প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর রাজ্যসভার ভাষণটি ফ্যাসিবাদী প্রচারাভিযানের এক উৎকৃষ্ট ব্যাকরণসম্মত নিদর্শন। উপলক্ষ্যটি ছিল বাজেট অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির উদ্বোধনী বক্তৃতায় ধন্যবাদ জ্ঞাপন নিয়ে বিতর্কে প্রধানমন্ত্রীর জবাবী ভাষণ প্রদান। রাষ্ট্রপতির প্রথাগত উদ্বোধনী ভাষণটি অবশ্য আগাগোড়াই ছিল সরকারের সমস্ত স্বঘোষিত সাফল্যের জন্য অভিনন্দন আর প্রশস্তিতে ভরা। প্রধানমন্ত্রীর জবাবি ভাষণটি সাধারণভাবে বিতর্ক চলাকালীন সাংসদদের তোলা প্রশ্নগুলির উত্তর দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট। কিন্তু মোদীর ভাষণে সাংসদদের তোলা বিতর্কের সমস্ত প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে সরকারের স্বঘোষিত সাফল্যের দাবিগুলোরই পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে এবং সমস্ত বিরোধী বক্তব্যকে আবর্জনাস্তূপে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে। দেশ যখন ২০৪৭-এ স্বাধীনতার শতবর্ষ উদযাপন করবে তখন নাকি সারা দেশের সঙ্গে তাঁর বিরোধীরাও তাঁর গৃহীত পদক্ষেপগুলোর জন্যে ধন্য ধন্য করবে! একমাত্র মোদীই জানেন,ভারতের জন্য মহত্তম কী! যিনি নিজেকে দেশের এক বিচক্ষণ সহৃদয় পিতৃপুরুষ হিসাবে বিজ্ঞাপিত করতে ভালোবাসেন, সেই স্বৈরশাসকের এক নির্লজ্জ আত্মপ্রশস্তি!
মোদী তাঁর বক্তৃতায় অনেকটা সময় খরচ করেছেন তাঁর তিনটি সর্বনাশা কৃষি আইন ছোট ও প্রান্তিক চাষিদের জন্য কতটা উপকারী তার সাফাই গাইতে। এ নিয়ে কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই যে গড় কৃষিজোত ক্রমশ কমছে আর ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের সংখ্যা ও অনুপাত ক্রমশ বাড়ছ। কথাটা হল, পরের পর সরকারগুলো ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের সাহায্যের জন্য প্রগতিশীল ভূমিসংস্কার ও সমবায়-চাষের প্রসঙ্গটাকে এড়িয়েই গেছে। কৃষি এবং গোটা অর্থনীতির উপর ক্রমবর্ধমান কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ — এটাই হল তিনটি কৃষি আইনের মর্মবস্তু। এগুলো এই ছোট চাষিদের — কৃষিতে তাদের আয় বাড়িয়ে বা কৃষি-নির্ভর জনসাধারণের একটা অংশকে ম্যানুফ্যাকচারিং বা পরিষেবা ক্ষেত্রে নিয়োগের মাধ্যমে কৃষির উপর চাপ কমিয়ে — কোনোভাবেই উপকার করবে না। কৃষিতে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ শুধু ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের দারিদ্র্য আরও বাড়িয়ে তুলবে।
প্রধানমন্ত্রী যখন তার ভাষণে ছোট চাষিদের জন্য কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করেছেন, তার সরকার কিন্তু তখন কৃষি এবং তার সম্পর্কিত অন্যান্য খাতে ব্যয়বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে। এমনকি বিপুল ঢক্কানিনাদিত ‘প্রধানমন্ত্রী কিষাণ সম্মান নিধি’ (পি এম-কিষাণ), যার মাধ্যমে, নিজের নামে পর্চা আছে এমন ক্ষুদ্র জোতের মালিক কৃষকদের বছরে তিনটি কিস্তিতে ৬০০০ টাকা দেওয়া হয়, সেই খাতেও এ বছরের বাজেটে ১০,০০০ কোটি টাকা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভূমিহীন চাষি, ক্ষুদ্র কৃষক যারা পারিবারিক জমি চাষ করে বা ভাগ-চাষি যারা অন্যের জমি লিজ নিয়ে চাষ করে, তারা সকলেই ‘কিষাণ সম্মান’-এর নামে এই অতি নগণ্য ‘ভিক্ষার দান’ থেকেও বঞ্চিত!
প্রধানমন্ত্রী ঋণ মকুবের বিষয়টিকে উপহাস করে বলেছেন, ‘নির্বাচনী ইস্যু’, ‘কৃষকের অ্যাজেণ্ডা’ নয়! তিনি আরও বিলাপ করেছেন, ক্ষুদ্র চাষিরা ব্যাঙ্ক-ঋণ পাননি। ক্ষুদ্র চাষীরা ব্যাঙ্ক-ঋণ না পেয়ে থাকলে, তাদের জন্য সরকারের বহুল বিজ্ঞাপিত ‘উদ্বেগের’ আসল চেহারাটাই উন্মোচিত হয়েছে!
