প্রতিবেদন
‘আত্মঘাতী মূঢ় উন্মত্ততা’ প্রসঙ্গে
suicidal stupidity

আজ থেকে পঁচাত্তর বছর আগে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের অগাস্ট মাসে সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণার ‘অপরাধে’ সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদহিন্দ ফৌজের সেনাবাহিনীর বন্দিদের বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া জারি রাখার কথা ঘোষণা করেছিল বিদেশি ঔপনিবেশিক সরকার। তাদের ‘বিচারে’ তিনজন আজাদহিন্দ ফৌজের তিনজন অফিসারের বিরুদ্ধে কারাদণ্ডের আদেশ জারি হয়। এঁরা ছিলেন হিন্দু, মুসলিম এবং শিখ সম্প্রদায়ের তিনজন প্রতিনিধি। এই বিচারা এবং কারাদণ্ডের প্রতিবাদে সেইসময় কলকাতা উত্তাল হয়ে উঠেছিল। নভেম্বর মাসের ২১ থেকে ২৩ এই তিনদিন কলকাতার রাস্তা প্রকম্পিত করেছিল ছাত্ররা। সুভাষচন্দ্রের ছবি ছাড়াও তাদের হাতে ছিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, কংগ্রেস, মুসলিম লিগ এবং ফরওআর্ড ব্লকের নিশান। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এই ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদী মিছিল সমসময়ে এক ঐতিহাসিক তথ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এই মিছিলের ওপর পুলিশের হামলায় হিন্দু এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের দুই ছাত্রের মৃত্যু ঘটে। এটা ছিল প্রথম দিনের ঘটনা। পরের দু’দিন কলকাতার জনজীবন স্তব্ধ করে দিয়েছিল এই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনকারীরা। এই আন্দোলনের মোকাবিলা করতে গিয়ে পুলিশ আবার গুলি চালিয়েছিল এবং তার পরিণতিতে ছাত্রজনতার তেত্রিশ জন শহিদ হন, আহত হন দুই শতাধিক আন্দোলনকারী। সেদিনের সেই আন্দোলনে আরএসএস বা হিন্দু মহাসভার কেউ ছিলেন না। আজ বিজেপির অজ্ঞ এবং মতান্ধ নেতৃবর্গ সুভাষচন্দ্রের ‘অপমান’ তথা সম্মানহানি নিয়ে বাজার গরম করে তারা কতটা নেতাজি-ভক্ত তার প্রচারে বাজার গরম করতে চাইছেন, অথচ তারা সেদিন আজাদহিন্দ বাহিনীর সৈন্যদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের এই অনৈতিক বিচার প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করতে এগিয়ে আসেনি, প্রতিবাদী আন্দোলনে সামিল হয়নি। সেদিন সুভাষচন্দ্রের প্রতি সম্মান জানানোর কথা তাদের মনেই হয়নি। এখন আসন্ন নির্বাচনের মুখে তারা বাঙালির মন জয় করার লক্ষ্যে সুভাষচন্দ্রের প্রতি তাদের অনুরাগ নিয়ে তা বাজারে সওদা করতে নেমে পড়েছে! এর চাইতে ন্যক্কারজনক আর কী হতে পারে?

আসলে ফ্যাসিস্তরা এভাবেই মিথ্যার বেসাতি করে জনসাধারণকে প্রতারিত করে চলে তাদের হীন উদ্দেশ্য সফল করার লক্ষ্যে। একটা মিথ্যেকে তারা বারবার প্রচার করার মধ্যে সত্যি হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়ে থাকে। এখনও তারা তাই-ই করে চলেছে। এখন তাদের মুখে কথায় কথায় ভুল উচ্চারণে, ভুল তথ্যে উচ্চারিত হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, অরবিন্দ প্রভৃতির নাম এবং অবশ্যই তা আসন্ন নির্বাচনে বাঙালি মনজয়ের হীন উদ্দেশ্যেই। তাদের আসল লক্ষ্যই তো ‘জয় শ্রীরাম’-এর প্রচার। জাতীয়তাবাদী প্রচার হিসেবে ‘ভারতমাতা’ নাম নিয়ে দেশভক্তির পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন।

