মাসের ১ তারিখে যখন বাজেট পেশ করা শেষ করলেন অর্থমন্ত্রী ঘড়ির কাটা তখন বেলা ১টা ছুঁতে যাচ্ছে। টিভির পর্দায় অর্থনীতিবিদ ব্যবসায়ীরা দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনায় বসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এমন সময়ে রাস্তায় ফেরিওয়ালার হাঁক শুনতে পেলাম, “মাছ চাই মাছ, কাতলা, চিংড়ি, পার্সে মাছ”। যেহেতু অবসর নিয়েছি বেশ কয়েক বছর হল তাই দুপুরবেলায় অনেকদিনই বাড়িতে থাকি; কিন্তু দুপুর দেড়টার সময় অবিক্রিত মাছ বিক্রির জন্য হাঁক সচরাচর শোনা যায় না। অতিমারীর গোড়া থেকেই ঘরের দোরে সব্জি মাছ মশলা আসছে; ওই মাছ মিষ্টি আর মোরের মতো। তবে অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে বলে গত কয়েক মাস ধরে শুনলেও অতিমারীজনিত লকডাউনের কারণে সব্জি-মাছ বিক্রির পেশায় আসা ফেরিওয়ালাদের সংখ্যা ও অসময়ের হাঁক কমছেই না। তাহলে নির্মলাজি কি নির্মল রসিকতা করে মিথ্যে বলছেন? ওঁরা ‘পবিত্র’ সংসদে দাঁড়িয়ে অসত্য বলবেন এমনটাতো হতেই পারেনা, তাছাড়া যেখানে ‘সর্বজনপ্রিয়’ মোদীজিও টেবিল চাপড়ে সাবাশ জানাচ্ছেন। ফলে সীতারামন সত্য, বাজেট বক্তৃতা সত্য, শেয়ার বাজার সত্য; মাছ সব্জির ফেরিওয়ালারা মিথ্যে। ওঁদের অবস্থা স্বাভাবিক হওয়া সত্বেও অতিমারীতে অতি লাভের লোভ তৈরি হয়েছে তাই এখনো সারাদিন মাছ বেচে চলেছে। বছর ঘুরতে চলল সেই ঘোষণার যেদিন মাননীয় প্রধান সেবক ৪ ঘন্টার নোটিশে ভারত বন্ধ ডেকে দিয়ে পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনী দিয়ে লাখো লাখো ঘর ছেড়ে কাজের খোঁজে যাওয়া শ্রমিকদের না খাইয়ে মারার বন্দোবস্ত করেছিলেন; বলেছিলেন, মাত্র ২১ দিনে করোনাসুরকে পরাস্ত করবেন তিনি। ১১ মাস কেটে যেতে চলল সেই শ্রমিকরা কাজ হারালেন, আবার কাজের খোঁজে ভিন দেশে পাড়ি দিলেন, করোনায় ভারতে লক্ষাধিক মানুষ সরকারী হিসেবেই মারা গেলেন, আক্রান্ত হলেন তার শতগুণ। তবু করোনার এখনো সুরাহা হলো না। মধ্য এশিয়া বাদে সারা মহাদেশে এদেশে কোভিডের প্রকোপ সর্বাধিক, জনসংখ্যা পিছু মৃত্যুর হার সর্বোচ্চ। তবু নির্মলারা আমরা করোনা মোকাবিলায় সব থেকে এগিয়ে বলে নির্মম রসিকতা করতে পারেন। অন্যদিকে করোনাজনিত অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে ভারতবর্ষের অবস্থা বৃহৎ অর্থনীতিগুলির মধ্যে বেশ করুণ। ততোধিক দূরবস্থা দেশের খেটে খাওয়া শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষের, যারা রুজি হারিয়েছেন, কোনোমতে রুটির জোগাড়ে প্রাণপাত করছেন। বেলা দেড়টা দুটোর সময়েও মাথায় মাছের ঝুড়ি নিয়ে মাছ চাই মাছ বলতে বলতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
