প্রতিবেদন
গত ১০ বছরে ১১২.৫ লক্ষ কর্মসংস্থানের গল্প এবং আগামী ৫ বছরে ১৫০ লক্ষ কাজের ভাঁওতা
Last 10 Years

সারা ভারতের অর্থনীতি যখন নিম্নগামী সেই সময়ে রাজ্যের মোট আভ্যন্তরীণ উৎপন্ন বেড়েছে। ২০১৮-১৯ সালের হিসেব অনুযায়ী তা বেড়ে ছিল ১২.৫৮% হারে। গত বছরের বাজেট বক্তৃতায় সে হার কমিয়ে ১০.৪%-তে আসার কথা বলা হয়েছিল, তবে ২০২০-২১এর ইকোনোমিক রিভিউ অনুযায়ী তা কমে দাঁড়িয়েছে ৭.২৬%। ২০২০-২১ সালের অনুমান অনুযায়ী বৃদ্ধির হার কমে ১.২% হবে, তা গত কয়েক বছরের তুলনায় কম হলেও, সারা দেশের ক্ষেত্রে অনুমান যখন -৭.৭%, তখন মমতাদেবী বলতেই পারেন, আমরাই সেরা। কেবল সামগ্রিক উৎপাদনের ক্ষেত্রেই নয়, শিল্পোৎপাদন সূচকের নিরীখেও পশ্চিমবঙ্গ ভারতকে পিছনে ফেলেছে। রাজ্য কর্তৃক প্রদত্ত পরিসংখ্যানের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাচ্ছে যে, জিএসডিপি বৃদ্ধি সত্যিই চমকপ্রদ; গত ৫ বছরে যথাক্রমে ৬.১৩%, ৭.২০%, ৮.৮৮%, ১২.৫৮% ও ৭.২৬% ও ১.২%। এই হারে বৃদ্ধি ঘটলে রাজ্যের আয় বৃদ্ধিও অতি দ্রুত ঘটা উচিৎ। কর রাজস্ব বাড়া উচিৎ। কিন্তু ২০২০-২১ সালের রাজস্ব আদায়ে তা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ইকোনোমিক রিভিউর তথ্য অনুসারে ২০২০-২১ সালে বাজার চলতি মূল্যে রাজ্যের অভ্যন্তরীণ উৎপন্ন বাড়বে ৮% (২০১৯-২০র তুলনায়), কিন্তু ২০১৯-২০ সালের তুলনায় কর রাজস্ব আদায় কমবে, ৪%-এর বেশি। কর বহির্ভুত রাজস্বের ক্ষেত্রে সেই পতন আরো ভয়াবহ, ৩৩%। তাই বাজেট বা ইকোনোমিক রিভিউতে প্রকাশিত রাজ্যের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির তথ্যকে নির্দ্বিধায় মেনে নেওয়া যাচ্ছে না।

রাজস্ব সংক্রান্ত সমস্ত ধরনের যুক্তরাষ্ট্রিয়বাদকে আত্মসাৎ করে নেওয়া জিএসটি নামক অতি কেন্দ্রিকৃত কর ব্যবস্থা চালু হয়ে যাওয়ার পরে সরকারি বাজেটে সম্পদ সংগ্রহের কোনো অভিনব বন্দোবস্ত করার কোনো রাস্তা রাজ্য সরকারের অর্থমন্ত্রীর থাকে না। তিনি কেবলমাত্র খরচের ক্ষেত্রেই উদ্ভাবনী চিন্তার পরিচয় দিতে পারেন। যার মধ্য দিয়ে রাজ্যে কর্মসংস্থান, শিক্ষার প্রসার, স্বাস্থ্য পরিষেবার সহজ প্রাপ্যতা ও গুণমান বৃদ্ধি প্রভৃতি ঘটানো যেতে পারে। তেমন কোনো নতুন ভাবনা চোখে পড়বে না। ২০২০-২১ সালের বাজেট বরাদ্দের তুলনায় অর্থমন্ত্রীর পেশ করা বাজেটে উল্লেখিত সংশোধিত বরাদ্দ প্রায় সব খাতেই কম দেখা যাচ্ছে, অর্থাৎ সম্পদ সংগ্রহের ব্যর্থতা রাজ্য সরকারকে ব্যয় ছাঁটাই করতে বাধ্য করেছে। স্বাস্থ্য-পরিবার কল্যাণ ও পুষ্টি-সামাজিক কল্যাণ ব্যতিরেকে সমস্ত খাতেই আনুমানিক সংশোধিত ব্যয়ের পরিমাণ প্রাথমিক বাজেটের তুলনায় কম, কিছু কিছু কাতে তা অর্ধেকেরও কম। কৃষি খাতেই ওই আনুমানিক সংশোধিত ব্যয়ের পরিমাণ, ৪৮৭১ কোটি টাকা প্রাথমিক বাজেট বরাদ্দ, ১০৬৪৮ কোটি টাকার তুলনায় মাত্র ৪৬%। শিল্প ও খনিজ খাতেও ওই সংশোধিত আনুমানিক ব্যয় মাত্র ৬৪৪ কোটি টাকা, প্রকৃত বাজেট বরাদ্দ ২১৮৬ কোটি টাকার ৩০% এর ও কম।

