পরিবেশ এবং সামাজিক ন্যায় আন্দোলনের কর্মী একুশ বছরের তরুণী দিশা রবির গ্রেফতার প্রমাণ করে দিল, মোদী সরকার আপাত গণতান্ত্রিক ছদ্ম আবরণটুকুও ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে একেবারে প্রকাশ্যে স্বৈরতন্ত্রের কণ্ঠলগ্ন হয়েছে। দিশা এবং অন্য তরুণীরা দিল্লি পুলিশের ‘ডাইনি-খোঁজ’-এর শিকার; কারণ তারা মোদীর তিনটে কর্পোরেট স্বার্থবাহী কৃষি আইনের বিরুদ্ধে ভারতের কৃষকদের প্রতিবাদের সপক্ষে দেশে ও আন্তর্জাতিক মহলে জনমত সংগঠিত করছিলেন।
কৃষক আন্দোলন-পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম গণআন্দোলন- আন্তর্জাতিক মহলের বহু সমর্থন পেয়েছে। দিল্লী পুলিশের হিংস্র হামলার ছুতো হল একটি গুগল তথ্য – জলবায়ু পরিবর্তন আন্দোলনের কর্মী আঠেরো বছরের সুইডিশ তরুণী গ্রেটা থুনবার্গের একটি টুইট। বিতর্কিত তথ্যটি হল একটি “টুলকিট”— সারা পৃথিবীতে প্রতিবাদ জানানোর একটি অতি পরিচিত হাতিয়ার — সেখানে মূল বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং বিশ্ব জনমত কীভাবে আন্দোলনকে সমর্থন করতে পারে তার পদ্ধতি তুলে ধরা হয়েছে। খুব সাধারণভাবে রাখা হয়েছে : প্রতিবাদ জানানো কোনো অপরাধ নয়, আর হোয়াটস্অ্যাপ গ্রুপ ও তথ্যের মাধ্যমে প্রচার সংগঠিত করাও অপরাধ নয়। যে সরকার প্রতিবাদ গড়ে তোলার সঙ্গে ‘দেশদ্রোহকে’ এক করে ফেলে, সেটি গণতন্ত্র নয়, একনায়কতন্ত্র।
যেভাবে দিশা রবিকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাতে দিল্লী পুলিশ নাগরিকদের জন্য সংবিধান প্রদত্ত অধিকারগুলি সুরক্ষিত রাখার প্রত্যেকটি বিধি লঙ্ঘন করেছে। সাদা পোশাকের লোকজন দিশাকে তার বেঙ্গালুরুর বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়, লোকদেখানো তথাকথিত জিজ্ঞাসাবাদের নামে; তারপর তাকে দিল্লী নিয়ে এসে তার পরিবার বা আইনজীবীকে না জানিয়েই তাকে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করা হয়। তার পক্ষে কোনো আইনজীবী উপস্থিত না থাকায় ম্যাজিস্ট্রেট তার কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করেননি, দিশাকে সরকার-নিযুক্ত কোনো কৌঁসুলী দেওয়া তো হয়ইনি, উল্টে তাকে পাঁচ দিনের পুলিশি হেফাজতে পাঠানো হয়।
দিশা রবির গ্রেফতার যে শুধু অসাংবিধানিক এবং লজ্জাজনক, তা-ই নয়-দিল্লী পুলিশ টুলকিটএর ভিত্তিতে যে এফ আই আর করেছে, সেটাও অসাংবিধানিক এবং লজ্জাজনক। সংবিধানের রক্ষাকবচ হিসাবে আদালতগুলি যদি তাদের কর্তব্য পালন করে, তাহলে এই এফআইআর-কে বাতিল করে দিশা রবিকে ক্ষমা চেয়ে সসম্মানে মুক্তি দেওয়া উচিত।