এই সরকারের নেতা মন্ত্রীরা রামের থেকে নাথুরামকেই বেশি আপন করে রেখেছেন হৃদয়ে, প্রধানমন্ত্রীও। যদিও বাইরে তারা রাম ভক্ত, অন্তরে নাথুরাম। প্রধানমন্ত্রী গান্ধীকে ব্যবহার করেন ভোটের জন্য, গডসেকেও বাদ দেননা। এমন দ্বিচারিতায় পান্ডিত্য অন্য কোনো শাসকের আয়ত্বে ছিল বলে মনে পড়ছে না। যে প্রধানমন্ত্রী মহাত্মা গান্ধীকে মেনে চলার ভান করেন তাকে যদি প্রশ্ন করা যায় যে, গান্ধীজি বলেছিলেন, কোন একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ে ভেবে দেখতে যে তা সমাজের সবথেকে পিছিয়ে পড়া দরিদ্রতম মানুষের কী উপকারে আসবে, তাই এই বাজেট, গত ৬ বছরের বাজেট অর্থনৈতিক নীতি ও কৌশল দেশের হতদরিদ্র গরিব মানুষগুলির ঠিক কী কী উপকার করেছে? উত্তরে তিনি অনন্ত মিথ্যে বলতে পারবেন, মিথ্যে পরিসংখ্যান হাজির করবেন তার পারিষদরা। কিন্তু বোধহয় কোন ফুটপাথবাসি দরিদ্র নাগরিককে খুঁজে পাবেন না যিনি তাঁর প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় গৃহের সংস্থান করেছেন। যদিও গত কয়েক বছরের অর্থনীতির গরিমা কীর্তনে আগের ৬টি বাজেটের মত এ বাজেটও দরাজ।
বাজেটের মূল সুর অতি ধনী পুঁজিপতিদের কাছে দেশের অর্থনীতিকে তুলে দেওয়ার, সেই পুঁজিপতিরা বিদেশি পুঁজির তাঁবেদারিও করবে। অন্যদিকে স্বাস্থ্য ও পরিশ্রুত পানীয় জল সরবরাহের জন্য অতিরিক্ত কিছু টাকা বরাদ্দের কথায় বাজেট বক্তৃতাকে ভরিয়ে দিয়ে গরিব জনগণের জন্য সামাজিক দায়িত্ব পালনের কাজটি শেষ করা হয়েছে। সারা বছর শাসক দল ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতিকে হাতিয়ার করে, সমাজকে পশ্চাদমুখি করার ভাবনাকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে ক্ষমতা বজায় রাখার সমস্ত কদর্যতাকে প্রকট করে তোলে। কিন্তু বাজেট অথবা অন্য কোন অর্থনৈতিক নীতি বা আইন প্রণয়নের সময় খেয়াল করিয়ে দেয় যে দেশে আসলে দু’ধরণের মানুষ আছে, ধনী ও গরিব; পুঁজির মালিক শাসক নাগরিক হিসেবে ও শ্রমিক-কৃষক মেহনতি মানুষ প্রজা হিসেবে। বরাবর এ’কথাকে স্পষ্ট করে দেয় যে, দেশের উৎপাদন, আইন-শৃঙ্খলা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ বিষয়ে চিন্তা করা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার কেবল শাসক দলের, আর সে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে ধনী অর্বুদপতি (বিলিওনেয়ার) পুঁজির মালিকদের কথা মাথায় রেখে। বিশ্বজোড়া অতিমারী, দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ভয়ানক ভাবে ঋণাত্মক, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শিল্প ধুঁকছে, ফুটপাথের হকার, চা-দোকানি, রেলওয়ে