জন্ম সাবেক জম্মু ও কাশ্মীরের কিস্তওয়ারে। কিন্তু নিজেকে ‘কাশ্মীরী’ বলাটা খুব স্বচ্ছন্দের নয় — ’কাশ্মীরী’ শুনলেই লোকজনের দৃষ্টি, আলাপের ধরনটা কেমন পাল্টে যায়।
দিল্লিতেই শিক্ষা, বড় হয়ে ওঠা। এখন প্রায় পাঁচ মাসের এক সন্তানের মা। সাতাশ বছরের তরুণী র জীবনের যে সময়টায় পরিবারের সান্নিধ্য সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল সেই সময়টা কেটেছে জেলের নির্জন কুঠুরিতে – আইসোলেশন সেলে। কোভিড পরিস্থিতিতে। অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগে, উৎকণ্ঠায়, আশঙ্কায়। শুধু তাই নয়। গর্ভস্থ সন্তানকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিকৃত ও মিথ্যা তথ্য সহযোগে অকথ্য কুৎসা ছড়ানো হয়েছে। চলেছে চরিত্র হনন। একাকী সেলে সেই মানসিক উৎপীড়ন সইতে হয়েছে। মুসলিম বলে বিজেপি’র আই টি সেল হয়তো দ্বিগুণ উৎসাহে এ কাজটা করেছে। মহিলা প্রতিবাদীদের অবশ্য এসব বাড়তি ‘পাওনা’। যেমন অনেক সময়েই ‘ধর্ষণ’ রাষ্ট্রের হাতিয়ার হয়ে ওঠে – দানবীয় আইন প্রয়োগ, বিনা বিচারে আটক ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গে।
প্রতিবাদ করেছিলেন জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের গবেষক সাফুরা জারগর। তিনি বিশ্ব বিদ্যালয়ের মিডিয়া কোঅর্ডিনেটরও বটে। প্রতিবাদ করেছিলেন রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া অন্যায় আইনের বিরুদ্ধে। সিএএ-নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে। দিল্লীর এবং গোটা ভারতের ছাত্রসমাজই তখন গর্জে উঠেছিল। আন্দোলনের এক নতুন পথ দেখিয়েছিল শাহীনবাগের মুসলিম নারীসমাজ।
প্রতিহিংসাপরায়ণ রাষ্ট্র তাই ভরা লকডাউনে ১০ এপ্রিল, ২০২০ গ্রেফতার করে অন্তঃসত্ত্বা সাফুরাকে, জাফরাবাদ পথ অবরোধ মামলায় দায়ের করা এফ আই আর ৪৮/২০২০-র ভিত্তিতে। ১৩ এপ্রিল জামিন হয়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে দিল্লি পুলিশ সাফুরাকে আবার গ্রেফতার করে ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০-তে দায়ের করা এফআইআর-৫৯/২০২০-এ তার নাম জড়িয়ে। অভিযোগ, তিনি ছিলেন ফেব্রুয়ারি, ২০২০-তে ঘটে যাওয়া ‘দিল্লি দাঙ্গার অন্যতম মূল চক্রী ও উস্কানিদাতা’। সঙ্গে ছিল জেএনইউ, জামিয়া মিলিয়া, দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের আরও কয়েকটি নাম।
তথাকথিত দিল্লী দাঙ্গা, যা আসলে ছিল হিন্দুত্ববাদী বিজেপি-আরএসএস-এর এক সুপরিকল্পিত হত্যাভিযান, তার প্রকৃত উস্কানিদাতাদের যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকা সত্ত্বেও দিল্লি পুলিশ আজও (বছর পেরিয়ে গেছে) গ্রেফতার দূরে থাক, তাদের জিজ্ঞাসাবাদও করেনি। কিন্তু জেএনইউ, জামিয়া-র ছাত্রছাত্রীদের জন্য ডাইনি-খোঁজ চলল। গ্রেফতার ও করা হল।
সাফুরার জামিনের আবেদন বার বার নাকচ হয়েছে। সরকারি আইনজীবী যুক্তি দেখিয়েছেন, তিহার জেলে গত দশ বছরে ৩৯টি সন্তান প্রসবের ঘটনা রয়েছে। সুতরাং সাফুরার অসুবিধা হওয়ার কথা নয় ইত্যাদি ইত্যাদি। অনেক টানা পোড়েনের পর, চতুর্থ আবেদনের প্রেক্ষিতে তিন দিনের টানা শুনানির পর ২৩ জুন দিল্লি হাইকোর্ট সাফুরাকে মানবিক কারণে জামিন মঞ্জুর করে। ২৪ জুন তিনি বাইরের মুক্ত আকাশের নীচে এসে দাঁড়ালেন।
সাফুরা জারগরের এই গ্রেফতার ও আটককে রাষ্ট্রসঙ্ঘের মানবাধিকার কাউন্সিল-এর ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ অন আরবিট্রারি ডিটেনশন’ অযৌক্তিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে ঘোষণা করেছে। কারণ তা মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক ঘোষণা (ইউডিএইচআর) এবং নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তিমামা, ভারত যার স্বাক্ষরকারী — তাকেও লঙ্ঘন করেছে। সংস্থাটি আরও জানিয়েছে-মানবাধিকার রক্ষা কর্মী হওয়ার জন্যই সাফুরা স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। সংস্থার পর্যবেক্ষণ – মানবাধিকার কর্মী হওয়ার জন্যই তাকে বৈষম্যের নিশানা করা হয়েছে এবং চুক্তিনামার ২৬নং ধারার অধীনে আইনের চোখে সমানাধিকার ও আইনী সুরক্ষার সমানাধিকার তাঁর ক্ষেত্রে লঙ্ঘন করা হয়েছে। সরকারের নীতি ও কার্যকলাপের বিরুদ্ধে তাঁর রাজনৈতিক অভিমত ও বিশ্বাসের কারণেই ঘটেছে এই অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা-এও পরিষ্কারভাবে জানানো হয়েছে সংস্থার তরফে।
গোটা পরিস্থিতি সাপেক্ষে সংস্থার সুপারিশ — এই অন্যায়ের উপযুক্ত প্রতিবিধান হিসেবে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও অন্যান্য আর্থিক খেসারত মেটানোর দাবি করার জন্য সাফুরাকে কার্যকরী অধিকার দিতে হবে। সংস্থাটি সরকারকে বলেছিল সাফুরাকে স্বাধীনতা-বঞ্চিত করার পুরো বিষয়টির পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ তদন্ত করতে হবে এবং যারা এই অধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।
ওয়ার্কিং গ্রুপ এই অভিমত গ্রহণ করেছিল ২৭ নভেম্বর, ২০২০; কিন্তু তা প্রকাশিত হল এ বছর ১১ মার্চ। সংস্থার দাবি-তারা সরকারকে অভিযোগগুলো জানিয়ে ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০-র মধ্যে বিস্তারিত তথ্য পাঠানোর অনুরোধ জানায়। কিন্তু সরকার তথ্য তো পাঠায়ইনি, এমনকি উত্তর দেবার সময়সীমা বাড়ানোর আবেদনও করেনি।
এই সরকার ‘যথাযথ ক্ষতিপৃরণের’ কোনো পদক্ষেপ নেবে? মানসিক যন্ত্রণার কোনো ক্ষতিপূরণ কি সম্ভব? সে সব প্রশ্ন ব্যতিরেকেই বলা যায়, বিশ্বের দরবারে সরকার নিজেই নিজের মুখ পুড়িয়েছে।
সূত্র: দি লিফলেট ; মার্চ ১৪, ২০২১