আত্মীয়তা নেই।
মামলাটি উত্তরাখণ্ড হাইকোর্টে যায়। হাইকোর্ট উমেশ শর্মার বিরুদ্ধে এফআইআর খারিজ করে দিয়ে অভিযোগের সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয়। বিচারপতি তাঁর রায়ে বলেন, “রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ত্রিবেন্দ্র সিং রাওয়াতের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের প্রকৃতি বিচার করে এই আদালত মনে করে যে সত্যের উদঘাটনই যথাযথ হবে।” রায়ে আরো বলা হয়, “রাজ্যের স্বার্থেই সংশয় পরিষ্কার হওয়া দরকার।”
হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে ত্রিবেন্দ্র সিং রাওয়াত সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানিয়েছেন বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, লক্ষ্মৌয় তৈরি হচ্ছিল সুপার স্পেশালিটি ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। গত বছরের ২০ অক্টোবর হাসপাতালের উদ্বোধন হয়। হাসপাতাল তৈরি হতে গেলে তো বেড থেকে আরম্ভ করে প্রচুর সামগ্ৰী কেনার প্রয়োজন হয়। কিন্তু সেই সমস্ত সামগ্ৰী কেনায় স্বচ্ছতা যদি না থাকে? সামগ্ৰীর দাম যদি প্রকৃত দামের চেয়ে অনেক বেশি দেখানো হয়? গত ১৭ ফেব্রুয়ারি যোগী সরকারের কাছে প্রিন্সিপাল অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেলের দেওয়া রিপোর্টে এরকমটাই প্রকাশ পেয়েছে। অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেলের রিপোর্টে প্রতিফলিত প্রকৃত দাম আর দেখানো দামের মধ্যে ফারাকের দিকে চোখ বোলানো যাক:
হাসপাতালে ১০০টা ৪২ ইঞ্চি রঙিন টিভি কেনা হয়েছে; এক একটা টিভির আসল দাম যেখানে ৫২০৯৬ টাকা, সেখানে প্রতিটি টিভির দাম দেখানো হয়েছে ১.২ লক্ষ টাকা। বেড কেনা হয়েছে ১০০টা; বেডের প্রকৃত দাম ৪০৪১৫ টাকা করে হলেও এক একটা বেডের দাম দেখানো হয়েছে ২ লক্ষ টাকা করে। কেনা হয়েছে বেশ কিছু ইনডোর-আউটডোর লাইট ফিক্সচারস; অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেলের রিপোর্টে ঐ লাইট ফিক্সচারসগুলোর প্রকৃত দাম ১৮.৪ কোটি বলে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, সেগুলোর দাম দেখানো হয়েছে ৩৮.৩০ কোটি টাকা।
এই সমস্ত সামগ্ৰী কেনার দায়িত্বে ছিল পিডব্লিউডি দপ্তর। সরকার সেই দপ্তরকেই অভিযোগের তদন্ত করে ১৫ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলে। এই প্রতিবেদন লেখা যখন চলছে, তখনও রিপোর্ট জমা হওয়ার কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি। এটাকে কর দাতাদের, অর্থাৎ জনগণের টাকার নির্ভেজাল লুট ছাড়া আর কি বা বলা যেতে পারে !
নরেন্দ্র মোদী পশ্চিম বাংলায় নির্বাচনী প্রচারে এসে বলে গেলেন যে, তৃণমূল কংগ্রেস ও স্ক্যাম একাকার হয়ে গেছে। কিন্তু দুর্নীতি নিয়ে বিজেপিরও কি কোনো ছুঁৎমার্গ আছে? পশ্চিম বাংলায় আমরা কি এর ভুরি-ভুরি নিদর্শন দেখতে পাচ্ছি না? দুর্নীতিতে অভিযুক্ত তৃণমূল কংগ্ৰেসের যে নেতাদের বিরুদ্ধে বিজেপি একদিন প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ দেখিয়েছিল, আজ তো বিজেপি তাদের দুহাতে বরণ করছে! এখানে দুর্নীতির যে অভিযোগগুলো উল্লিখিত হল, মোদী সরকার সেগুলোর পিছনে সত্যের উন্মোচনে আগ্ৰহ দেখিয়ে তদন্তের নির্দেশ কি দেবে? সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে কেন্দ্রীয় ক্ষমতার বলে এই অভিযোগগুলোকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হলে জোরের সাথে তদন্তের দাবি তোলার পথেই আমাদের যেতে হবে। নরেন্দ্র মোদীর থ্রি-ডি প্রচারে বাস যোগান দেওয়ার বিনিময়ে সিদ্ধি বিনায়ক লজিস্টিকস লিমিটেড বিপুল পরিমাণ ব্যাঙ্ক ঋণ পরিশোধকে এড়িয়ে গেল কেন, তার জবাবদিহিও নরেন্দ্র মোদীর কাছে দাবি করতে হবে। নরেন্দ্র মোদী সরকারই ইলেক্টোরাল বণ্ড প্রকল্প চালু করে কর্পোরেটদের কাছ থেকে, বিদেশী সংস্থা থেকে অস্বচ্ছ পথে বড়-বড় রাজনৈতিক দলগুলোর কালো টাকা গ্ৰহণকে আইনি সুরক্ষা যুগিয়েছে। এর মধ্যে কর্পোরেটদের সঙ্গে দেওয়া-নেওয়ার একটা ব্যবস্থা কেউ যদি খুঁজে পান তাকে বোধহয় খুব একটা দোষ দেওয়া যাবে না।
২০১৮ সালে চালু হওয়া এই প্রকল্পে এখনও পর্যন্ত ১৫ দফায় ৬৫৩৫ কোটি টাকা রাজনৈতিক দলগুলোর ভাঁড়ারে জমা পড়েছে, যার সিংহ ভাগ, ৬০ শতাংশেরও বেশি গেছে বিজেপির কাছে। শাসকদের দুর্নীতি আগেও ছিল। কিন্তু নয়া উদারবাদী অর্থনীতি চালু হওয়ার পর থেকে রাষ্ট্রটাকে ধরে লুটপাটের যে সংস্কৃতি ফুলেফেঁপে উঠেছে, শাসক শ্রেণীর কোনো দলই তার ছোঁয়াচ থেকে মুক্ত নয়। ইলেক্টোরাল বণ্ড প্রকল্প সাক্ষ্য দিচ্ছে, বিজেপি ঐ লুটের সবচেয়ে বড় অংশীদার।