মনে রাখা দরকার যে রামচন্দ্রের জয়গাথা থেকেই জয় শ্রীরাম-এর উৎপত্তি। এই উচ্চারণ বাংলাদেশে তেমন আমলও কোনওদিন পায়নি। আরএসএস-বিজেপি তথা গোটা সঙ্ঘপরিবার এই উচ্চারণটিকে তাদের ফ্যাসিস্ত অ্যাজেন্ডায় রূপায়িত করেছে। এখন লিঞ্চিং-এর সময় ‘জয় শ্রীরাম’ উচ্চারিত হয়, ধর্ষণ-খুন-অগ্নিসংযোগের ঘটনার সময়ও এই ‘জয় শ্রীরাম’ উচ্চারিত হয়! এই উচ্চারণ আসলে এখন হয়ে উঠেছে সঙ্ঘপরিবারের একটি পরিকল্পিত ফ্যাসিস্ত শ্লোগান এবং রণধ্বনি।

প্রখ্যাত ফোটোজর্নালিস্ট প্রশান্ত পাঞ্জিয়ার জানিয়েছেন যে অযোধ্যা মহিলা তীর্থযাত্রিরা বলে থাকেন ‘সীতারাম সীতারাম’, আর বয়স্কারা বলে তো রামনাম উচ্চারণই করেন না! প্রচলিত অর্থে ‘জয়’ বলতে ‘সিয়াভার রামচন্দ্রজি কি জয়’ অর্থাৎ সীতাপতি রামচন্দ্রের জয়। আজ থেকে শতবর্ষ আগে অযোধ্যায় আন্দোলনকারী কৃষকরা ‘বাবা রামচন্দ্র’-এর কথা বলতেন। সে সময় আন্দোলনকারীদের আন্দোলনের শ্লোগান হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল ‘সীতারাম’ বা ‘সিয়ারাম’। এই অধুনা প্রচারিত ‘জয় শ্রীরাম’ একান্তভাবেই ফ্যাসিস্ত হিন্দুতবাদীদের রাজনৈতিক এবং তাদের মতাদর্শিক উপস্থাপনা, যে শ্লোগানে নারীদ্বেষী হিসেবেই তারা সীতার নাম অনুক্ত রেখেছে। ‘জয় সীতারাম’ কিম্বা ‘জয় সিয়ারাম’-এর স্থলে এই ফ্যাসিস্তরা পরিকল্পিতভাবেই সীতার নাম বাদ দিয়েছেন। তাদের নারীদ্বেষী মনোভাব এই শ্লোগানে পরিস্ফূটিত হয়েছে। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে গত শতকের আশির দশকে রামানন্দ সাগরের ‘রামায়ণ’-এই এই ‘জয় শ্রীরাম’ জনপ্রিয় করে তোলার প্রয়াস পাওয়া হয়েছিল। আর তার বারো বছর পর বিরানব্বুই-এর ৬ ডিসেম্বরের কালো দিনটিকে এই ‘জয় শ্রীরাম’ শ্লোগান তার বিধ্বংসী এবং বিদ্বিষ্ট মনের প্রকাশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্তদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে।

