২৫ জানুয়ারীর রাত। সেদিনের রাতটা একটু বেশিই ঠান্ডা ছিল। কিন্তু সিঙ্ঘু , টিকরি এবং গাজীপুর বর্ডারের কৃষকরা সারা রাত জেগে পরের দিনের ট্র্যাক্টার ৠালির জন্য তাদের ট্র্যাক্টার আর ট্রলি সাজাতে এবং পরের দিনের প্রস্তুতি নিতে মেতে ছিল।
২৬ জানুয়ারী টিকরী বর্ডার থেকে শুরু হওয়া ট্র্যাক্টর মিছিলের একদম সামনে ছিলেন সর্বভারতীয় কিষাণ মহাসভার সভাপতি কমরেড রুলদু সিং এবং সঙ্গে ছিলেন এআইকেএমএর কমরেড গুরনাম সিং এবং যশবীর কৌর নত। গাজীপুরে মিছিলের সামনের সারিতে ছিলেন সম্পাদক কমরেড রাজারাম সিং এবং উত্তরাখণ্ডের নেতা কমরেড পুরুষোত্তম শর্মা এবং উত্তর প্রদেশের কমরেড ঈশ্বরী প্রসাদ কুশওয়াহা।
তিনটি মিছিলকেই দিল্লীর জনতা স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যর্থনা জানায় এবং পুরো রাস্তা ধরে মিছিলে যোগদানকারী মানুষদের আতিথেয়তা করে। রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় দিল্লীর এআইসিসিটিইউ এবং এআইএসএ শাখা মিছিলকে অভ্যর্থনা জানায় তাদের ব্যানার এবং শ্লোগানের মাধ্যমে এবং খাদ্য-পানীয়ের ব্যবস্থাও তারা করেছিল। টিকরী বর্ডারের মিছিলকে এআইসিসিটিইউএআইএসএ-আরওয়াইএ নজফগড়ে স্বাগত জানায়। সিঙ্ঘু বর্ডারের মিছিলকে তারা স্বাগত জানায় স্বরূপনগরে এবং সিংঘৌলায় আর গাজীপুরের মিছিলকে অপ্সরা চৌকে। কমরেডরা জানান যে মানুষ তাদের বাড়ির ছাদে জড়ো হয়েছিল কৃষক মিছিলের ওপর পুষ্পবৃষ্টি করার জন্য।
কমরেড সঞ্জয় শর্মা, ভি অরুণ কুমার এবং আমি ২৫ জানুয়ারী সিঙ্ঘু বর্ডারে রাত কাটাই লিবারেশানের তরফে এই কৃষক মার্চকে কভার করার জন্য। আমি আমার কিছু অতুলনীয় অভিজ্ঞতার কথা আপনাদের সাথে ভাগ করে নেব।
আমরা রাত কাটাই সিঙ্ঘু বর্ডারে শহীদ ভগত সিং গ্রন্থাগারের তাঁবুতে যেখানে এআইএসএ এবং এআইসিসিটিইউ-র কমরেডরা সারা রাত জেগে কৃষকদের ট্র্যাক্টার এবং ট্রলি সাজাচ্ছিল। এআইএসএ-র কমরেড নেহা তিওয়ারী একটি ব্যানার বানিয়েছি, তাতে মোদীকে আদানী-আম্বানীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি পুতুল হিসেবে দেখানো হয়েছিল। সেই ব্যানারটির কৃষকদের মধ্যে ভাল চাহিদা হয়েছিল। অনেকেই সেই ব্যানারটি নিয়ে যাচ্ছিল তাদের ট্র্যাক্টারে লাগানোর জন্যে। আমাদের কমরেডরা এআইকেএম-এর ট্রলীতে ভগৎ সিং, আশফাকুল্লা খান, চন্দ্রশেখর আজাদ, ডক্টর আম্বেদকার, চে গেভারা, শহীদ উধম সিং এবং কার্তার সিং সারাভা-র বড় বড় কাট আউট লাগিয়েছিল যা পুরো মিছিলে এবং সিঙ্ঘু বর্ডারে উৎসাহের সঞ্চার করেছিল।
কমরেড সঞ্জয় এবং আমি, সঙ্গে চন্ডীগড়ের কমরেড সৌম্যা, কয়েক কিলোমিটার হেঁটে পৌঁছলাম আমাদের গুরুদাসপুর কমরেডদের ক্যাম্পে। সেখানে আমরা ৪ জনের এক পরিবারের দেখা পেলাম — বাবা, মা এবং তাদের দুই মেয়ে —একজন ন’বছরের আরেকজন তেরো। তারা বাইকে চেপে গুরুদাসপুর থেকে সিঙ্ঘুতে এসেছেন এই মিছিলে যোগদান করার জন্য। দুটি মেয়ে, তাদের এই জনসমাগমের প্রতি তীব্র আকর্ষণের বশে, সৌম্যা এবং গুরুদাসপুরের কমরেডদের কাছে বায়না ধরে তাদেরকে ট্র্যাক্টারে জায়গা দিতে হবে!
