প্রতিবেদন
গত ৮ ফেব্রুয়ারী কলকাতা যুবকেন্দ্রে নাগরিক কনভেনশনে সমাজ বিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পাঠানো বার্তা
Parth's Letter

চিকিৎসকের পরামর্শ মানতে হচ্ছে বলে আজকের নাগরিক কনভেনশনে আমার আসা হল না। সেজন্য আপনাদের মার্জনা চাইছি।

পশ্চিমবাংলার রাজনৈতিক পরিস্থাতিতে আজকের দাবিসনদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এবিষয়ে সভায় উপস্থিত বক্তারা বিশদভাবে বলবেন। আমি শুধু একটি বিষয় তুলে ধরতে চাই।

নির্বাচনী রাজনীতির ক্ষেত্রে বিজেপি দল আর পাঁচটা রাজনৈতিক দলের মতো নয়। মতাদর্স অত্যন্ত দৃঢ়, সুচিন্তিত এবং ভয়ানক রকমের বিপজ্জনক। একথা ভুললে চলবে না।

২০১৯-এ দ্বিতীয়বার নির্বাচনে জেতার পর নরেন্দ্র মোদি সরকারের কাজকর্মে দুটি প্রধান নীতি প্রতিফলিত হচ্ছে। এক, হিন্দুত্ব আর দুই, বৃহৎ কর্পোরেট পুঁজির মুনাফার রাস্তা প্রশস্ত করা। এই দুই নীতির যোগফল হিসেবে আমরা এক এক করে দেখলাম সংবিদানের ৩৭০ ধারা লোপ, জম্মু-কাশ্মীরকে রাজ্য থেকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে নামিয়ে আনা, অযোধ্যায় রামমন্দিরের শিলান্যাস, নাগরিকত্ব আইন সংশোধন, কোভিড মহামারী মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকারের হরেক রকম তুঘলকি নির্দেশ, শ্রম আইন সংশোধন, কৃষিপণ্য আইন সংশোধন।

বিজেপি তথা আরএসএস-এর মতাদর্শের কেন্দ্রবিন্দু হল হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করা। এই হিন্দুরাষ্ট্রে হিন্দুরাই হবে প্রকৃত নাগরিক। অন্যদের হিন্দু সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যেতে হবে। যারা তাতে রাজি হবে না, হিন্দুিদের দয়ায় তাদের এদেশে থাকতে হবে। আরএসএস-এর গোলওযালকর বলতেন, হিন্দু পরাক্রমবাদ, অর্থাৎ বারতে হিন্দুজাতির আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। ইদানীং ‘পরাক্রম’ শব্দটা বিজেপি নেতাদের মুখে মাঝেমাঝেই শোনা যাচ্ছে। নাগরিকত্বের এই দারণা আমরা স্পষ্ট রূপায়িত হতে দেখলাম নাগরিকত্ব আইন সংশোধনে।

ভারতের সংবিধানের যুক্তরাষ্ট্রীয় অর্থাৎ ফেডেরাল কাঠামো আরএসএস কখনো মানেনি। তাদের মতে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো রাষ্ট্রকে দুর্বল করে দেয়। ভারতে কেন্দ্রীয় সরকারের একচ্ছত্র ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন। এই মতবাদের ছাপ আমরা দেখতে পাচ্ছি বিজেপি সরকারের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার নানা চেষ্টায়। সংবিদান যেসব বিষয়ে কেন্দ্র-রাজ্য উভয়কেই আইন তৈরি করার ক্ষমতা দিয়েছে, সেখানে রাজ্যগুলির সঙ্গে আলোচনা না করেই কেন্দ্র আইন পাশ করে চলেছে। এমনকি কৃষির মতো বিষয় যা কেবল রাজ্যের ক্ষমতার মধ্যে পড়ে, তাতেও কেন্দ্র আইন তৈরি করে সারা দেশের উপর চাপিয়ে দিল। ভারতে যে বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের ব্যবস্থা আছে, সে কথা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে প্রতিটি নির্বাচনকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মতো ‘মোদি বনাম কে?’ নাটকে পর্যবসিত করা হচ্ছে। এমনকি রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনেও যেন দেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁর দলের একমাত্র প্রার্থী। বেশ কয়বার তিনি বলেছেন, লোকসভা আর রাজ্য বিদানসভার নির্বাচন একসাথে হওয়া উচিত। এমন কথাও শুনছি যে, কেন্দ্রে আর রাজ্যে একই দলের সরকার থাকলে বাংলার উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। একথা সত্যি হলে তো ফেডেরাল ব্যবস্থাটাই তুলে দিতে হয়। তবে আগেই বলেছি, বিজেপি আরএসএস ফেডেরাল ব্যবস্থার প্রয়োজন স্বীকার করে না।

