২১ ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবার বিশেষ তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে উঠেছে বাংলার বিধানসভা নির্বাচনের কারণে। ১৯৫২-র একুশের লড়াই ছিল স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে। ২০২১ এর লড়াই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর লড়াই। কুমার রানা, কৌশিক সেন, দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, মৌসুমী ভৌমিক, কপিল কৃষ্ণ ঠাকুর, পুণ্যব্রত গুণ, নব দত্ত, শামিম আহমেদ, অলিক চক্রবর্তী, আশিস কুসুম ঘোষ, সুজাত ভদ্র, মেরুনা মুর্মু, অশোক বিশ্বনাথান, অনুরাধা দেব, পল্লব কীর্তনিয়া, অভিজিৎ বসু, শরদিন্দু বিশ্বাস প্রমুখ আহ্বায়কদের পক্ষ থেকে এই কার্যক্রম আয়োজিত হয়। বস্তুতপক্ষে এবারের একুশে ফেব্রুয়ারী পালন যতটা সাংস্কৃতিক, ততটাই রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে ওঠে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের কারণে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও গণআন্দোলনের ব্যক্তির উদ্যোগে এই দুটি দিককে মিলিয়েই পালিত হল একুশের মিছিল ও গণ সমাবেশ।
একুশের দুটি বর্ণাঢ্য মিছিল যথাক্রমে সুবোধ মল্লিক স্কয়ার ও হাওড়া থেকে ধর্মতলার ওয়াই চ্যানেলে আসে। সেখানে গণসমাবেশে বক্তাদের মধ্যে ছিলেন বিশিষ্ট নাট্যকার ও অভিনেতা কৌশিক সেন, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন-এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, নাগরিক মঞ্চের নব দত্ত, অধ্যাপিকা মেরুনা মুর্মু, দলিত আন্দোলনের নেতা শরদিন্দু উদ্দীপন, চিত্র পরিচালক অর্জুন গৌরিসারিয়া, বামপন্থী আন্দোলনের নেতা হাফিজ আলি সইরানি ও অলিক চক্রবর্তী, ছাত্র নেতা মৃন্ময় সরকার, শ্রমিক আন্দোলনের আশিস নেতা কুসুম ঘোষ প্রমুখ। বক্তব্য রাখেন চা-বাগান শ্রমিকদের আন্দোলনের নেত্রী সিমন্তি এক্কা, ঋণ মুক্তি আন্দোলনের নেত্রী রুমা আহিরি। মিছিলে উপস্থিত ছিলেন মানবাধিকার আন্দোলনের নেতা সুজাত ভদ্র ও দলিত আন্দলের নেতা কপিল কৃষ্ণ ঠাকুর।
অনুষ্ঠানের শুরু, শেষ ও মাঝের পর্বছিল নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পূর্ণ। সঙ্গীত পরিবেশন করেন অগ্নিবীণা গানের দল, জনগণমন গানের দল, বাবুনি ও মেঘনা মজুমদার, নীতীশ রায়, মেরুনা মুর্মু। আবৃত্তি ও শ্রুতি নাটক পরিবেশন করেন ঋদ্ধি আবৃত্তি গোষ্ঠী, অভিজিৎ, মহাশ্বেতা সমাজদার। থ নাট্যগোষ্ঠীর একটি নাটক পরিবেশিত হয় বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে, সমন্বয়ের সংস্কৃতিকে উর্ধ্বে তুলে ধরে।
সভায় উপস্থিত বক্তাদের বক্তব্যে মূলত উঠে আসে ফ্যাসিবাদকে রোখার সংকল্প। সিপিআই(এমএল)-এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, “যারা পরিবর্তনের নাম করে বাংলাকে ধ্বংস করতে চাইবে, আজ এই একুশের ডাক থেকে আমরা সংকল্প নিয়ে যাচ্ছি ওদের ধ্বংস করতে দেবো না। ধ্বংসের বিরুদ্ধে সৃষ্টির গান গেয়ে আমরা এই বিপর্যয় রুখবো। এই বাংলা সকলের বাংলা। এই বাংলা যারা বাংলায় কথা বলেন তাদের বাংলা। এই বাংলার বুকে যারা আদিবাসী ভাষা সে সাঁওতালি হতে পারে বা মুন্ডারি হতে পারে, বিভিন্ন আদিবাসী ভাষা ও সাংস্কৃতিক অধিকারের জন্য যারা লড়াই করছেন সেই আদিবাসীদের বাংলা, এই বাংলা যারা নেপালিতে কথা বলেন তাদের বাংলা। এই বাংলায় যারা ভিন রাজ্য থেকে ভিন্নসময় ধরে এসেছেন, যারা দু-তিন প্রজন্ম ধরে এসে ঘাম ঝড়িয়ে পরিশ্রম করে আসছেন ওই সমস্ত অসংগঠিত শ্রমিক, হিন্দিভাষী শ্রমিক তাদেরও বাংলা।
একুশের ডাক আমাদের জেগে থাকতে হবে। আমরা যদি ঘুমিয়ে পড়ি তাহলে সব লুট হয়ে যাবে। বিরাট বড় বিপর্যয় বিরাট বড় চক্রান্ত চলছে। আসুন আমরা সবাই জেগে থাকি, একে অপরকে জাগিয়ে রাখি, সবাই মিলে যদি জেগে থাকি, সবাই মিলে যদি জোরে কথা বলি, সবাই মিলে যদি প্রতিবাদ করি, সবাই মিলে যদি হাতে হাত মিলিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পায়ে পা মিলিয়ে লড়াই করতে পারি তাহলে অবশ্যই এই বাংলার বুকে রুখে দিতে পারবো এই ফ্যাসিবাদকে।”
