প্রতিবেদন
পেট্রল-ডিজেল-রান্নার গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে জেরবার সাধারণ মানুষ
Petrol Gas Price Hike

২০১৪ সালের মে মাসের আগে পেট্রল, ডিজেল, রান্নার গ্যাস, কেরোসিন এসবের দাম বাড়লে দেশের খুব ক্ষতি হত, বিশেষত অমিতাভ বচ্চন, অক্ষয়কুমার, রামদেব ও নরেন মোদির। আমজনতার দুঃখে কাতর হয়েতারা টুইট করতেন, অথবা বক্তৃতায় গলা ফাটাতেন। এখন পেট্রল ও পেট্রলজাত দ্রব্যের দাম বাড়লে তারা আনন্দিত হয়, দেশের সরকার উন্নয়নের জন্য অর্থ সংস্থানে পারঙ্গম হবে বলে। যারা পেট্রোপণ্যের দাম বাড়ার জন্য ক্ষুব্ধ হন, মিছিল করেন, আন্দোলন করেন তাঁদের দেশের প্রধানমন্ত্রী নিশ্চিতভাবেই আন্দোলনজীবী বলবে। আগে জানা ছিল যে, পেট্রল-ডিজেলের দাম বাড়লে তা উৎপাদন ও পরিবহণ খরচকে বাড়িয়ে তুলে পণ্য মূল্যবৃদ্ধি ঘটায়। তবে মোদিজির রাজত্বে পরিসংখ্যান জবরদস্ত তাই জানুয়ারী জুড়ে পেট্রোপণ্যের দাম দ্রুত বাড়লেও মুদ্রাস্ফীতির হার কমেছে, গত ১৭ মাসের মধ্যে মুদ্রাস্ফীতির হার সর্বনিম্ন হয়েছে। এখন মনে হয আমরা শিবঠাকুরের আপন দেশেই বাস করছি, যেখানে সরকারের আকাঙ্খা অনুযায়ী জিডিপি বাড়ে কমে, সামগ্রিক উৎপাদন ২০২৪-২৫ সালের মধ্যে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছয়, কৃষকদের আয় ২০২২ সালের মধ্যে দ্বিগুণ হয়, মুদ্রাস্ফীতির হারে তারতম্য ঘটে, কর্মসংস্থানের তথ্য গোপন করা হয। সেই একুশে আইনের রাজত্বে পেট্রল-ডিজেলের দাম যে সরকারের ইচ্ছে অনুযায়ীই বাড়বে কমবে তাতে আর আশ্চর্য কী!