কর্পোরেট পুঁজির সুবিধা করে দেওয়া ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার নীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চলেছে। বৃহৎ পুঁজির উৎপাদন ক্ষেত্র, বাজার, সারা দেশ জুড়ে ছেয়ে আছে। তারা চায় কেন্দ্রীয় সরকার সর্বত্র তাদের গতিবিধি আরও সহজ করে দিক। কিন্তু বৃহৎ পুঁজি যত বৃদ্ধি পাচ্ছে, রাজ্যে রাজ্যে, শ্রেণিতে শ্রেণিতে অসাম্য তত বাড়ছে। শুধু উপার্জনের দিক দিয়েই নয়, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জীবনধারণের মান, সব দিক দিয়েই ভারতে অসাম্যের ছবিটা ভয়াবহ জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছে। একদিকে মহামারীর কোপে সাধারণ মানুষের রুজি-রোজগার চূড়ান্তভাবে বিপর্যস্ত, অথচ অন্যদিকে শেয়ার বাজারে দৈনিক রেকর্ড সৃষ্টি হচ্ছে।

বিশেষ করে পশ্চিমবাংলার ক্ষেত্রে বলতে চাই, বিজেপির উত্থানে সাংঘাতিক বিপদের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। অনেকে বলেছেন, ত্রিপুরায় দেখুন কী হয়েছে, বিজেপি এলে বাংলাতেও তাই হবে। আমার মনে হয়, ত্রিপুরা নয়, চোখ ফেরানো উচিত উত্তরপ্রদেশের দিকে। হিন্দুরাষ্ট্রের ধারণায় বাংলা একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। বাংলার সংস্কৃতি বেশ কিছুকাল বামপন্থী মতাদর্শে প্রভাবিত হয়েছে। অনেকদিন হল, এখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় আছে। বিজেপি এখন পুরোনো দেশভাগের স্মৃতি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার স্মৃতি উসকে দিতে চাইছে। তারা বলে, বাংলায় দেশভাগের অসম্পূর্ণ কাজ তারা সম্পূর্ণ করবে। অথচ বাংলায় তাদের সংগঠন নেই, সর্বগ্রাহ্য কোনো নেতা নেই। তাই ভিন রাজ্যের নেতাদের সঙ্গে অবধারিতভাবে এখানে এসে পড়েছে উত্তর ভারতের হিন্দু উচ্চজাতির সংস্কৃতি, ভাষা, ধর্মাচার, স্লোগান, যার সঙ্গে বাংলার মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই। এও এক পরাক্রমবাদ। বাংলায় ক্ষমতা পেলে নিশ্চিতভাবে এখানে আসবে, গোরক্ষা অভিযান, ‘লাভ জেহাদ’ ঠেকানোর ছুতোয় মানুষের স্বাধীন মেলামেশায় হস্তক্ষেপ এবং নিরীহ স্ত্রী-পুরুষের ওপর অত্যাচার, সরকার সম্বন্ধে যে কোনো সমালোচনার জন্য দেশদ্রোহিতার অপরাধে গ্রেপ্তার, বিরোধী মিটিং-মিছিলে যোগ দিলে শুধু চাকরি থেকে বরখাস্ত নয়, সরকারী চাকরিতে আবেদন করার অধিকারটুকুও কেড়ে নেওয়া। এসবই সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশে ঘটে চলেছে।

আমি তাই বলব, আগামী নির্বাচনে আমাদের কর্তর্ব্য বিজেপি প্রার্থীদের পরাজয় নিশ্চিত করা। এর জন্য কোনো সাধারণ পন্থা নেই। কারণ বিভন্ন দলের পারস্পরিক শক্তি এক এক নির্বাচনে এক এক রকম। দশ বছর সরকার চালানোর পরে তৃণমূল কংগ্রেস সম্বন্ধে অনেকের মনে ক্ষোভ তৈরি হওযা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু আবার বলি, বিল্প হিসেবে বিজেপি কিন্তু অন্য যে কোনো দলের মতো নয়। তাদের স্থির উদ্দেশ্য, ভারতের শাসন ব্যবস্থার খোলনলচে বদল করা। সে যাত্রাপথে বাংলা তাদের কাছে একটি প্রধান সোপান। সুতরাং আমি বলব, নিজের কেন্দ্রে দলগুলির পারস্পরিক শক্তি বিচার করে বিজেপি প্রার্থীর পরাজয় যাতে নিশ্চিত করা যায়, সেইভাবেই ভোট দেওয়া আমাদের কর্তব্য।

আজকের সভার আলোচনায় অংশ নিতে পারলাম না বলে আবার আপনাদের কাছে ক্ষমা চাইছি।

খণ্ড-28
সংখ্যা-6