ভারতে, ঋণগ্রস্ততা এবং তার অনুষঙ্গে ঋণ পরিশোধের প্রশ্নে জুলুমই হচ্ছে হাজার হাজার কৃষকের আত্মহত্যার সবচেয়ে বড় কারণ। এই মর্মান্তিক পরিস্থিতি থেকেই ঋণ মকুবের দাবি উঠে এসেছে। কোন নিষ্ঠুর স্বৈরাচারী শাসকই পারে এই জীবন-বাঁচানোর দাবিকে ‘নির্বাচনী অ্যাজেন্ডা’ বলে উপহাস করতে! আর ঋণ মকুবের প্রশ্ন যদি ‘নির্বাচনী অ্যাজেন্ডা’ হয়, তাহলে ‘পি এম-কিষাণ’ তো তার চেয়েও বেশি মাত্রায় তাই! নির্বাচন মুখী পশ্চিমবঙ্গে, মোদী নগ্নভাবেই এই রাজ্যে বিজেপি’র ক্ষমতায় আসার সঙ্গে এটিকে যুক্ত করেছেন, ঠিক যেমনভাবে তার দল, বিহার নির্বাচনে জিতে এলে বিনামূল্যে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কষক-আন্দোলন কখনও মাসিক সামান্য ৫০০ টাকার একটা নামকাওয়াস্তে/ প্রতীকী সাহায্য দাবি করেনি: তার মূল দাবি ছিল স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ন্যায্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ ও তার গ্যারান্টি।
‘এমএসপি থা, হ্যায় আউর রহেগা’ (ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ছিল, আছে এবং থাকবে) — প্রধানমন্ত্রীর এই শূন্যগর্ভ আশ্বাসটি শোনাচ্ছে ঠিক সেই ভারত-চীন এলএসি সংঘর্ষের পর তার সাফাই গাওয়া বিবৃতির মতো — ‘না কোই ঘুসা থা, না ঘুসা হুয়া হ্যায় (আমাদের ভূখণ্ডে কোন অনুপ্রবেশ ঘটেনি)’। কৃষকরা যা দাবি করেছেন তা হল, তারা যাতে তাদের উৎপন্ন ফসল ন্যায্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে বিক্রি করতে পারেন তার আইনি প্রতিশ্রুতি। সরকার জানে যে বেশির ভাগ রাজ্যেই কৃষকরা, বিশেষ করে ছোট চাষিরা, যাদের নাম করে মোদী তার সর্বনাশা কৃষি আইনগুলো চালাতে চাইছেন, তারা অভাবী বিক্রয়ে বাধ্য হন। বহুক্ষেত্রেই চালু বাজার দাম সরকার ঘোষিত ন্যূনতম সহায়ক মূল্য থেকে অনেক কম, আর ছোট ও বঞ্চিত কৃষক, যারা ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ও এপিএমসি (এগ্রিকালচারাল প্রোডাক্ট মার্কেট কমিটি) কাঠামোর অনুমিত ‘উপকারভোগী’, তাদের এর বিরোধিতায় দাঁড় করিয়ে, সরকার আসলে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ও এপিএমসি কাঠামোটাকেই ক্রমশ অপ্রয়োজনীয় করে তোলার চেষ্টা করছে। আর এটাই হচ্ছে আরেকটি ক্ষেত্র যেখান থেকে সরকার নিজের দায়িত্ব প্রত্যাহার করে নিচ্ছে এবং কর্পোরেট মুনাফা ও শক্তির যূপকাষ্ঠে জনসাধারণের স্বার্থকে বলি দিচ্ছে।
সমস্ত মতবিরোধকে কুমতলবপ্রসূত, সমস্ত প্রতিবাদীদের ‘পরজীবী’ এবং ‘ষড়যন্ত্রকারী’ বলে দেগে দেওয়া, ন্যায় ও গণতন্ত্রের জন্য সমস্ত সংগ্রামকে ‘বিদেশি ধ্বংসাত্মক মতাদর্শ’ চালিত ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবে চিহ্নিত করে গণতান্ত্রিক সংগ্রামগুলির বিরুদ্ধে ‘ডাইনি-খোঁজ’কে প্ররোচনা দেওয়া — এটা অবশ্যই রাজ্যসভায় মোদীর জবাবী ভাষণের সবচেয়ে শয়তানিপূর্ণ বিষয়। এটাই একটা বাক্যবাগীশ সরকারের বাক্যবিন্যাস, যে সরকার তার আইন দিয়ে কৃষকদের প্রতারণা করতে ব্যর্থ হয়েছে, যাদের কৃষক আন্দোলনের বিরুদ্ধে একযোগে ফন্দি এঁটে আসরে নেমে প্রচারাভিযান ও মানুষকে বিভ্রান্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে, আর যাদের কৃষকদের এবং কৃষক আন্দোলন ঘিরে গণতান্ত্রিক সংহতির প্রতি ভয় একেবারে স্পষ্ট ভাবে ধরা পড়ে গেছে বিশ্বের চোখে। একটা সরকার যাকে, কংক্রিটের অবরোধ আর কাঁটাতারের বেষ্টনি খাড়া করে, রাস্তা খুঁড়ে অথবা সেখানে গজাল পুঁতে, ইন্টারনেট পরিষেবা বিদ্যুৎ আর জল বন্ধ করে, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্না গায়িকা ও সমাজকর্মীর শুধু কয়েকটি টুইটের পাল্টা জবাব দেওয়ার জন্য মন্ত্রী, চিত্রতারকা, ক্রিকেটার এবং অন্যান্য বিশিষ্টজনের বিরাট বাহিনীকে নামিয়ে দিয়ে আত্মরক্ষার ঢাল খুঁজতে হয়, সেই সরকারটা আসলে প্রবল ভয়ের মধ্যে আছে। সে তার ভয় এবং সংকটকে কৃষক ও বৃহত্তর জনসাধারণের উপর পাচার করতে চাইছে। আমাদের, ভারতের জনগণকে অবশ্যই এই বাকসর্বস্ব সরকারকে বলতে হবে — তোমার গোপন ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে!
(এম এল আপডেট সম্পাদকীয় ৯ ফেব্রুয়ারী ২০২১)