হকার, স্টল, পরিবহণ কর্মী, ছোট রেস্তোরার মালিক-শ্রমিক, ভ্রমণ ব্যবসায়ে নিযুক্ত লক্ষ লক্ষ শ্রমিক, গৃহপরিচারিকা, সংগঠিত ক্ষেত্রের কাজ হারানো শ্রমিক কর্মচারি গত এক বছর ধরে কোনো রকমে টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তারা তাদের আয় খুইয়েছে। কিন্তু দেশের অর্বুদপতিদের সম্পদ বেড়েছে ১৩ লক্ষ কোটি টাকার। তাদের হাতে অঢেল অর্থ। জনমুখি সরকারের দায়িত্ব সেই অতিরিক্ত সম্পদ ও আয়ের একটি অংশকে সরকারী কোষাগারে নিয়ে তাকে পুনর্বন্টনের মাধ্যমে অতিমারীর ফলে আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজনের কাছে পৌঁছে দিয়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার। এই ধনী অর্বুদপতিদের তাঁবেদার সরকার তা করতে নারাজ। ফলে কর না বসিয়ে সেই ধনীদের কাছে সরকারী সম্পত্তি বিক্রি করে দেওয়ার ভাবনায় মশগুল মোদী, নির্মলারা। বিপদে পড়ে গৃহকর্তা অসহায় জমিদার যেমন পূর্বপুরুষের সঞ্চিত সম্পদকে নিলামে তোলে, আর তার অপেক্ষায় থাকে নিলামের দোকানি ও নিলামের ক্রেতারা, ঠিক সেভাবেই দেশের সঞ্চিত রাষ্ট্রায়ত্ব কোম্পানিগুলিকে নিলামে তোলার ঘোষণা করেছে সরকারি অছিরা। সেই নিলামে দেশকে বেচা হবে, বিক্রি করা হবে সেই সব অর্বুদপতিদের কাছে যারা এই অতিমারিতে অতি ধনী থেকে অতি অতি ধনী হয়েছে। যে অর্থ অর্বুদপতিদের কাছ থেকে কর বসিয়ে আদায় করা যেত, সরকারের করার হক ছিল, সেই অতিরিক্ত সম্পদকেই সেই অতি অতি ধনীরা ব্যবহার করবে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্ক, বীমা, বিমান কোম্পানিকে নিজেদের কুক্ষিগত করার জন্য। কর্পোরেট পুঁজির কাছে মাথা বিক্রি করে দেওয়া এই শাসকদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে আদানি আম্বানিরা যে চাইবেই তাতে আশ্চর্যের কিছুই নেই।
দেশের অর্থনীতিকে জনমুখি করে তোলার কোন আন্তরিক বাসনা যে সরকারের নেই তা রাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক মোর্চা সরকারের প্রতিটি বাজেটেই প্রকট। ইচ্ছেমতো পরিসংখ্যান ব্যবহার করা তার মধ্যে অন্যতম, অবশ্য ফরমায়েশি পরিসংখ্যান প্রস্তুত করানোও আরেক বড় চালাকি। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা যে জটিলতার মধ্যে পড়েছে তা অস্বীকার করার মধ্যে নিজস্ব বীরত্ব ঘোষণার মোদী সুলভ আত্মম্ভরিতা থাকলেও আমজনতার যা প্রয়োজন, কর্মসংস্থান, খাদ্য সুরক্ষা, শিক্ষা সেসবের প্রতি দৃষ্টি নেই। মনে রাখা দরকার গত ২০১৮ সালের গোড়া থেকেই ভারতীয় অর্থনীতির বৃদ্ধি ক্ষয় পেতে শুরু করেছে। কোভিড আক্রান্ত হওয়ার আগের ৭টি ত্রৈমাসিকের প্রত্যেকটিতেই বৃদ্ধির হার তার আগেরটির তুলনায় কম ছিল। অর্থাৎ অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ক্রমাগত কমছিল। কিন্তু যেহেতু পুলওয়ামা-বালাকোটকে হাতিয়ার করে মেকি দেশপ্রেমের জোয়ারে দেশকে ভাসিয়ে মোদী পুনরায় ক্ষমতায় বসতে পেরেছেন তাই অর্থনীতির বেহাল অবস্থাকে থোড়াই কেয়ার করে এই সরকার। দেশের এক বড় সংখ্যক মানুষের হাতে যখন কাজ নেই বা থাকলেও যথেষ্ট আর্থিক সঙ্গতি তৈরি করতে তা অপারগ তখন চাহিদা তৈরির জন্য শ্রমজীবীদের আয় বাড়ানোর প্রচেষ্টা গ্রহণে সরকারের দায় ছিল। কিন্তু কৃষিক্ষেত্রের দু’টি চাহিদা বৃদ্ধি করার মতো প্রকল্পেই ব্যয় বরাদ্দ কমানো হল। ১০০ দিনের কাজে সংশোধিত বাজেট অনুমান অনুসারে ১১১ হাজার কোটি টাকাকে কমিয়ে ৭৩ হাজার কোটি টাকায় নিয়ে আসা হল যা আদতে ২০১৯-২০ সালের বাজেট বরাদ্দের অনুরূপ। ফলে দু’বছরে যে মুদ্রাস্ফীতি-জনিত মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে তাকে ধরলে কাজের পরিমাণ ২০১৯-২০র তুলনায় ১৫-২০ শতাংশ কমবে ধরা যেতে পারে। অন্যদিকে সারা দেশ জুড়ে যখন কিষাণ আন্দোলন চলছে সেই সময়ে পিএম কিষান প্রকল্পে বরাদ্দ ৭৫ হাজার কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৬৫ হাজার কোটি টাকা করা হল। বাজেট বক্তৃতায় স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির পরিমাণকে ১৩৭% বাড়ানোর কথা বলা হলেও, স্বাস্থ্য পরিকাঠামো বা সরাসরি স্বাস্থ্যখাতে তেমন বৃদ্ধি তো হয়ইনি বরং সংশোধিত বাজেট বরাদ্দ, ৮২,৪৪৫ কোটি থেকে কমে তা ৭৪,৬০৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। যদিও পানীয় জল ও নিকাশি ব্যবস্থার জন্য বরাদ্দ বর্ধিত অর্থ ও কোভিড প্রতিষেধক টিকার জন্য ৩৫ হাজার কোটি টাকাকে ধরে অর্থমন্ত্রী ওই ১৩৭% বৃদ্ধির গল্পটি ফেঁদেছেন। পরিকাঠামোক্ষেত্রকে শক্তিশালী করার কথা বারবার উচ্চারিত হলেও যে সমস্ত ঘোষণা করা হচ্ছে তা অনেকটাই কল্পিত ও আগামী কয়েক বছর ধরে চলবে, হযতো নাও রূপায়িত হতে পারে। যেসমস্ত রাজ্য নির্বাচনের মুখোমুখি যেমন পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, কেরালা, তামিলনাড়ু সেই সমস্ত রাজ্যে বিজেপি যাতে এই করেছি সেই করেছি বলে ভোট চাইতে পারে তাই সেই সমস্ত রাজ্যে রাস্তা বা অন্য পরিকাঠামোর প্রকল্পের কথা ঘোষণা করা হয়েছে, যেগুলি যদি রূপায়িতও হয় তাহলেও তা চলবে ৫-১০ বছর ধরে।
