ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে, কৃষকদের ট্রাক্টর প্যারেডে লাখো কৃষক দিল্লীর রাস্তায় শান্তিপূর্ণভাবে তাদের কৃষি-বিরোধী তিনটি আইন বাতিলের দাবি তুলে ধরেছিলেন, আর দিল্লিবাসীরাও বিপুলভাবে তাদের আবেগউষ্ণ অভিনন্দন জানিয়েছেন। তবে, মোদী সরকার লাল কেল্লার একটি বিচ্ছিন্ন, অনভিপ্রেত ঘটনাকে ব্যবহার করে (যে ঘটনার সংঘটনে স্বয়ং সরকারের সুপরিকল্পিত হস্তক্ষেপের সমস্ত লক্ষণ রয়েছে) আন্দোলনের উপর একটা সর্বাত্মক আক্রমণ নামিয়েছে।
ঠিক শাহিনবাগের ধাঁচের এই আক্রমণে পাঁচটি ধরণ রয়েছে : মিথ্যা অভিযোগ; ভারতীয় পতাকার অবমাননার জন্য কৃষকদের “দেশদ্রোহী” বলে দাগিয়ে দেওয়া; কৃষকদের উপর পুলিশী ও হিন্দু-আধিপত্যকামী সংগঠনের আক্রমণ; কৃষক ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ; যে সাংবাদিকরা, কূষক আন্দোলন ও তার উপর আক্রমণের খবর করছিলেন,তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ; কৃষকদের বিক্ষোভ সমাবেশের স্থলটি দুর্ভেদ্যভাবে ঘিরে ফেলা এবং ওখানে অন্যান্য কৃষক ও তার সঙ্গে দিল্লীবাসীদেরও যাওয়া আটকানোর জন্য রেলপথ নিয়ন্ত্রণ করা।
২৬ জানুয়ারীতেই, পুলিশ কৃষকদের উপর বর্বরভাবে কাঁদানে গ্যাস ও লাঠিচার্জ করেছিল। নভরীত সিং নামে এক কৃষক প্রাণ হারান; তার পরিবারের অভিযোগ পুলিশের গুলিতেই তার মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ, বিরোধী দলের রাজনীতিকদের জল আর অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে আন্দোলন স্থলে পৌঁছাতে দিচ্ছে না, কিন্তু হিন্দু-আধিপত্যবাদীদের “স্থানীয়” সেজে দলবল নিয়ে ওখানে ঢুকে পড়ে কৃষকদের উপর আক্রমণ চালাতে দেওয়া হয়েছে।
এ পর্যন্ত, ন’জন সাংবাদিক যারা নভরীতের পরিবারের পুলিশি গুলিচালনার অভিযোগ নিয়ে তদন্ত ও খবর করছিলেন, তাদের ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ এবং অন্যান্য ‘অপরাধে’ অভিযুক্ত করা হয়েছে। কৃষকদের আন্দোলন স্থলে দুষ্কৃতি এবং পুলিশের হিংস্র আক্রমণ নিয়ে যে সাংবাদিকরা খবর করেছিলেন, তাদের মারধর করে, হিঁচড়ে টেনে নিয়ে গিয়ে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। কৃষক সংগঠনগুলি জানিয়েছে, গত ২৬ জানুয়ারীর প্যারেডের পর থেকে শতাধিক কৃষকের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
সরকারের সঙ্গে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন যারা সেই গোটা প্রতিনিধিদল সহ, কৃষক আন্দোলনের বিরাট সংখ্যক সামনের সারির নেতাদের নাম এমন সব ফৌজদারি মামলায় জড়ানো হয়েছে যা রাষ্ট্রদ্রোহ এবং ইউএপিএ-র মতো দানবীয় আইন তাদের উপর চাপিয়ে দেবে। অন্তত ১২০ জন কৃষককে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়েছে। আন্দোলনস্থলে বিদ্যুৎ এবং ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যে সব অ্যাকাউন্ট থেকে কৃষক আন্দোলন নিয়ে খবর টুইট করা হত, তার অনেকগুলিকে মোদী সরকারের “অনুরোধে” অত্যন্ত জঘন্যভাবে বন্ধ করে দিয়েছে টুইটার কর্তৃপক্ষ।
দিল্লীর সীমানায় কৃষকদের প্রতিবাদ স্থলের বাইরে ব্যারিকেড করে, গভীর গর্ত খুঁড়ে, লোহার গজাল পুঁতে ট্রাক ও ট্রাক্টরের ঢোকা-বেরোনো সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছে, শক্তপোক্ত ক্যাম্পও তৈরি করে ফেলেছে। পাঞ্জাব থেকে আসা ট্রেনগুলোকে দিল্লীর স্টেশনগুলোতে থামতে দেওয়া হচ্ছে না। তবে, এই সব অত্যাচার শুধু আন্দোলনকে ঘআরও শক্তিশালী ও সংকল্পবদ্ধই করে তুলছে।
গাজীপুর সীমানায় উত্তরপ্রদেশ সরকারের বিধ্বংসী আক্রমণ এবং উত্তরপ্রদেশের বিশিষ্ট কৃষকনেতা রাকেশ টিকাইতের চোখে জল, মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ায় কৃষক আন্দোলনের পরাজয়ের প্রমাণ হিসাবে সোল্লাসে প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু তার ফল হয়েছে উল্টো, সেই রাতেই পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ কৃষক গাজীপুর সীমানায় চলে এসেছেন। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে ব্যাপকভাবে কৃষক পঞ্চায়েতগুলি তিনটি কৃষ-বিরোধী আইন বাতিল এবং প্রতিবাদী কৃষকদের বিরুদ্ধে সমস্ত মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে।
আন্দোলন যখন তীব্রতর হচ্ছে, মোদী সরকারের পেশ করা বাজেটে প্রধানমন্ত্রী-কিষাণ, এমএনআরইজিএ, তৈলবীজ এবং ডালের জন্য মূল্য সহায়ক প্রকল্প, স্বল্প মেয়াদি শস্য ঋণের উপর সুদে ভর্তুকি সহ কৃষিএবং গ্রামীণ কল্যাণ প্রকল্পগুলিতে ব্যাপক হারে বরাদ্দ কমানো হয়েছে। তার সঙ্গে, অঙ্গনওয়াড়ি এবং প্রসূতিদের সুযোগ সুবিধা; স্বাস্থ্য পরিচর্যা; এবং শিক্ষাতেও সরকারী ব্যয় প্রচুর কমানো হয়েছে। “স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ”, এবং “পানীয় জল ও পরিচ্ছন্নতা”-য় ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়ে দেখানোর জন্য উভয় ‘হেড’-এই “কেন্দ্রীয় সড়ক পরিকাঠামো তহবিল” গণনা করা হয়েছে-আদতে যা একটি সন্দেহজনক গণনা পদ্ধতি।
মোদী সরকারের চালু কৌশল – মিথ্যা সংবাদ, সাম্প্রদায়িক বিভাজন, অত্যাচার, সাংবাদিক এবং আন্দোলনের নেতাদের গ্রেফতার – কোনোকিছুই কাজে আসছে না। এবার, সরকারের প্রত্যেকটি আঘাত শুধু আন্দোলনের শক্তি ও সংকল্পকেই বাড়িয়ে তুলছে।
এম এল আপডেট, খণ্ড ২৪, সংখ্যা-৬, ২-৮ ফেব্রুয়ারী ২০২১