আমরা তামিলনাড়ু এবং কর্ণাটক থেকে আসা কৃষকদের একটি দল দেখলাম যারা মিছিলের সামনে থাকার জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছে।
পরের দিন সকালে, যখন ঘুম চোখে আমি বাথরুমের লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, লক্ষ্য করলাম এক ভদ্রলোক এক যুবতীকে খোঁচা দিচ্ছেন এবং আমার দিকে তাকাচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর, তিনি আমার দিকে এগিয়ে এসে মেয়েটিকে বলেন, “ইনি সেই লেখিকা যার বই আমি তোমাকে পড়তে দিয়েছি — ‘‘ফিয়ারলেস ফ্রীডম’’। সঙ্গে সঙ্গে আরো কিছু যুবতী আমাকে উৎসাহের সাথে অভিবাদন জানায় এবং আমার বইয়ের প্রশংসা করে। নারী স্বাধীনতার ওপর বইটি যুবতী মেয়েরা পড়ছে জেনে এবং তাদের এই ঐতিহাসিক প্রতিবাদী সমাবেশে দেখতে পেয়ে আমার বড় আনন্দ হল। তারা জানায় তারা পাটিয়ালা, গুরুদাসপুর, চন্ডীগড় থেকে এসেছে এই প্রতিবাদে সামিল হতে এবং তারা প্রজাতন্ত্র দিবসের কৃষক প্যারেডের দিকে মুখিয়ে আছে।
অনেক লঙ্গরের মধ্যে একটিতে একটু চা এবং সকালের জলখাবার খেয়ে, কমরেড সঞ্জয় এবং আমি বর্ডারের দিকে চলতে শুরু করলাম যেখান থেকে প্যারেড শুরু হবে। অরুণ ততক্ষণে তার ক্যামেরা নিয়ে পৌঁছে গেছে একদম সামনে। একটি চায়ের দোকানে অপেক্ষা করতে করতে আমাদের সাক্ষাৎ হল গুরুদাসপুরের যশবীর সিং-এর সাথে। তার হয়তো ফকোমেলিয়া নামে একটি জন্মগত অসুস্থতা থাকার কারণে পা দুটি ছোট এবং তিনি হুইলচেয়ারেই যাতায়াত করেন। তিনি বললেন, ২৫ দিন ধরে এখানেই আছেন — “আমরা তো এখানে বাংলো তৈরি করে ফেলেছি” — মজা করে বলেন। তিনি আমাকে তার হুইলচেয়ারে বাঁধা কিষাণ ইউনিয়ানের পতাকা গর্বের সাথে দেখান। তিনি বলেন “এই ট্র্যাক্টারের লাইন সোনিপত পর্যন্ত চলে গেছে। এখানে মাত্র ২ শতাংশই দেখা যাচ্ছে। এই আইন লাগু হয়ে গেলে সবাইকে খুব খারাপ ভাবে প্রভাবিত করবে। মানুষ খেতে পাবে না, রেশন ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাবে। মোদীকে আমাদের দাবি মানতেই হবে।”
সময়ের সাথে সাথে যখন সেই অন্তহীন ট্র্যাক্টারের কুচকাওয়াজ শুরু হল, তখন তার পাশে একই রকম বিশাল সংখ্যায় মানুষের মিছিলে আমরা পায়ে হেঁটে যোগ দিলাম। এর সঙ্গে সামরিক মার্চের কোনো মিল ছিল না। এই মিছিল উচ্ছ্বাসে ভরা, স্লোগান উঠছে চারিদিকে, বিভিন্ন ধারার গান গাওয়া এবং বাজানো হচ্ছে — দেশাত্মবোধক থেকে বিপ্লবী গান, কৃষকদের গান থেকে এই প্যারেডের জন্য বাঁধা গান। তারই সঙ্গে যুবক যুবতী বৃদ্ধ বৃদ্ধারা তালে পা মিলিয়ে নাচছে।
সঞ্জয় আর আমি মিছিলের সাথে পা মিলিয়ে প্রায় ১০ কিলোমিটার হাঁটলাম। আমরা টিভি মিডিয়ার সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি দেখে বিস্মিত হলাম। মনে হল যে ইন্টারনেট বোধহয় ইচ্ছে করেই কমজোরী করে রাখা হয়েছে কারণ আমরা কোনো ধরনের সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইভ সম্প্রচার করতে পারছিলাম না।