এই আদালতকে স্বীকার করতে হবে মোদী সরকারের সর্বগ্রাসী একাধিপত্যকামী ‘টুলকিট’-এর অস্তিত্ব এবং তাকে লাগাম পরাতে হবে — সরকার যেটা যে কোনো মতবিরোধ এবং গণআন্দোলনকে দমনের জন্য বারংবার ব্যবহার করে থাকে। জেএনইউ-তে ছাত্র আন্দোলনে, ভীমা কোরেগাঁও মামলায়, সিএএ-বিরোধী প্রতিবাদে, এবং এখন কৃষক আন্দোলনে, মোদী সরকার তার সর্বগ্রাসী টুলকিট’-এর থেকে একই হাতিয়ারগুলো কাজে লাগিয়েছে। এই হাতিয়ারগুলোর মধ্যে রয়েছে: প্রতিবাদীদের ‘জন-বিচ্ছিন্ন’ হিসাবে কালিমালিপ্ত করার এবং ‘দেশদ্রোহী’র তকমা দেওয়ার জন্য নিজের পোষা ‘গোদী’ মিডিয়া সংস্থা এগুলোকে কাজে লাগানো; রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের তাক-লাগানো গল্প ফেঁদে সেগুলো ছড়ানোর জন্য, হয় সযত্নরচিত প্রতারণামূলক তথ্য আর নয়তো প্রতিবাদ সংগঠিত করার নিরীহ মাধ্যমগুলো (যেমন হোয়াটস্অ্যাপ গ্রুপ, ই-মেল, এবং প্রতিবাদী টুলকিট’-এর তথ্য) ব্যবহার করা — (অবশ্য এসব নড়বড়ে খুঁটি এই গল্পের ভার কতটা বইতে পারে!) আর শেষমেশ চলে জিজ্ঞাসাবাদ, গ্রেফতার এবং দীর্ঘদিন কারাবাসে ঠেলে দেওয়ার অভিযান-সে বহু সংগ্রামের পোড়-খাওয়া বর্ষীয়ান নেতাই হোন আর তরুণ ছাত্র প্রতিবাদীরাই হোক; আর আদালতের কর্তব্যচ্যুতির সাহায্য নিয়ে ইউএপিএ-র মতো দানবীয় আইনগুলোর শরণ নেওয়া, যার মাধ্যমে জামিন এবং বিচার ছাড়াই জেলে পচানো সম্ভব হয়।
মোদী সরকারের টুলকিট-য়ে আছে আরও কয়েকটি হাতিয়ার – তথ্যকে চেপে দেওয়া এবং জনপরিসরে কল্পকাহিনীর উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য। প্রথমত তারা প্রচারক মিডিয়ার ‘অভিনেতা’ যারা “সাংবাদিকের” ছদ্মবেশে ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট নিউজ মিডিয়ার বিরাট অংশ দখল করে আছে, তাদের বিশাল, ইচ্ছুক বাহিনীকে সযত্ন লালনে বিকশিত করে তোলা। তারপর তারা সেই সব সাংবাদিক যারা হয় সরকার, নয় তাদের কর্পোরেট প্রভুদের কীর্তিকলাপ নিয়ে তদন্ত করছে, তাদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতা অথবা মানহানির মামলা খাড়া করা (ওয়্যার-এর সম্পাদক এবং অন্যান্য সাংবাদিক যারা প্রজাতন্ত্র দিবসে এক প্রতিবাদী কৃষক, যিনি পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, তার মৃত্যু নিয়ে তদন্ত করছিলেন তাদের বিরুদ্ধে মামলা এবং সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতার বিরুদ্ধে আদানি কর্পোরেশনের দায়ের করা মানহানির মামলা সাম্প্রতিক নিদর্শন)। মোদী সরকারের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য হুমকি এবং আক্রমণের সর্বশেষ নিদর্শন হল নিউজক্লিক পোর্টাল ও তার অফিসগুলিতে এবং তার সম্পাদকদের বাড়িতে এনফোর্সমেন্ট বিভাগের হানা। নিউজক্লিক-এর সম্পাদক একজন মার্কসবাদী; তিনি ছাত্রজীবনে ইন্দিরা গান্ধীর চাপানো জরুরি অবস্থার সময় জেল খেটেছেন। নিউজক্লিক এমন একটি পোর্টাল যা জনগণের আন্দোলনের অসামান্য সংবাদ পরিবেশনায় অনন্য স্বাতন্ত্র্যের দাবিদার।