অভিনেতা কৌশিক সেন বলেন, “... আমি স্পষ্ট করে বলতে পারি কাকে চাই না। আমি এই রাজ্যে, আমার দেশে ভারতীয় জনতা পার্টির মতো এরকম একটা বীভৎস শক্তিকে চাই না। এইটা আমার গণতান্ত্রিক অধিকার। এইটা একজন সাংস্কৃতিক কর্মী হিসাবে আমি বলবো, এবং বলবো আমার সাংস্কৃতিক বন্ধুদের, কখনো কখনো ক্ষমতা এসে আমার গা-হাত-পা জড়িয়ে ধরে, লতানো গাছের মতো আমার সারা শরীর বেয়ে উঠে পরে, আমার কানের ভিতরে, আমার নাকের ভিতরে আমার মস্তিষ্কের ভিতরে ঢুকে পরে সেই ক্ষমতার চারা গাছ। সেই ক্ষমতা আমার কানের ভিতরে ফিসফিস করে অনেক কিছু করতে বলে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড শব্দটিকে আমরা শুধুমাত্র অভিনয় নাচ গান এইসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে যদি সামগ্রিকভাবে আমার বেঁচে থাকা বলে বিশ্বাস করি, তাহলে সেই বেঁচে থাকার দোহাই কোনোভাবে কোনো ক্ষমতার সাথে আপোষ করবেন না...।”
নাগরিক আন্দোলনের কর্মী নব দত্ত বলেন বিভিন্ন আইন পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে কৃষক শ্রমিক বনবাসী মানুষের নানা অধিকার, পরিবেশ রক্ষার নানা রক্ষাকবচ কীভাবে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এজন্য কেন্দ্রের সরকার আর রাজ্যগুলির অনুমতিরও তোয়াক্কা করছে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন সচিব পর্যায়ের মানুষদের দেওয়া সার্কুলারের মাধ্যমে আইনের ইচ্ছামতো ব্যখ্যা দিয়ে মূল আইনকেই পাল্টে দেওয়া হচ্ছে, এজন্য সংসদের অনুমতিও লাগছে না।
চিত্র পরিচালক অর্জুন গৌরিসারিয়া বলেন, “..... ভাষা আমাদের একে অন্যের সাথে বার্তালাপ করায়, একে অন্যের সাথে পরিচয় করায়, ভালোবাসতে শেখায়, একই সাথে ভাষা প্রতিবাদের অস্ত্র। ... যে ভাষা যেদিন প্রতিবাদ করবে সে ভাষাই হবে আমার ভাষা।”
বিশেষ কারণে সভায় উপস্থিত হতে পারেননি গায়িকা মৌসুমী ভৌমিক। একটি গান ও লিখিত বার্তা পাঠান তিনি। সেই বার্তায় মৌসুমী বলেন, “এত যে ভয় আর ক্ষয়, তার ভিতরে কিছু কিছু দিন নতুন করে আঁকড়ে ধরছি আমরা বাঁচার আর বাঁচাবার তাগিদে। কাল সাত্যকির আর আমার গান ছিল হেই সামালোর উদযাপনে, বরাবরের মতন আমাদের গান মাঠ বা হলে শেষ হয় না, ঘর থেকে যাই, ঘরে ফিরে আসি, রেশ কাটে না। কাল তারপর এই গানটা গাইলাম আবার আমরা। আমি আজ যেতে পারবো না, আমার শরীরে আর দিচ্ছে না, কিন্তু আমি এইটুকু তোমাদের, আমাদের সবার জন্য এখানে রেখে দিলাম। শরীর নরম, গলা ভেঙে যাচ্ছে, গলাও শরীরেরই অংশ ভুলে যাই অনেক সময়। ক্লান্তি সারা দেহে মনে। তবু আজ একুশে সাত্যকির সঙ্গে আমার গান আর লাবণী গান ...।
দার্জিলিং চা বাগানের আন্দোলনের লড়াকু নেত্রী সুমন্তি এক্কা বলেন, “মোদি আমাদের তাঁর মন কি বাত শুনতে বলেন। আমি আমার মন কি বাত বলতে চাই। আমরা করোনা মহামারীর সঙ্গে লড়াই করার সময় নানা কোম্পানির স্যানিটাইজার ব্যবহার করি। তেমনি মোদি মহামারী থেকে বাঁচতে গেলে আমাদের নানারঙের ঝান্ডা নিয়ে একসাথে লড়ে মোদিকে হারাতে হবে।”
শরদিন্দু উদ্দীপনের বক্তব্যে উঠে আসে এনআরসি, সিএএ ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে সমান নাগরিকত্বের ধারণাকে নস্যাৎ করা ও মানুষকে বে-নাগরিক করার চক্রান্তের কথা।
একুশের ডাক – ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বাংলা রুখে দাঁড়াক। একুশের ডাক – মাতৃভাষা, গণতন্ত্র, মানবতা জিন্দাবাদ। বাংলার উদার ঐতিহ্য জিন্দাবাদ। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইতে প্রতিবাদের ভাষা, প্রতিরোধের আগুন দ্বিগুণ শক্তিতে জ্বলে উঠুক – এই সমস্ত আহ্বানের মধ্যে দিয়ে সভার কাজ শেষ হয়।