প্যারেডের পথে যেখানেই বসতি ছিল সেখানেই মানুষ বেরিয়ে এসে হাততালি এবং উল্লাস উচ্ছ্বাস দেখাচ্ছিল। আমি কিছু যুবক শ্রমিকের সাথে কথা বললাম। একজন বলল, তার মুখ আনন্দোজ্বল, “প্রত্যেকে কৃষকদের প্রশংসা করে তাদের তেজ এবং সাহসিকতা — দুটোকেই! আমরা তাদের দেখতে পেয়ে খুবই আনন্দিত এবং তাদের দাবিকে আন্তরিকভাবে সমর্থন করি। আমরা শ্রমিকরাও কৃষকই — আমরা সবাই গ্রামের কৃষি সমাজ থেকেই এসেছি।”
আমরা একটি ট্র্যাক্টার দেখতে পেলাম যেখানে সবাই মহিলা, চালাচ্ছে একজন যুবতী। ট্র্যাক্টার এবং ট্রলি ভর্তি মহিলারা ছাড়াও, আমাদের সঙ্গে অগণিত মহিলা হাঁটছিল, শ্লোগান দিচ্ছিল, পতাকা ধরে ছিল।
খামপুরে (দিল্লীর একটি গ্রাম), আমরা দেখলাম সেখানকার বাসিন্দারা — পুরুষ, মহিলা, বাচ্চা সবাই – বালতিতে জল ভরে এবং গ্লাসে করে ক্লান্তদের পানীয় জল দিতে ব্যস্ত। তাদের মধ্যে দুজন আমাদের বলল “আমরা কৃষকদের সম্পূর্ণ সমর্থন করি এবং তারা অসাধারণ কাজ করছে।”
একজন ভদ্রলোক যিনি খামপুরে একটি ছোট্ট দোকান চালান তিনি উৎসুক হয়ে বলে গেলেন,” আমি আমার ছেলেকে কষ্ট করে পড়াশোনা করিয়েছি। কিন্তু সব ব্যর্থ। এখন কোনো চাকরি নেই। আমার ছেলে জমি বাড়ি কেনা বেচার সাথে যুক্ত কিন্তু এখন তার বাজারও খারাপ। মোদী আচ্ছে দিনের কথা বলে কিন্তু আমরা কিচ্ছু পেলাম না। শুধু মনে হচ্ছে আদানী আম্বানীরাই লাভ করল। এই কারণেই কৃষকরা লড়ছে।”
খামপুরে সঞ্জয় আর আমি একটি ট্রলিতে চড়লাম। আমার উঠতে অসুবিধে হচ্ছে দেখে আমার হাত ধরে একজন যুবক আমাকে তুলে দিল। ভেতরে আমরা এক গোটা পরিবারের দেখা পেলাম। সেই পরিবারের মহিলারাও সেখানে উপস্থিত ছিল। তারা চন্ডীগড়ে একটি কসমেটিকসের দোকান চালায়। তারা সিঙ্ঘুতে এসেছে এই আন্দোলন এবং প্যারেডে অংশগ্রহণ করতে। ট্রলি থেকে রুদ্ধশ্বাস দৃশ্য দেখতে পেলাম। যতদূর চোখে দেখা যায় ট্র্যাক্টারের সারিবদ্ধ লাইন। ট্র্যাক্টারের লাইন সীমাহীন।
অবশেষে, আমরা যখন অরুণের কাছ থেকে জানতে শুরু করলাম যে কৃষকদের ওপর পুলিশী নির্যাতন হচ্ছে আইটিও-তে, বুঝতে পারলাম যে প্যারেড সম্পূর্ণ থেমে গেছে কারণ দিল্লী পুলিশ এই আইটিও-র ঘটনা দেখিয়ে পুরো মার্চকে মুকতরবা চকের পরে আর যেতে দিচ্ছে না। বুঝতে পেরে আমরা ট্রলি থেকে নেমে পড়লাম এবং বুঝতে পারলাম যে আমরা এখন সঞ্জয় গান্ধী ট্রান্সপোর্টনগর ফ্লাই ওভারে আছি এবং আমাদের নীচে লিবাসপুর গ্রাম। আমরা অগত্যা ঝোপঝাড় ধরে নীচের রাস্তায় নেমে এলাম। আমরা আমাদের শাকারপুরে অফিসের দিকে প্রায় ছুট লাগালাম এবং অনেক বাধা অতিক্রম করতে হল কারণ দিল্লী পুলিশ মেট্রো বন্ধ করে দিয়েছে এবং চারিদিকে জ্যাম কারণ পুলিশ প্যারেড এগোতে দিচ্ছে না এবং দিল্লীতে যাতায়াত করা প্রায় দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল।
