সকলকে হতচকিত করে দিয়ে দুঃসংবাদটা এলো, যেন এক নির্মম আঘাত হয়ে। কমরেড সুবিমল সেনগুপ্ত আর নেই। মুহূর্তের মধ্যে এ খবর ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে। নদীয়া জেলা তথা ধুবুলিয়ার পার্টি সংগঠনের সমগ্র কর্মীবাহিনী, সমর্থক দরদী, এলাকার সর্বস্তরের মানুষ সকলেই বাকরুদ্ধ! সবার প্রিয় কমরেড - একান্ত আপনজন টাবলুকে হারানোর বেদনায় ধুবুলিয়ায় পার্টি অফিস সন্নিহিত এলাকায় কেবলই হাহাকারের রোল, বুক চাপড়ে কান্না আর বাঁধ না মানা চোখের জল! ৫ ফেব্রুয়ারী রাত ৯টা নাগাদ তাঁর প্রয়াণের শেষ খবরটা এলো। এলাকার অসংখ্য মানুষ ততক্ষণে জড়ো হয়ে গেছেন ঘটনাস্থল ধুবুলিয়ার কাঁঠালবাগান ইউথ সোসাইটি ক্লাবের মাঠ সংলগ্ন এলাকায়। এই ক্লাবের সভাপতি তথা কর্ণধার ছিলেন, এলাকার আপামর জনগণের সব ধরনের কাজের ভরসার মানুষ সুবিমল সেনগুপ্ত বা টাবলু। অনতিদূরেই তাঁর বাড়ী। রাত ৮টার কিছু পড়ে এই মাঠেই গুরুতর আহত-রক্তাক্ত অবস্থায় সুবিমলকে চিনতে পেরে লাগোয়া প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যায় পার্টির স্থানীয় কর্মীরা ও এলাকার মানুষেরা। পার্টি অফিস থেকে মোটর সাইকেলে বাড়ি ফেরার সময় জাতীয় সড়কের এক পাশে কোনো এক জরুরি দরকারে তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন। সে সময় বিপরীত দিক থেকে তীব্র গতিতে আসা এক মোটরসাইকেল তাকে ধাক্কা মারে। নিজের মোটর সাইকেল সহ তিনি ছিটকে পড়ে যান। ধাক্কা মারা মোটর সাইকেলের আরোহী কমবয়সী তিনজন যুবকও ছিটকে পড়ে যায়। প্রচন্ড আঘাতে সুবিমলের বাঁ পায়ের উরু চুরমার হয়ে গিয়ে প্রবল রক্তক্ষরণ হতে থাকে। দ্রুতই তাঁকে নিকটবর্তী ধুবুলিয়া গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ডাক্তাররা জিজ্ঞাসা করলে তিনি অস্ফুট স্বরে জানান তাঁর নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ওটাই তাঁর জীবনের শেষ কথা!
জরুরি তৎপরতায় স্যালাইন অক্সিজেন সহ তাঁকে এ্যাম্বুলেন্সে করে কৃষ্ণনগরে নিয়ে যাওয়া হয়। অচৈতন্য অবস্থায় শক্তিনগর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর জানা গেলো সব শেষ! চিকিৎসার কোনো সুযোগই আর পাওয়া গেলো না। ডাক্তাররা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করলেন। সে সময় কাঁঠালবাগান ক্লাবের মাঠের ঘাসে লেগে রয়েছে চাপ চাপ রক্তচিহ্ন, শোকস্তব্ধ পরিবার ও এলাকার মানুষের ভীড়। কিছু সময় পর বেশি রাতে হাসপাতাল থেকে তাঁর সহযোদ্ধারা, পার্টির স্থানীয় নেতৃত্ব ও কর্মীরা, আত্মীয় পরিজনেরা ভগ্নহৃদয়ে ফিরে এলেন। অর্ধনমিত হলো লাল পতাকা। সুবিমল সেনগুপ্তের জীবনাবসান নদীয়া জেলার বুকে তাঁর নেতৃত্বে এক গৌরবময় সংগ্রামী পর্বের পরিসমাপ্তি ঘটালো। এই অকাল প্রয়াণ কিছুতেই মেনে নেওয়া যাচ্ছে না – এটাই যেন হয়ে উঠলো সুবিমলের কর্মক্ষেত্রের বিস্তির্ণ এলাকার ব্যাপক মানুষের অনুভব। নদীয়া জেলায়’ ৯০-এর দশক থেকে শুরু করে আজকের সময়ের বিপ্লবী কমিউনিষ্ট আন্দোলনের অগ্রণী নেতা সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ্য সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য ও নদীয়া জেলা সম্পাদক চির বিদায় নিলেন।
তাঁর মরদেহ শক্তিনগর হাসপাতাল থেকে বাইরে নিয়ে আসা হলো পরদিন ৬ ফেব্রুয়ারী বেলা ২টায়। তখন সেখানে পৌঁছে গেছেন রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত পার্টির নেতৃত্ব ও কর্মীরা। নদীয়া জেলার বিভিন্ন প্রান্তের অগ্রণী কর্মীদের প্রায় সকলেই। অর্ধনমিত লালপতাকা সহকারে শতাধিক মানুষের মিছিল পৌঁছালো কৃষ্ণনগর চৌধুরী পাড়ায় জেলা অফিসে। সেখানে তার মরদেহে শ্রদ্ধা জানান পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা কার্তিক পাল, রাজ্য নেতা বাসুদেব বসু, নবেন্দু দাশগুপ্ত, কাজল দত্তগুপ্ত, জয়তু