অনেক ক্ষেত্রে নির্মলাজি একই কুমিরছানাকে বার বার দেখালেন। আগেই ঘোষিত হওয়া প্রকল্পকে আবার ঘোষণা করলেন। কৃষকদের আন্দোলনকে অযৌক্তিক প্রমাণের জন্য সরকার ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ফসল কেনার জন্য ব্যয় কত বাড়িয়েছে তা দেখানোর জন্য বাজেট বক্তৃতায় সংযোজনীও জুড়লেন। কিন্তু কেন পিএম-কিষাণ যোজনায় বরাদ্দকৃত অর্থ খরচ হলনা বা বরাদ্দ কেন কমানো হল সেব্যাপারে একটি কথাও বললেন না। জানালেন না কীভাবে ওই প্রকল্পের ১,৩০০ কোটি টাকা নয়ছয় হয়েছে। অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নতি নিয়ে প্রতিনিয়ত বক্তৃতা শোনা যায় এই সরকারের নেতা মন্ত্রীদের মুখে। এই অতিমারীর সময়ে সংশোধিত বাজেট বরাদ্দ অনুসারে অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প মন্ত্রকের ২০২০-২১ সালের বাজেট বরাদ্দ ৭,৫৭২ কোটি টাকা থেকে কমে ৫,৬৬৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে যা ২০১৯-২০ সালের প্রকৃত ব্যয়ের থেকে ২,০০০ কোটি টাকা বা প্রায় ১৫% কম। ওই শিল্পকে উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের তত্ব যে কতটাই কল্পকথা তা এই পরিসংখ্যান বুঝিয়ে দিচ্ছে। মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট প্রকল্প, ‘বেটি ,বাঁচাও বেটি পড়াও’, ‘প্রধানমন্ত্রী মাতৃ বন্দনা যোজনা’কে ‘সামর্থ্য’ নামের মধ্যে ঢোকানো হয়েছে। সামগ্রিকে নারীদের জন্য নির্দিষ্ট যে বাজেট বরাদ্দ তা গত বছরের বাজেট বরাদ্দ, ২৮,৫৬২ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ২৫,২৬০ কোটি টাকা করা হয়েছে, যা ২০১৯-২০ সালের প্রকৃত ব্যয় ২৬,৭৩১ কোটি টাকার থেকে কম, আর ২০২০-২১’র সংশোধিত অনুমান ৬৬,০১৪ কোটি টাকার ৫ ভাগের ২ ভাগ মাত্র। মহিলাদের সামর্থ্য বাড়াতে সরকারের আন্তরিকতা বোঝাই যাচ্ছে। অনুরূপে শিশুকল্যাণের জন্য সামগ্রিক বরাদ্দ ২০২০-২১’র বাজেটের ৯৬,০৪২ কোটি থেকে কমিয়ে ৮৫,৭১২ কোটি টাকায় নিয়ে আসা হয়েছে। এক্ষেত্রেও সুসংহত শিশু উন্নতি প্রকল্প (আইসিডিএস)কে ‘সক্ষম’ নামকরণ করে আত্মশ্লাঘা অনুভব করেছে সরকার। কিন্তু গত ২০২০-২১ সালে আইসিডিএস ও সহযোগী খাতে বরাদ্দ ছিল ২৮,৫৫৭ কোটি টাকা; তাকে ২০,১০৫ কোটি টাকায় কমিয়ে সক্ষমে রূপান্তর করা হয়েছে। ২০২০-২১ বাজেটে আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ৬,৪০০ কোটি টাকা। অতিমারি সত্বেও সংশোধিত অনুমানে খরচ হবে ৩,১০০ কোটি টাকা (২০১৯-২০তে প্রকৃত ব্যয় ৩,২০০ কোটি টাকা); এবার বাজেটেও বরাদ্দ করা হয়েছে ৬,৪০০ কোটি টাকা। জনসংখ্যা বাড়লেও বরাদ্দ বাড়ছেনা, ব্যয়ও কমছ,। গুরুত্বপূর্ণ যে খরচের খাতগুলি রয়েছে তার দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে যে, প্রায় সবক্ষেত্রেই ২০২০-২১’র বাজেট বরাদ্দ বা আনুমানিক সংশোধিত খরচের তুলনায় ২০২১-২২’র বাজেট বরাদ্দ কমেছে। সার, খাদ্য বা পেটোলিয়াম পণ্যের ভরতুকিতে হ্রাস ঘটেছে। কেরোসিন তেলে ভরতুকি তুলে দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষাখাতে বরাদ্দ গত বাজেটের ৯৯,৩১২ কোটি টাকা থেকে ৬,০৮৪ কোটি টাকা কমিয়ে ৯৩,২২৪ কোটি টাকায় নিয়ে আসা হয়েছে। এমন এক সময়ে শিক্ষায় বরাদ্দ কমানো হচ্ছে যখন গরিব শিশু-কিশোররা গত এক বছর ধরে শিক্ষার বাইরে রয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডারের হিসেব অনুযায়ী শিশুদের পড়াশোনাজনিত ক্ষতির পরিমাণ ভারতবর্ষে ২৯ লক্ষ কোটি টাকা। সমাজ কল্যাণে গত বছরের তুলনায় বরাদ্দ কমেছে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা (৫৩,৮৭৬ কোটি থেকে ৪৮,৫৬০ কোটি)। গ্রামোন্নয়নে আনুমানিক সংশোধিত খরচের তুলনায় বরাদ্দ কমেছে ২২ হাজার কোটি টাকা। আগেই বলেছি পরিসংখ্যান সংগ্রহ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে এই সরকারের অনীহা প্রবল। তা তাদের ব্যয় বরাদ্দেও প্রকট হচ্ছে। ২০১৯-২০ সালে প্রকৃত ব্যয় ছিল ৫,৪৭৯ কোটি টাকা, ২০২০-২১এ বাজেট বরাদ্দ ছিল ৬,০৯৪ কোটি টাকা, ২০২০-২১’র আনুমানিক সংশোধিত খরচ মাত্র ২,১৬৪ কোটি টাকা; আর ২০২১-২২এ বাজেট বরাদ্দ ২,৪৭২ কোটি টাকা যা ২০২০-২১এ বাজেট বরাদ্দের ৪০%।
অন্যদিকে পেট্রলের উপর অন্তঃশুল্ক কমিয়ে সেস বসানো হল। ফলে পেট্রল-ডিজেলের দাম হয়তো তেমন বাড়ল না, কিন্তু সরকার ঘুরপথে রাজ্যের আয়ে হস্তক্ষেপ করল। অন্তঃশুল্ক থেকে পাওয়া অর্থের ৪১% রাজ্যগুলির কাছে যেত, সেসের ক্ষেত্রে কেন্দ্রের একচ্ছত্র অধিকার। ফলে অন্ত:শুল্ক কমিয়ে পেট্রল-ডিজেলে সেস বসিয়ে ভারতের যুক্তরাষ্ট্র কাঠামোকে আঘাত করল এই বাজেট।
তদর্থে সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকেই নিজেকে প্রত্যাহারের পরিকল্পনা নিচ্ছে। কর্পোরেট চালিত শাসনকে গ্রহণযোগ্য করাই মূল লক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৪টি ক্ষেত্রকে স্ট্রাটেজিক ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ১) পারমাণবিক শক্তি, মহাকাশ ও প্রতিরক্ষা; ২) পরিবহণ ও টেলিযোগাযোগ; ৩) বিদ্যুত, পেট্রোলিয়াম, কয়লা ও অন্যান্য খনিজ; ৪) ব্যাঙ্ক, বীমা ও অর্থলগ্নি পরিষেবা। এই ৪টি ক্ষেত্রে সরকারের উপস্থিতিকে ন্যূনতম করে তুলে বাদবাকি কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থাকে বেসরকারী হাতে তুলে দেওয়া হবে। তাছড়া যে কেন্দ্রীয় সরকারী সংস্থা আছে তাদের হয় বেসরকারী হাতে তুলে দেওয়া হবে নইলে বন্ধ করে দেওয়া হবে। শুরুতেই বলেছিলাম যে, এই বাজেটে ও পূর্বতন বাজেটের মূল সুর প্রকৃত অর্থে দেশের সমস্ত অর্থনৈতিক কর্মকান্ড থেকে সরকারের হাত গুটিয়ে নেওয়ার চরম নয়া উদারনীতিবাদ। ২০০৮ সালের বিশ্ব আর্থিক সঙ্কটে আমাদের দেশ তেমন সমস্যায় পড়েনি কারণ অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের ছিল একটি বৃহৎ রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্র। আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারও ২০০৮ পরবর্তিতে রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রের গুরুত্বকে উপলব্ধি করেছে। কিন্তু এই অতিমারির সময়ে স্যাঙাত পুঁজির তাঁবেদাররা দেশের রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রকেই তুলে দিতে চাইছে। নেহরু-ইন্দিরাকে গালাগালি দিতে দিতে তাদের জমানো সম্পদেই রাজ্যপাট চালানোকে দস্তুর করে ফেলেছে সরকার। এ’বছরের বাজেটে সরকারি সম্পদকে বেচে ১৭৫ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের পরিকল্পনা আছে সরকারের। কিন্তু সব সম্পদ ফুরিয়ে গেলে কী হবে তা ভেবে দেখা দরকার।
সবশেষে বলি, বাজেট নিয়ে এই চর্চার কি কোনো মানে আছে, অন্ততপক্ষে বাজেটের আয়-ব্যয়ের দিক থেকে। বেসরকারীকরণের নীতি বা শ্রমকোড মোতাবেক শ্রমিকদের অধিকার হরণের বিষয়গুলি বাজেটের মধ্য দিয়ে উচ্চড়ারিত হয় ও পরবর্তিতে কার্যকরিও করা হয়। কিন্তু ফেব্রুয়ারীর গোড়ায় এপ্রিল থেকে মার্চ পর্যন্ত বাজেট হয়। পরের বছর ফেব্রুয়ারীর গোড়ায় আবার চলতি বছরের জন্য সংশোধিত আনুমানিক আয়-ব্যয়ের হিসেব হয়। সর্বশেষে প্রকৃত আয়-ব্যয়ের হিসেব পাওয়া যায়। একটির সঙ্গে অন্যটির তফাৎ বাড়তেই থাকে। ধরা যাক গত ২০১৯-২০কে। বাজেটে আয় ছিল ২০.৮৩ লক্ষ কোটি টাকা, ব্যয় ছিল ২৭.৮৬ লক্ষ কোটি টাকা। পরের বছর বাজেটের সময় সংশোধিত অনুমানে ব্যয় কমে দাঁড়াল ২৬.৯৯ লক্ষ কোটি টাকা; অনুমান করা হল আয় কমে দাঁড়াবে ১৯.৩২ লক্ষ কোটিতে। বছর শেষ হলে প্রকৃত আয় হয়েছিল ১৭.৫১ লক্ষ কোটি টাকা (বাজেটের থেকে ৩.৩২ লক্ষ কোটি টাকা বা ১৬% কম, সংশোধিত অনুমানের থেকে ১.৮১ লক্ষ কোটি টাকা বা ৯.৪% কম)। ব্যয়ের দিক থেকে প্রকৃত ব্যয় হয়েছিল ২৬.৮৬ লক্ষ কোটি টাকা (বাজেটের থেকে ১ লক্ষ কোটি টাকা কম)। এই বাজেটেও সংশোধিত অনুমানে ২০২০-২১ সালে মোট ব্যয় হবে ৩৪.৫০ লক্ষ কোটি টাকা, কম্পট্রোলার জেনারেল অফ একাউন্টস (সিজিএ)’র হিসেব অনুযায়ী ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২২.৯০ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থাৎ জানুয়ারী-মার্চ এই ৩ মাসে ব্যয় করা হবে ১১.৬০ লক্ষ কোটি টাকা, যা গত ৯ মাসে যতটা ব্যয় করা হয়েছে তার ৫০%। ২০১৯-২০ সালে অনুরূপ ৩ মাসে ব্যয় করা হয়েছিল সাকুল্যে ৫.৭৬ লক্ষ কোটি টাকা যা পূর্বতন ৯ মাসের মোট ব্যয়ের ২৭% ছিল। তাই সরকারের আয় ব্যয়ের অনুমানের ক্ষেত্রে যে খামখেয়ালিপনা দেখা যাচ্ছে তা অনুমেয়।
– অমিত দাশগুপ্ত