একদিকে ২০২০-২১ এর বাজেট বরাদ্দ্দের তুলনায় সংশোধিত অনুমানে সর্বত্র ব্যয় কমেছে, স্বাস্থ্য-পরিবার কল্যাণ, পুষ্টি-জনকল্যাণ ও ঋণ ও সুদ প্রদান ব্যতিরেকে; অন্যদিকে ২০২১-২২-এর বাজেট বরাদ্দ বিপুল পরিমাণে বাড়ানো হয়েছে। ঋণ ও সুদ প্রদান বাদ দিলে গত বছরের বাজেটের তুলনায় বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে ২০%; আর সংশোধিত ব্যয়ের তুলনায় তা বাড়ানো হয়েছে ৩২%-এর বেশি। যেহেতু নির্বাচনী বছরের বাজেট, তাই বিবিধ প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দেওয়া হয়েছে বাজেটে। বাজেটের অব্যবহিত আগেই সবার জন্য স্বাস্থ্যবীমার ঘোষণা করা হয়েছে স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পকে সমস্ত রাজ্যবাসী নাগরিকদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়ে। এর পরেই বাজেটে সমস্ত বয়স্ক (৬০ বছরের উপর) ও সমস্ত বিধবাদের (১৮ বছরের উপর) জন্য মাসিক ১০০০ টাকা পেনশনের ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু কোথা থেকে এই অর্থ সংস্থান করা হবে সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে কর ও করবহির্ভুত রাজস্ব (কেন্দ্রের কাছ থেকে পাওযা গ্রান্ট-ইন এইড বাদ দিয়ে) আদায় হয়েছিল ১১২ হাজার কোটি টাকা, ২০২০-২১ অর্থবর্ষেসেই আদায়ের আনুমানিক পরিমাণ (সংশোধিত) ১০৬ হাজার কোটি টাকা (যদিও ওই বছরের বাজেটে ধরা হয়েছিল আয় হবে ১৪১ হাজার কোটি টাকা)। ২০২১-২২ অর্থবর্ষে কর ও কর বহির্ভুত রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ধরা হয়েছে ১৫১ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ বৃদ্ধির পরিমাণ ৪২% এর বেশি। এই বিপুল পরিমাণ আয়বৃদ্ধি এই আর্থিক মন্দার সময়ে প্রায় অসম্ভব। বাজেট যেহেতু এই কল্পনার উপরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে তাই পুরো বাজেটটাই এক প্রকার ভাওতা।