সঙ্ঘপরিবারের চিন্তক জনৈক কলমচি ফ্যাসিস্ত হিন্দুত্ববাদীদের এই ‘জয় শ্রীরাম’ শ্লোগানটিকে বাংলায় অর্থাৎ পশ্চিমবাংলায় অত্যন্ত ‘জনপ্রিয়’ বলে অভিহিত করেছেন! কবে থেকে এবং ঠিক কীভাবে তা জনপ্রিয় হয়েছে তা তিনি বলেননি। তবে তিনি একথা স্বীকার করেছেন যে এই শ্লোগানটি প্রকৃতপক্ষে ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীকাল থেকেই জনপ্রিয়কৃত করা হয়েছে। তাঁর বক্তব্য : ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ এবং ‘বন্দেমাতরম’ শ্লোগানদুটি বাংলাদেশে প্রাধান্য পেয়েছিল, সেখানে ‘জয় শ্রীরাম’-এর কোনও স্থান ছিল না। অন্যদিকে গোবলয়ে এই ‘জয় শ্রীরাম’ প্রাধান্যলাভ করে ছিল। — স্বভাবতই তাঁর এই বক্তব্যের নির্যাসেই প্রকাশ পায় যে বাংলায় ‘জয় শ্রীরাম’ আদতে গ্রহণযোগ্য ছিল না, তাকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার মাধ্যমেই সঙ্ঘপরিবার তাদের ফ্যাসিস্ত অ্যাজেন্ডাকে কার্যকরী করার পরিকল্পনা করেছে। তাঁর ক্ষোভ এই যে পশ্চিমবাংলার কেউ কেউ প্রতিবেশী দেশ থেকে ধার করে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিচ্ছেন! বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের এই জনপ্রিয় শ্লোগানটিকে গ্রহণে তাঁর ভীষণরকম আপত্তি! ব্রিটিশ আমলে বন্দেমাতরম যেমন জনমনপ্লাবী শ্লোগান হয়ে উঠেছিল, এখন তেমনই ‘জয় শ্রীরাম’ হচ্ছে ‘ক্রোধ প্রকাশের’ উচ্চারিত কণ্ঠস্বর! এভাবেই তিনি সম্ভবত অসতর্কভাবেই স্বীকার করে ফেলেছেন যে ‘জয় শ্রীরাম’ প্রকৃতপক্ষে সঙ্ঘপরিবারের ‘ক্রোধ প্রকাশের’ অর্থাৎ খুনহত্যা-ধর্ষণ-দহন-ধ্বংসের প্রোগ্রাম কার্যকরী করার উত্তেজিত শ্লোগান!

তিনি আরও বলেছেন যে বন্দেমাতরম তো বঙ্কিমচন্দ্রের লেখাতেই পাওয়া যায় যেখানে দেবী দুর্গার পুজো উপলক্ষে এই বন্দেমাতরম অর্চিত হয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দেমাতরম-গানে ‘ত্বং হি দুর্গা’ ইত্যাদি আছে, যা নিয়ে অনেক বিতর্কও হয়েছে। হিন্দুত্ববাদীরা বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দেমাতরম শ্লোগানকে গ্রহণ কেন গ্রহণ করেনি, এপ্রশ্ন সঙ্গত। বন্দেমাতরম-এর অর্থ ‘মা, তোমাকে বন্দনা করি’। স্বঘোষিত ‘দেশপ্রেমিক’ হিসেবে তারা এই বন্দেমাতরমকে গ্রহণ না করে ‘জয় শ্রীরাম’ গ্রহণ করলো কেন? এর জবাব কলমচি দেবেন কি? আসলে দুর্গা তো মহিলা দেবী। সীতা তো রামচন্দ্রের স্ত্রী। সঙ্ঘপরিবার তাদের নারীদ্বেষিতার কারণেই মহিলাদের গুরুত্ব দিতে নারাজ। মহিলাদের কাজ হচ্ছে পুরুষদের দাসী হিসেবে সন্তানের জন্ম দেওয়া এবং নির্বিকার চিত্তে ঘরের কাজ করে যাওয়া! দুর্গা ছিলেন যোদ্ধা। স্বভাবতই তিনি তো বিজেপির কাছে গ্রহণযোগ্যা হতে পারেন না! আর রামের সহধর্মিনী হিসেবে সীতা রামের সঙ্গে বনবাসে গিয়েছিলেন, প্রচুর দুঃখকষ্ট ভোগ করার পর তিনি যুদ্ধশেষে রামচন্দ্রের সঙ্গে মিলিত হয়ে রানি হিসেবে মর্যাদাপ্রাপ্তা হবেন এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু সংঘপরিবারের এই আরাধ্য দেবতা রাম তো নিজের স্ত্রীকেই মর্যাদা দেননি, তাঁর সম্মানহানি করেছেন, আর সেই স্ত্রীর প্রতি অবিচারকারী রামচন্দ্রই সংঘপরিবারের কাছে অপ্রশ্নেয় গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছেন। ফলে তাদের শ্লোগানে সিয়ারাম কিম্বা সীতারামের পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি ত্রাসসঞ্চারক শ্লোগান হিসেবেই গৃহীত হয়েছে।