ভালো ব্যাপারটি হল যে আমরা যখন ফিরছিলাম, প্রত্যেক দিল্লী বাসিন্দা — বেশির ভাগ অটো-রিক্সা চালক এবং দিল্লীর বিভিন্ন শ্রেণী থেকে আসা তাদের যাত্রীরা — কৃষকদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল এবং মোদী সরকারের ও পুলিশের বিরুদ্ধাচারণ করছিল।
এক ভদ্রলোক বিস্তারিতভাবে মোদী সরকারের সমালোচনা করলেন, “কি করে এটা হয়! যে সরকার এত সমর্থনের সাথে ৬ বছর আগে নির্বাচিত হল, সেই একই সরকার প্রায় প্রত্যেক বছর সারা দেশকে অশান্ত করে তুলছে, নোটবন্দী, সিএএ, লকডাউন আর এখন কৃষি আইন? আমাদের দেশের বর্ডারে চীন দাঁড়িয়ে আছে আর সরকার নিজের নাগরিকদেরকেই তার শত্রু বানাচ্ছে। শেষ শীতে সিএএ বিরোধী আন্দোলন চলছিল আর এই শীতে কৃষি আইন বিরোধী আন্দোলন দুই মাস ধরে চলছে। এত মানুষ যদি এর বিরোধিতাই করে তো সেই আইন ফেরত নিয়ে কেন নেওয়া হচ্ছে না? সমস্যা হচ্ছে মোদীকে নিয়ে, সে খুবই দাম্ভিক। সে ভাবে সে দেশের রাজা যে তার সম্মান হারাবে যদি সে পিছু হটে। এই কৃষকদের দেখো। তারা একজন মানুষের গায়েও হাত দেয়নি যদিও তারা এতদিন ধরে এতজন মিলে এখানে আছে।”
একজন অটোচালক বললেন, “কৃষকরা এতো কম টাকা কামায় এবং প্রত্যেক বছর তারা তাদের অস্তিত্ব নিয়ে চিন্তায় থাকে। এখন সরকার তাদের এই কম আয়টুকুও ছিনিয়ে নিতে চাইছে। এই সরকারকে নিয়ে সমস্যা কি জান? তারা তাদের সমস্ত সমালোচককেই দেশদ্রোহী তকমা দিয়ে দেয়। এটা কি করে হয় যে সরকার সবসময় ঠিক আর সবাই যারা তাকে সমালোচনা করছে তারা দেশদ্রোহী এবং তাদের গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হচ্ছে?”
ই-রিক্সাতে লিবাসপুরের একটি মেয়ে বলল,” আমি শুনলাম কৃষকরা পুলিশকে মারছে”। আমরা তাকে একজন কৃষক পুলিশী হামলায় মারা গেছে বলায়, সে ট্র্যাক্টারের লম্বা লাইন দেখে বলল “এখানে তো তারা শান্তিপূর্ণই আছে। যদি পুলিশ তাদেরকে মারে এবং খুন করে, তাহলে কৃষকরাও তাদেরকে দুই ঘা দেবে এটা কি আশ্চর্যের?”
আমরা যাদের সাথে কথা বললাম তাদের একজনও যাতায়াতের অসুবিধের ব্যাপারে অভিযোগ করল না এবং সবাই কৃষকদের দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল এবং তাদের জন্য চিন্তিত ছিল।
এই প্রজাতন্ত্র দিবসে, কৃষকরা তাদের এই ঐতিহাসিক আন্দোলনের আরেকটা ফলক পার করল। আমাদের তাদের সাথে শেষ অবধি এই পথ চলতে হবে এবং সেটা তখনই শেষ হবে যখন এই তিন কৃষি আইন ফেরত নেওয়া হবে।
- কবিতা কৃষ্ণান
ভাষান্তর : প্রত্যূষ নন্দী
(লিবারেশান, ফেব্রুয়ারী, ২০২১ সংখ্যা থেকে)