পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় (ব্রুকলিন, নিউ ইয়র্ক, ১৮ই ফেব্রুয়ারী ২০২১)
ঠাকুর রামকৃষ্ণদেবের কাছে প্রার্থনা, ধর্মান্ধ লোভী মিথ্যাচারী ফ্যাসিস্টরা যেন না আসে। আর যেই আসুক, হিটলারপূজক, গান্ধী হত্যাকারীরা যেন না আসে।
যাকে খুশি ভোট দিন। কিন্তু ফ্যাসিস্টদের দেবেন না। বেছে বেছে প্রার্থী দেখে ভোট দিন। দল দেখে নয়।
২০১৯’এর লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে আমি কতগুলো “ভবিষ্যৎবাণী” করেছিলাম, যার অনেকগুলোই এখনো পর্যন্ত মিলে গেছে, এবং বাকিগুলোও মিলে যাবে। আমি যদিও কোনো বরাহমিহির বা আর্যভট্ট নই (অবশ্য বাম ও দক্ষিণ দুদিক থেকেই আমাকে বরাহ সম্ভাষণ মাঝে মাঝেই করা হয়ে থাকে), কিন্তু জীবনের অভিজ্ঞতা ও রাস্তায় নেমে দুই দেশে দীর্ঘকাল রাজনীতি করার সুবাদে কতগুলো সিক্সথ সেন্স বা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তৈরি হয়েছে। যার ভিত্তিতে এই প্রেডিকশনগুলো আমি করি। কে কী ভাবলো, বা আমাকে কোনো পার্টির গুপ্তচর মনে করলো, তাতে আমার গ্রীন প্ল্যানটেন।
“ভবিষ্যৎবাণী” কথাটা উক্তি চিহ্নের মধ্যে দিলাম, কারণ নাহলে মনে হতে পারে আমি কোনো জ্যোতিষী, পীর, দরবেশ, বা গুরুদেব। আমার আবার ঝাড়ফুঁক, হস্তরেখা, কুষ্ঠীবিচারে, গ্রহরত্নে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই। সেনকো পিসিরা আমাকে একেবারেই পছন্দ করবেন না।
যা হতে পারে, তা খুব সংক্ষেপে লিখলাম। সম্ভাবনা। অর্থাৎ, এগুলো হবার সম্ভাবনা খুব বেশি। কোনো জিপসি ক্রিস্টাল বল আমার সামনে নেই। সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু নাও হতে পারে। কিছু হবে পরের দিন থেকেই। বাকিগুলো হবে একটু একটু করে। হবেই — বলতে পারি না। ওই যে বললাম, হবার সম্ভাবনা।
(১) হিন্দি বাধ্যতামূলক হবে স্কুল স্তর থেকে। বাংলা ঐচ্ছিক -- অপশনাল -- বিষয় হিসেবে পড়ানো হবে।
(২) সমস্ত স্টেশন এবং সরকারী অফিসে হিন্দিতে সাইনবোর্ড থাকবে। বাংলা হয় একেবারেই থাকবে না, অথবা খুব গৌণভাবে থাকবে।
(৩) দুর্গাপুজো, কালীপুজো, লক্ষ্মীপুজো বা সরস্বতী পুজোর বাঙালি পদ্ধতিকে ক্রমশ বিসর্জন দেওয়া হবে। তার জায়গায় গুজরাটি, মারাঠি বা পাঞ্জাবি স্টাইলে শাস্ত্রাচার চাপিয়ে দেওয়া হবে। গণেশ চতুর্থী, ধনতেরাস, নবরাত্রি, ছট জাতীয় উৎসব জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হবে।
(৪) বাউল, সুফী, লালন, রাস, সংকীর্ত্তন এবং হাজার লোকায়ত সংস্কৃতি, সঙ্গীত, শিল্প ইত্যাদি রাষ্ট্রের নিষ্পেষণের শিকার হবে। আকাশবাণী রেডিওতে বাংলা প্রোগ্রাম আরো সঙ্কুচিত করা হবে, এবং হিন্দি মাধ্যমের অনুষ্ঠান আরো বেশি প্রসারিত হবে।
(৫) বলিউডের স্টাইলে টলিউড সিনেমা তৈরি হবে (ধরে নিন আজকের গেরুয়া সিন্নি বাংলা টিভি সিরিয়ালের নবকলেবর), যেখানে বাংলার বুদ্ধিজীবিতার আর কোনো সুযোগ থাকবে না। মৌলবাদী হিন্দু ধর্মভিত্তিক সিনেমা অনেক বেশি জাঁকিয়ে বসবে, এবং যে কোনো সৃষ্টি -- সিনেমা থিয়েটার ছবি থেকে যাত্রাপালা -- যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার বা ঈশ্বর-অবিশ্বাসের কোনোরকম ইঙ্গিত আছে, তা নির্দয়ভাবে বন্ধ করা হবে। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক বা তপন সিংহকে আস্তে আস্তে মুছে দেওয়া হবে চেতনা থেকে।