অন্যদিকে এই সংঘপারিবারিকেরা আবার ভারতমাতা-র কথা বলে! তারা ‘ভারতমাতা কি জয়’ শ্লোগান দিয়ে থাকে! যারা নারীদ্বেষী তারা কীভাবে ভারতমাতার নামে শ্লোগান দেয়? ভারতমাতা শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘ভারতাম্বা’ শব্দ থেকে। অম্বা শব্দের অর্থ মা। এইভাবে ভারতাম্বা-ই ভারতমাতা হয়ে উঠেছে। প্রকৃতপক্ষে ভারতমাতার কনসেপ্টটি এসেছিল ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহের সময়। উত্তরকালে ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে কিরণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ‘ভারতমাতা’ নামে একটি নাটক লেখেন এবং তা অভিনয়ও হয়। এর সাতবছর পর বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে এই ভারতমাতা দেশমাতৃকা রূপে চিত্রিত হন। তারও আড়াই দশক পরে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতমাতার চিত্রাঙ্কন করেন। তবে এইসব ভারতমাতার কনসেপ্ট এবং চিত্রাঙ্কন সবই ছিল কল্পিত। স্বয়ং নিবেদতাও এইসব ভারতমাতার চিন্ত্রাঙ্কনের প্রশংসা করলেও স্বীকার করেছিলেন যে এসবই কল্পনাপ্রসূত।

হিন্দুত্ববাদীরা এই ভারতমাতার কল্পচিত্রকেই তাদের দেশপ্রেমের স্মারক হিসেবে সওদা করে থাকে। এই নারীমূর্তি নিছক কল্পিত, বাস্তবের সঙ্গে যার কোনও সংশ্রব নেই। একসময় দেশকে মা হিসেবে কল্পনা করে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে দেশপ্রেমিকরা বিদেশি শাসকদের বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছিলেন। আর সেইসময় সেই বিদেশি ব্রিটিশ রাজশক্তির প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ থেকে দূরে থাকা দেশ্রদ্রোহিরা আজ দেশপ্রেমের পাঠ শেখাচ্ছেন! নিজেদের ‘দেশপ্রেমিক’ হিসেবে গণ্য করে প্রকৃত দেশপ্রেমিকদের ‘দেশদ্রোহী’ হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কুখ্যাত সব আইনে অভিযোগ এনে তাদের কারারুদ্ধ করে চলেছেন আর অন্যদিকে আসন্ন নির্বাচনে বিজয় অর্জনের লক্ষ্যে বাংলার মন জয় করতে মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে বাংলার মানুষকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে।

এই নারীদ্বেষী, কৃষকস্বার্থ বিরোধী, শ্রমিকস্বার্থ বিরোধী এবং সর্বোপরি দেশের আপামর জনস্বার্থ বিপন্নকারী এই ফ্যাসিস্ত শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলাই আজ সময়ে এবং ইতিহাসের দাবি।

- অশোক চট্টোপাধ্যায়   

খণ্ড-28
সংখ্যা-7