গত দুবছর ধরে পেট্রল ডিজেলের দাম বাড়ছে। গত ২০১১-১২, ২০১২-১৩, ২০১৩-১৪ সালে যখন পেট্রলের দাম বাড়ছিল, বিজেপি ও এনডিএ তখন নিয়মিত রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করত। ২০১২ সালের ৩১ মে ভারতজোড়া বামেদের ডাকা ধর্মঘটের দিন আলাদাভাবে ধর্মঘট ডেকেছিল তারাও। অবশ্য মমতা ব্যানার্জীর তৃণমূল কংগ্রেস সেই ধর্মঘটের বিরোধিতা করেছিল। ২০১২ সালের ধর্মঘটের প্রাক্কালে, ২৩ মে গুজরাটের তৎকালিন মুখ্যমন্ত্রী এবং বিজেপি ও এনডিএ-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন মোদি টুইট করেছিলেন, “পেট্রলের বিপুল মূল্যবৃদ্ধি কংগ্রসে নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের চূড়ান্ত ব্যর্থতা”। আজ গত দুবছরে যখন পেট্রলের দাম বেড়েছে লিটারে ২০ টাকা, শতাংশের হিসেবে ৩০%, ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধি ঘটেছে ২১ টাকার বেশি, ৩৩%, তখন তিনি পূবর্বর্তী সরকারের পেট্রলের জন্য আমদানী নির্ভরশীলতাকে দোষ দিয়েছেন। মনে রাখা দরকার, ভারতের নির্বাচিত সরকারগুলির সর্বমোট ৬৯ বছরের শাসনের মধ্যে ১৩ বছর বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ ক্ষমতায় ছিল, এবং ৪ বছর বিজেপি বা তার পূর্বাবতাররা সরকারের শরিক ছিল বা সমর্থক ছিল। ওই সময়কালে আমদানীর উপর নির্ভরশীলতা কমাতে কী করা হযেছিল তা জানতে পারলে হত। অবান্তর ও অসত্য ভাষণে পারদর্শী নরেন মোদি যেকথা বলেননি তাহল যে, ২০১৩-১৪ সালে পরিমাণগতভাবে ভারত পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য নীট আমদানি করেছিল ওই ধরনের পণ্যভোগের ৮৭%, নরেন মোদির ৭ বছরের শাসনে আমদানির অংশ বেড়ে হয়েছে ৯৬%। ফলে পেট্রলের জন্য আমদানি নির্ভরশীলতা বেড়েছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের (ইন্ডিযান বাস্কেটের) সর্বোচ্চ দাম দেখা গিয়েছিল এপ্রিল, ২০১১-তে, ১১৯ ডলার প্রতি ব্যারেল; ওই বছরেই অপরিশোধিত তেলের গড় মূল্য ছিল ১১২ ডলার প্রতি ব্যারেল। ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে গড় মূল্য ছিল ১১৮ ডলার প্রতি ব্যারেল ও ওই বছরে, ২০১২-১৩ সালে গড় মূল্য ছিল ১০৮ ডলার প্রতি ব্যারেল। ২০১৪ সালের মে মাসে দাম ছিল ১০৭ ডলার। এর পরে তা ক্রমাগত কমে ২০১৫-১৬ সালে ৪৬ ডলারে নেমে আসে। তারপরে বাড়তে থাকে ও ২০১৮-১৯-এ ৭০ ডলার প্রতি ব্যারেলে দাঁড়ায়। ২০১৯-২০-তে তা কমে ৬০ ডলার প্রতি ব্যারেলে পৌঁছয়। ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে অপরিশোধিত তেলের ব্যারেল প্রতি দাম কমে দাঁড়ায় ২০ ডলার। এরপরে দাম বাড়তে তাকে ও জানুয়ারিতে তা ৫৫ ডলার প্রতি ব্যারেলে পৌঁছেছিল। বর্তমানে তা বেড়ে ৬৩ ডলার প্রতি ব্যারেলে পৌঁছেছে। অপরদিকে ডলারের দাম বেড়ে ৫৯ টাকা থেকে ৭২ টাকায় গিয়েছে। ফলে টাকার অঙ্কে ব্যারেল প্রতি দাম ২০১৪ সালের মে মাসের ৬৩১৩ টাকা থেকে কমে বর্তমানে ৪৫৩৬ টাকায় নেমেছে। যদি আনুপাতিক অঙ্ককে পেট্রলের দাম নির্ধারণে গ্রহণ করা যায় তাহলে ওই সময়ের ৭২ টাকা প্রতি লিটারের তুলনায় পেট্রলের দাম হওয়া উচিৎ ৫১ টাকা প্রতি লিটার। নরেন্দ্র মোদি সরকারের ব্যবসায়ী বুদ্ধিতে পেট্রলের উপর প্রভূত কর চাপিয়ে তার দাম ৫১ টাকার তুলনায় ৮০ শতাংশ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, দাম দাঁড়িয়েছে ৯১ টাকার বেশি।

