শতাব্দীর অভিশপ্ত অধ্যায় অতিমারী পর্ব ধীরে ধীরে সরছে। আবার বসন্ত এসেছে। কোকিল-ডাকা হরিয়ালী আর শিমুল-পলাশ রাঙা দিনে আবার এসেছে আট মার্চ! কিন্তু এই দিনে সেই কন্যারা খুশির আলো ছড়িয়ে চঞ্চল পায়ে আর ঘর-বার করবে না — হাথরাসের সেই দলিত কন্যা কিংবা পাটনার সেই গুলনাজ। এবং আরও অনেক অনেক বালিকা, কিশোরী, তরুণী। বিষাক্ত মানসিকতার বীভৎসতা যাদের স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে, নির্মমভাবে মুছে দিয়েছে চিরতরে। প্রত্যেকটি হত্যা আমাদের মনে গাঁথা আছে! এই বিষ — নারী বিদ্বেষের, জাতি বিদ্বেষের বিষ, ক্রমশ ছড়িয়ে যাচ্ছে সমাজের দেহে। সেই বিষক্রিয়া দেশের প্রশাসন, আইন, বিচার-ব্যবস্থাকেও পঙ্গু করে দিচ্ছে। না হলে দেশের শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতি নাবালিকার হাত পা বেঁধে ধর্ষণে অভিযুক্তকে বলতে পারেন, “তুমি কি মেয়েটাকে বিয়ে করবে?”! বলতে পারেন “আন্দোলনে কৃষাণীরা আর প্রবীণরা কেন?”!
এই ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করেছে বিজেপি-আরএসএস-এর ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন। তাই এবারে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের বার্তা আরও তাৎপর্যপূর্ণ, আরও গভীর। অতিমারির দুঃসময়ে আমরা হারিয়েছি বহু সাহসী কোভিড যোদ্ধাকে, কোভিড আক্রান্ত সহনাগরিকদের। হারিয়েছি দিল্লী সীমান্তে আন্দোলনকারীদের অনেককে। হারিয়েছি সেইসব বন্ধুদের লকডাউনে ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে লাঞ্ছিত অপমানিত হয়ে যারা আত্মঘাতী হয়েছেন। উৎসবের দিনে মনে পড়ে বার বার তাদের কথা। আরও বহুদিন যাদের এই সুন্দর পৃথিবীর বুকে থেকে সমাজটাকে সুন্দর করে গড়ে তোলার কথা ছিল!
হ্যাঁ, আট মার্চ পৃথিবীর সমস্ত নারীর কাছে উৎসবের দিন। আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে দাবি আদায়ের দিন, অধিকার অর্জনের সাফল্য উদযাপনের দিন, আত্মঘোষণার দিন! আগামী সংগ্রামের শপথ নেওয়ার দিন!
সুন্দর প্রকৃতির কোলে সুস্থ উজ্জ্বল কর্মব্যস্ত দিন। কাজ শেষে চমৎকার অবসর, তারপর ঘুম — যে ঘুমে থাকবে না কোনো দুঃস্বপ্নের রেশ। সুস্থ নিরাপদ পরিবেশে আট ঘন্টা কাজ, আট ঘন্টা একেবারে নিজের মনের মতো করে সময় কাটানো, তারপর আট ঘন্টা বিশ্রাম। আর চাই একজন নাগরিকের অধিকার — ভোটাধিকার। এই দাবিতেই প্রায় দেড়শো বছর আগে বার বার উত্তাল হয়েছিল ইউরোপ আমেরিকার রাজপথ। হাজার হাজার নারী শ্রমিক, লক্ষ লক্ষ মানুষ এই অধিকার অর্জনের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। রক্তাক্ত হয়েছিলেন, কারাযন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন, প্রাণ দিয়েছিলেন কতজন! ১৯১১ সালে কমিউনিস্ট নেত্রীদের এক আন্তজার্তিক সম্মেলনে সেই সব দাবি সামনে রেখে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবসের’ সূচনা হয়। অর্থনৈতিক অধিকার, সামাজিক মর্যাদা আর রাজনৈতিক ন্যায়ের জন্য আজও দিনটি উদযাপিত হচ্ছে পৃথিবী জুড়ে।
উপরের দাবিগুলো স্বীকৃত, কিন্তু পৃথিবীর বহু নারীর কাছেই অধরা। স্বৈরাচারী শাসকরা অর্জিত অধিকারগুলোও কেড়ে নিচ্ছে। বিশ্বের নানা প্রান্তে মেয়েরা তাই আজ পথে। খোলা আকাশের নিচে শ্লোগান-উচ্চকিত বিনিদ্র নিশিযাপনে।
যেমন আমাদের ভারতবর্ষে। গত বছর সমান নাগরিকত্বের দাবিতে বিলকিস দাদির নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল দিল্লির ‘শাহীনবাগ’ আন্দোলন এবং দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল দেশজুড়ে। গত বছর নভেম্বর থেকে আবার দিল্লি সীমানায় লাখো কৃষকের আন্দোলন চলছে। তিনটি কর্পোরেটভজা কৃষিআইন বাতিলের দাবিতে। সেখানেও মহিলারা রয়েছেন বিপুল সংখ্যায়, ঘর-বাড়ি, খেত-খামার, ঘরের নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে। আন্দোলনের প্রতিটি পদক্ষেপে তারা পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ছেন। যেমন থাকেন চাষের মাঠে। জমি পরিষ্কার করা থেকে ফসল ঘরে তোলার প্রক্রিয়ার প্রতিটি পর্বে লেগে থাকে তাদের ঘাম-রক্ত। জীবন জীবিকা জমিনের লড়াইয়ে ‘ভাগিদারী’ বুঝে নিতে, বুঝিয়ে দিতে, তাই তারা নিজেদের তাগিদে গ্রাম-গ্রামান্তরে ঘুরে ঘুরে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিয়ে সামিল হয়েছেন সত্যাগ্রহে। টানা তিন মাসের উপর সেখানেই রয়েছেন। রয়েছেন রান্না, সাফাই, বাচ্চা পড়ানো থেকে ট্রাক্টর চালানো পর্যন্ত — প্রতিটি কাজে।
তারা নিজেদের জন্য চান ‘কৃষকের’ স্বীকৃতি, চান পারিবারিক শ্রমের স্বীকৃতি, চান সম কাজে সম মজুরি, ফসলের ন্যূনতম সমর্থন মূল্যের (উৎপাদন মূল্যের দেড় গুণ) আইনি প্রতিশ্রুতি; চান সুষ্ঠু গণবণ্টন ব্যবস্থ। চান না কৃষিতে কর্পোরেট-রাজ। আর অবশ্যই চান প্রধান বিচারপতির মনুবাদী মন্তব্যের প্রত্যাহার!
প্রধানমন্ত্রীর নতুন আখ্যা (বদনাম) ‘আন্দোলনজীবী’ প্রসঙ্গে ভারতের প্রতিটি নারীর স্পর্ধিত ঘোষণা: তারা ‘আন্দোলনজীবী’ কারণ ‘পরজীবী’ কর্পোরেট এবং তাদের দালাল শাসক তাদের ওপর আন্দোলন চাপিয়ে দিয়েছে। গ্যাসের দাম গত দু’মাসে দু’শো পঁচিশ টাকা বেড়েছে। বেড়েই চলেছে। আর ‘ঘরে ঘরে উজালা’ তো স্রেফ ধোঁকাবাজি! রেশনে কেরোসিন অমিল। পেট্রল ডিজেলের লাগামছাড়া দাম বাজারকে আগুন করে তুলেছে। অথচ তাদের হাতের কাজ কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বহুজাতিক কোম্পানির পদস্থ কর্মী থেকে ইটভাটার বা কৃষির মহিলা শ্রমিক লিঙ্গ বৈষম্যের শিকা। ‘ওয়ার্কফ্রম হোম’-এর নামে চলছে শ্রম-লুণ্ঠন! শ্রমকোড বিলে কমেছে কাজের পরিসর ও নিরাপত্তা, সামাজিক নিরাপত্তা। নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্য, খাদ্য সুরক্ষা সহ বিভিন্ন কল্যাণমূলক প্রকল্প থেকে সরকার হাত গুটিয়ে নিচ্ছে। ‘লিঙ্কড ইন অপরচুনিটি ইনডেক্স ২০২১’ বলছে, ৮৫% মহিলা কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার শুধু মহিলা বলে। এর আগে ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম’ জানিয়েছিল মহিলা-পুরুষ বেতন-বৈষম্যের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারত শীর্ষ স্থানে রয়েছে।
এবার তাকাই কেন্দ্রীয় সরকারের বর্তমান আর্থিক বছরের বাজেটে। ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ এবং ‘মাতৃবন্দনা যোজনা’কে ‘সামর্থ্য’ নামে ঢুকিয়ে সামগ্রিক ভাবে মহিলাদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ২৫২৬০ কোটি টাকা যা ২০১৯-২০ সালের প্রকৃত ব্যয় ২৬৭৩১ কোটি টাকার থেকেও কম!
পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোটের আবহে বিজেপি-আরএসএস-এর নির্বাচনী প্রচারে নারী বিদ্বেষের জাতি বিদ্বেষের তীব্র গরল ঝরে পড়ছে। দিলীপ-কৈলাস এবং তাদের অনুগামীরা এমনকি রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীকে পর্যন্ত কুৎসিততম ভাষায় আক্রমণ করছেন। যে যোগীর রাজ্য ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনে শীর্ষস্থানে রয়েছে, তিনিও প্রচারে এসে বলছেন, এখানে নারীরা অরক্ষিত এবং তারা ক্ষমতায় এসে এখানে ‘লাভ জিহাদ’ বন্ধ করবেন! যার অস্তিত্ব স্বয়ং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও প্রশাসনের কর্তারাই অস্বীকার করেছেন! এরা মসনদে আসীন হলে যে সেটা বাংলার মহিলাদের চরমতম দুর্দিন হবে সেটা বুঝতে এখনও বাকি আছে!
বাংলার মহিলারাও লড়ছেন ঋণমুক্তির দাবিতে, রন্ধনকর্মীদের শ্রমিকের মর্যাদা ও স্বীকৃতির দাবিতে। ব্লকে ব্লকে তারা প্রতিবাদ সংগঠিত করছেন। শহরে বড়মাপের সমাবেশের মধ্য দিয়ে তারা প্রশাসনকে প্রতিবাদের বার্তা দিচ্ছেন। কৃষক আন্দোলনের পাশে তারা আছেন।
তেভাগা-তেলেঙ্গানা-নকশালবাড়ি হয়ে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-মুন্নার হয়ে শাহিনবাগ-সিঙ্ঘু টিকরি গাজিপুর বর্ডার — ভারতীয় নারীর আত্মমর্যাদা অধিকার আর ন্যায়ের দাবির লড়াইয়ে এক অনুপম গৌরবোজ্জ্বল রূপকথা, রূপরেখা!
বাংলার পথে প্রান্তরে, গ্রাম্য পথের আঁকে বাঁকে, কুটিরের আঙিনায়, লোককবির মরমী গানে ছড়িয়ে আছে তেভাগা নকশালবাড়ির শহীদ নারীদের কথা। কী অদম্য মনোবলে হাজার হাজার কৃষকরমণী পরাধীন ও স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রশক্তির নির্মমতম অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন! সেই সংগ্রামী ঐতিহ্যের উত্তরসূরী বাংলার নারী — এটা যেন মনে রাখে মনুবাদী গেরুয়া বাহিনী! আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সংগ্রামী ঐতিহ্য দীর্ঘজীবী হোক!