নির্বাচনী বছরে ভোট অন এ্যাকাউন্ট পেশ করতে গিয়ে বিভিন্ন জনমোহিনী প্রকল্পের ঘোষণা করাটা ভারতীয় ‘গণতন্ত্রে’ নিয়মে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। ভোট অন এ্যাকাউন্ট পেশের নামে পূর্ণাঙ্গ বাজেট পেশ করার অসদাচার নরেন্দ্র মোদির সরকার শুরু করেছিল ২০১৯-২০ সালের ভোট অন এ্যাকাউন্ট পেশ করার সময়ে। তাকে ট্রাডিশনে পরিণত করতে মমতা ব্যানার্জী-অমিত মিত্র এগিয়ে এসেছেন। গত ১০ বছরে যেসব কাজ মনে পড়েনি তা এই নির্বাচনী বছরে কাজে লাগানো হল। ঠিক যেমন ২০১৯-এর ভোট অন এ্যাকাউন্ট পেশের সময়ে সব রীতিনীতি ভেঙে পিএমকিষান প্রকল্পকে অতীত দিন থেকে কার্যকরী করেছিল মোদি-গোয়েল জুটি, প্রায় তেমনই বাজেটে বয়স্ক ও ১৮ বছরের বেশি বিধবাদের জন্য ১০০০ টাকার পেনশন ঘোষণা করা হল। কোনো নিয়মকানুন কিন্তু তৈরি হল না, কারা তা পাবে কারা তা পাবে না জানানো হল না। বাজেট পেশের মাস দুয়েক আগেই যেমন সকলের জন্য পরিবারপিছু বার্ষিক ৫ লাখ টাকা অবধি হাসপাতাল খরচ প্রদানকারী স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প ঘোষণা করা হয়, কেবল ভোট পাওয়ার জন্যই তো। ঘোষণা অনুযায়ী এই বাজেটে নতুন প্রকল্পের পেনশনের জন্য ১০০০ কোটি টাকা বরাদ্দের কথা বলেছেন মমতা ব্যানার্জী। যেহেতু বিভিন্ন পেনশন প্রকল্প আগে থেকেই বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য চালু আছে, তাই কতজন মানুষ এই প্রকল্পে আসবেন তা বলা যাচ্ছে না। তবে ১০০০ কোটি টাকায় সাকুল্যে ৮.৩৩ লাখ মানুষকেই ওই পেনশন দেওয়া যেতে পারে। ফলে বাজেট বরাদ্দ পেনশন দেওযার জন্য যথেষ্ট বলে মনে হচ্ছে না।

এই বাজেট কর্মসংস্থানের ব্যাপারে কোনো দিকনির্দেশ দেখাতে পারেনি। গত ১০ বছরে ১১২.৫ লক্ষ কাজ সৃষ্টি করার কথা বলা হয়েছে। যদি তেমনটা হত তাহলে এরাজ্য থেকে ভিন রাজ্যে লক্ষ লক্স শ্রমিক কাজ করতে যেত না। যে চিত্র লকডাউনের সময় ফুটে উঠেছে। আগামী ৫ বছরে ১৫০ লক্ষ কর্মসংস্থানের স্বপ্ন ফেরি করেছে সরকার, যার জন্য বিভিন্ন প্রকল্পে ১২ হাজার কোটি টাকার সংস্থান নাকি রাখা হয়েছে এই বাজেটে। যদি ৫ বছরে তার ৫ গুণ অর্থাৎ ৬০ হাজার কোটি টাকার সংস্থানও ধরা হয় তাহলেও জন পিছু ৪০ হাজার টাকা বিনিয়োগে কর্মসংস্থানের ভাবনা সুপ্ত রয়েছে। একজনকে কাজ দিতে ৪০ হাজার টাকা অত্যন্ত অপ্রতুল। ফলে এই কর্মসংস্থানের ঘোষণাটিও আরেকটি ভাওতা। রাজ্য জুড়ে সরকারী দফতরে শূন্যপদ, কেবল অস্থায়ী ক্যাজুয়াল বা চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগ, নিয়োগে অকাতর দুর্নীতি; আর অপরদিকে গত ১০ বছরে ১.১২৫ কোটি কর্মসংস্থানের ভাষণ, এবং ভবিষ্যতে ৫ বছরে ১.৫ কোটি কর্মসংস্থানের ভাওতা, পশ্চিমবঙ্গের ২০২১-২২ সালের বাজেটে এটাই ‘প্রাপ্তি’।

- অমিত দাশগুপ্ত  

খণ্ড-28
সংখ্যা-6