দিল্লীর পুলিশ শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক বিক্ষোভ সমাবেশের সংগঠকদের সঙ্গে যে আচরণ করে, আর সেইসব রাজনৈতিক ব্যক্তি ও সংগঠিত হিন্দু-আধিপত্যকামী গোষ্ঠী, যারা মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও মোদী সরকারের সমালোচকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র হিংসাকে প্ররোচনা যোগায় এবং ছড়িয়ে দেয়, তাদের প্রতি পুলিশের যে ব্যবহার – তার মধ্যে আকশপাতাল ফারাক! এবিভিপি নেতা কোমল শর্মা, গত বছর যে দলবল নিয়ে জেএনইউ ক্যাম্পাসে চড়াও হয়েছিল এবং ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের মাথা ফাটিয়েছিল, দিল্লী পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেনি, তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগও দায়ের করেনি। বিজেপি নেতা কপিল শর্মা, যিনি গত বছর “বিশ্বাসঘাতকদের গুলি করো” শ্লোগান দিয়ে দিল্লী দাঙ্গায় ইন্ধন যোগানোর জন্য কুখ্যাত, দিল্লীর পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করা দূরে থাক, কখনও জিজ্ঞাসাবাদও করেনি। নিউজলন্ড্রির সাম্প্রতিক এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, মিশ্র “হিন্দু-ইকোসিস্টেম” গোষ্ঠীর প্রধান, যেটি ধারাবাহিকভাবে হিন্দুদের মধ্যে ইসলাম বিদ্বেষ ও নানা মনগড়া তথ্যসহ সংকীর্ণতাবাদী প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এই গোষ্ঠীটিও বিভিন্ন ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব প্রচার এবং তার অনুগামীদের বিদ্বেষমূলক ও মিথ্যা প্রচার বহুগুণ বাড়ানোর প্রশিক্ষণ দিতে, গুগল তথ্য (ডকুমেন্ট) ব্যবহার করে থাকে। যদি একটি নিউজ পোর্টাল হিন্দু-আধিপত্যকামী সন্ত্রাসের দেশজোড়া ‘ইকোসিস্টেম’-এ ঢুকতে ও অনুসন্ধান চালাতে পারে, দিল্লী পুলিশও নিশ্চয়ই এটি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল? তাহলে দিল্লি পুলিশ কেন কপিল মিশ্র এবং তার ঘৃণা-উদ্গীরণের হাতিয়ার যা সরাসরি মিথ্যা সংবাদ এবং বিদ্বেষ প্রচারে ইন্ধন যোগাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হচ্ছে? যখন এই পুলিশই সেইসব মানুষ যারা মোদী সরকারের নীতির বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলনের সমর্থনে হোয়াটস্অ্যাপ গ্রুপ চালাচ্ছেন বা গুগল ডকুমেন্ট সম্পাদনা করছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এত সক্রিয়?
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অধীন পুলিশ বাহিনী বিশ্বাস করে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে অহিংস মতবিরোধ ও প্রতিবাদ হচ্ছে বেআইনি এবং দেশদ্রোহিতামূলক, আর সহিংস ইসলাম বিদ্বেষ ও হিন্দু-আধিপত্যকামী ঠগী দৌরাত্ম্য হল আইনসম্মত এবং দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা! তার মানে-মোদী সরকার নিজেকে আর কোনোভাবেই ‘গণতান্ত্রিক’ বলে দাবি করতে পারে না; এই সরকারটাকে বিশ্বের সংকীর্ণতাবাদী ফ্যাসিবাদী একাধিপত্যকামী সরকারগুলোরই একটা বলে গণ্য করতে হবে। এর বিরুদ্ধে সরব হওয়া এবং সর্বশক্তি দিয়ে রুখে দাঁড়ানো প্রতিটি ভারতীয় নাগরিকের শুধু অধিকার নয়, কর্তব্যও !
(এম এল আপডেট সম্পাদকীয় ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০২১)