যখন মোদিজি ক্ষমতায় আসেন তখন পেট্রলের উপর এক্সাউজ ডিউটি ছিল লিটার প্রতি ৯.৪৮ টাকা ও ডিজেলের উপর ৩.৫৬ টাকা। ২০১৪র জুন মাসের পর থেকে যখন দাম কমতে থাকে ও ২০১৬র জানুয়ারীতে দাম কমে ২৮ ডলার প্রতি ব্যারেলে নেমে আসে, সেই সময়ে ২০১৪র নভেম্বর থেকে ২০১৬র জানুয়ারি মাস পর্যন্ত ১৫ মাসে মোদি সরকার পেট্রলের উপর ৯ দফায় এক্সাইজ ডিউটি বাড়িয়ে দেয়। সব মিলিয়ে ওই ১৫ মাসে পেট্রলের উপর এক্সাইজ ডিউটি বাড়ে ১১.৭৭ টাকা এবং ডিজেলের উপর ১৩.৭৭ টাকা। অক্টোবর, ২০১৭ তে এক্সাইজ ডিউটি ২ টাকা কমানো হয়, ১ বছর বাদে আবার নরেন মোদি দয়াপরবশ হয়ে ১.৫০ টাকা ডিউটি কমান। জুলাই, ২১০৯এ ডিউটি বাড়ানো হয় ২ টাকা করে প্রতি লিটারে, মার্চ, ২০২০-তে ৩ টাকা করে প্রতি লিটারে। কোভিড অতিমারিতে যখন বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম তলানিতে ঠেকছে তখন পেট্রলের উপর এক্সাইজ ডিউটি বাড়ানো হয় ১০ টাকা প্রতি লিটার ও ডিজেলের উপর ১৩ টাকা প্রতি লিটার। ফলে পেট্রলের উপর এক্সাইজ ডিউটি দাঁড়িয়েছে ৩২.৯৮ টাকা প্রতি লিটার যা মোদি সরকারের ক্ষমতায় আসার সময়কালের থেকে ২৩.৫০ টাকা বা ২৫০% বেশি। ডিজেলের ক্ষেত্রেতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১.৮৩ টাকা প্রতি লিটার অর্থাৎ বেড়েছে ২৮.২৭ টাকা বা ৭৯৪%।

২০১০ সালে যখন পেট্রল-ডিজেলের দামকে বিশ্ববাজারের সঙ্গে যুক্ত করে বাজার কর্তৃক নির্ধারিত করার ঘোষণা করা হয় তখন বিরোধিতা করেছিল বামপন্থীরা। ২০১৪ সালের অক্টোবর মাসে ডিজেলকেও বিশ্ববাজারের দামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়লে তার ফল ভুগতে হচ্ছে জনসাধারণকে, যেমন এখন বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়ছে তাই দেশে তেলের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু দাম কমলে সরকার এক্সাইজ ডিউটি বসিয়ে দাম কমতে দিচ্ছে না। ফলে তেলের দামের ঊর্ধগামিতা নিশ্চিত করার দায় নিয়েছে মোদি সরকার। কেবল তাই নয়, এক্সাইজ ডিউটি বসানো হলে তার ৪২% ভাগ পেয়ে তাকে রাজ্য সরকারগুলি। কিন্তু সেস বসালে তার ভাগ রাজ্য সরকারগুলি পায় না। এবছরের বাজেটে কেন্দ্রীয় সরকার ডিজেল ও পেট্রলের উপর এক্সাইজ ডিউটি যথাক্রমে ৪ টাকা ২.৫০ টাকা প্রতি লিটারে কমিয়েছে কিন্তু সেস বসিয়েছে সম পরিমাণ। ফলে রাজ্য সরকারগুলির আয় কমবে।

পেট্রল ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা করতে করতে আমরা গৃহস্থালীর জ্বালানিকে প্রায় ভুলতে বসেছি। ইতিমধ্যেই কেরোসিন তেলের উপর থেকে ভর্তুকি তুলে নিয়েছে সরকার। যুক্তিগ্রাহ্য করে তোলার জন্য উজ্বলা প্রকল্পে বিনা পয়সায় গ্যাস সংযোগ দেওয়ার কৃতিত্বকে ঢাক পিটিয়ে জানান দেওয়া হচ্ছে। উজ্জ্বলা প্রকল্পে গ্যাস দেওয়া হলেও পরবর্তীতে প্রাপককে গ্যাস কিনতে হবে। এদিকে গ্যাসের দাম ক্রমাগত বাড়ছে কিন্তু ভর্তুকির পরিমাণ কমতে কমতে ১৯ টাকায় ঠেকেছে যখন গ্যাসের দাম দাঁড়িয়েছে সিলিন্ডার পিছু ৮২০ টাকা। সব মিলিয়ে পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যের উপভোক্তাদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে মোদি সরকার।

- অমিত দাশগুপ্ত   

খণ্ড-28
সংখ্যা-7