(৬) বাংলাদেশকে শত্রুদেশ হিসেবে ক্রমশ আরো বেশি করে চিহ্নিত করা হবে, ঠিক যেমন এখন পাকিস্তানকে করা হয়েছে। মুসলমানদের ওপর নতুন নতুন নিষ্পেষণ ও নির্যাতন বাড়বে, এবং বাংলায় নতুন করে জাতের রাজনীতি শুরু হবে। উঁচু জাত, নীচু জাত। মুসলমান নিপীড়ণের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশে ধর্মান্ধ হিন্দুবিদ্বেষী ও ভারতবিদ্বেষী চরমপন্থী ইসলামীরা আরো শক্তিশালী হয়ে উঠবে, এবং “শত্রুদেশ ভারতের চর” হিন্দুদের ওপর নতুন করে নির্যাতন শুরু হবে।
(৭) বাংলার ঐতিহ্যবাহী ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দেওয়া হবে। অর্থাৎ, যে কটা কংগ্রেস, সিপিএম, তৃণমূলের জমানার সর্বনাশের হাত থেকে এখনো বেঁচে আছে। হয় আম্বানি আদানি জাতীয় বিলিয়নেয়ার কর্পোরেট হাউসের হাতে তুলে দেওয়া হবে, আর নয়তো কৌশল করে শুকিয়ে মারা হবে। যেমন, বেঙ্গল কেমিক্যাল, চায়ের বাগান, বস্ত্র ও পাট, গঙ্গার দুই তীরের কলকারখানাগুলো, অথবা পরিবহন ও ট্যুরিজম।
(৮) জিনিষপত্রের দাম এখন যা দেখছেন, তার তিনগুণ হয়ে যাবে। এখন যদি একশো টাকায় এক লিটার তেল পান এবং কেন সারা পৃথিবীতে তেলের দাম কমে গেছে কিন্তু আমাদের দেশে তা এতো বেশি -- তার উত্তর না পান, তখন তিনশো টাকায় কিনলেও কোনো প্রশ্ন করতে পারবেন না। সেইরকম আর সব জিনিসপত্রের দামও তিনগুণ হয়ে যাবে, কারণ অর্থনীতিটাই বিলিয়নেয়ার কর্পোরেট হাউস এবং কালো টাকার হাতে তুলে দেওয়া হবে।
(৯) সরকারী চাকরি ক্রমে সম্পূর্ণবিলুপ্ত হবে। সরকারী সমস্ত কাজকর্মপ্রাইভেট হাউস চালাবে -- কয়েক বছরের মধ্যেই।
(১০) সারা ভারতে এবং পশ্চিমবঙ্গেও রাজনৈতিক বিরোধিতা আইন করে নিষিদ্ধ হবে, এবং সংবিধান বদলে ফেলে ধর্মনিরপেক্ষ বা অ-হিন্দু ধর্মের সংগঠন সব নিষিদ্ধ হবে।
(১১) রবীন্দ্রনাথকে সমস্ত পাঠ্যক্রম থেকে তুলে নেওয়া হবে, এবং জাতীয় সঙ্গীত বদলে দেওয়া হবে। বিশ্বভারতীকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা থেকে বাতিল করা হবে। বিশ্বভারতী বা এই জাতীয় ঐতিহাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানকে ছলে বলে কৌশলে নিষ্পেষিত করা হবে।
(১২) বাঙালির ইতিহাস সমস্ত ভুলিয়ে দেওয়া হবে। বিশেষ করে নারীর অধিকার, গরিবের অধিকার, এবং অন্যান্য যেসব সমাজসংস্কারমূলক আন্দোলন গত দুশো বছর ধরে হয়ে এসেছে -- যেমন বেঙ্গল রেনেসাঁস বা নবজাগরণ -- তার সম্পূর্ণ বিকৃতকরণ করা হবে। রবীন্দ্রনাথের মতোই নজরুল, লালন মুছে যাবেন। স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে কোনো আলোচনা আর পাঠ্যবইতে থাকবে না, কারণ আরএসএস স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শতহস্ত দূরে ছিল। শ্যামাপ্রসাদ, বা এই জাতীয় হিন্দু মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্বকে বাংলার প্রধান ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্থাপিত করা হবে।
সবাই বিন্দাস থাকুন। আচ্ছে দিন আসছে।
আবার বলছি, সম্ভাবনা। “ভবিষ্যৎবাণী” সে অর্থে নয়। এসব কিছু না হলে আমিই সবচেয়ে বেশি খুশি হবো।