দেশমুখ, সলিল দত্ত, প্রবীর হালদার, কৃষ্ণ প্রামানিক প্রমূখ। জেলা কমিটির নেতা স্বপন দাস, বিজয় সাহা, অমল তরফদার, আলতাফ হোসেন, সন্তু ভট্টাচার্য, ধনঞ্জয় গাঙ্গুলী, অপু কবিরাজ, দিলীপ বিশ্বাস সহ অন্যান্যরা। এছাড়াও মাল্যদান করেন সিপিআই(এম) দলের নদীয়া জেলা সম্পাদক সুমিত দে, শ্রমিক নেতা এসএম সাদি প্রমূখ। এর পর লাল পতাকায় সুসজ্জিত মোটর সাইকেল সহ চলমান শেষযাত্রা প্রথমে তার নিজ বাসভবন পৌঁছয়। সেখানে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তাঁর স্ত্রী রুনু সেনগুপ্ত সহ ভাই বোন আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীরা। সেখানে শ্রদ্ধা জানান স্থানীয় বিধায়ক কারামন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাস। এরপর তাঁকে নিয়ে আসা হয় তাঁর নিজ হাতে গড়া এলাকার ক্লাবে। ক্লাবের পতাকা দিয়ে সকলে শ্রদ্ধা জানায়। তারপর তাঁকে আনা হয় তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনের মূল কেন্দ্র ধুবুলিয়া পার্টি অফিসে। সেখানে শেষ শ্রদ্ধা জানায় ধুবুলিয়া এরিয়া কমিটির নেতা জয়কৃষ্ণ পোদ্দার, সুব্রত রায়, শহীদুল মোল্লা, হবিবুর রহমান, ঠান্ডু সেখ, কলম বিশ্বাস, ছবি বিশ্বাস, দয়াল মন্ডল, ফরোজ সেখ প্রমূখ। সেখানে তখন ধুবুলিয়া এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চলের কর্মীদের এবং অসংখ্য মানুষের ব্যাপক সমাবেশ। পার্টি কর্মী সমর্থক ছাড়াও স্থানীয় ক্লাবের কর্মকর্তারা, দলমত নির্বিশেষে এলাকার সর্বস্তরের মানুষেরা, বিভিন্ন বামপন্থী দল এমনকি স্থানীয় সরকারী ও বিরোধীদলের বিভিন্ন নেতারা। যথাযোগ্য মর্যাদায় শায়িত তাঁর মরদেহে সুশৃঙ্খল ভাবে সকলে শ্রদ্ধা জানায়। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিলো মাত্র ৬২ বছর।
সুবিমলের সংগ্রামী ও বিস্তৃত কর্মময় জীবন, সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের পরিধি যে কতদুর ব্যাপ্ত ছিলো শেষ যাত্রায় যেন সেই ছবিটাই পরিস্ফুট হয়ে উঠলো। তাঁকে নিয়ে নেতাজী পার্ক অভিমুখে মিছিলে বিপুল সংখ্যক মানুষ পথ হাঁটেন যাতে জাতীয় সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অবশেষে স্থানীয় শ্মশানে তাঁর অন্তিম কাজ করা হয়। অগণিত মানুষ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন তাঁর বিপ্লবী কর্মজীবন, গ্রামে গঞ্জে মানুষের নানাবিধ সংগ্রামে নেতৃত্বকারী ভুমিকার কথা। ৭০ দশকে ছাত্রজীবন থেকেই তিনি নকশালবাড়ী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। তার দাদা ছিলেন নদীয়া তথা ধুবুলিয়ায় পার্টি প্রতিষ্ঠার অন্যতম এক রাজনৈতিক সংগঠক। এটাও তাকে প্রভাবিত করেছিলো। প্রয়াত কমরেড সুবোধ মজুমদারের সাথে মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি প্রথম গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। পরবর্তীতে কলেজ জীবনে তৃতীয় ধারার ছাত্র সংগঠন পিএসইউ গড়ে তোলেন। ৮০’র দশকের মাঝামাঝি সময়কাল থেকে ধুবুলিয়ার গ্রামাঞ্চলে কৃষক সংগ্রামে বিশেষত খাস বেনামী জমিদখল তথা ভূমিসংস্কারের আন্দোলনে তিনি অগ্রণী নেতৃত্বের ভুমিকা নেন। গ্রামাঞ্চলে শত শত একর জমি দখল করার পাশাপাশি ধুবুলিয়ার বুকেও জমি ও বাস্তুর অধিকারের দাবিতে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যান। স্থানীয় ধুবুলিয়া বাজারে দোকান বসানোর মাধ্যমে বেকারদের কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পার্টি অফিস নির্মাণ করা হয়। নপাড়া অঞ্চলের বিস্তির্ণ গ্রামাঞ্চল থেকে শুরু করে ধর্মদা মুড়াগাছা শালিগ্রাম লাগোয়া দুটি ব্লকের বিরাট এলাকা জুড়ে বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে তিনি ছুটে যেতেন, কৃষকদের বিভিন্ন আন্দোলনের সামনে দাঁড়িয়ে প্রবল আত্মবিশ্বাস আর দৃঢ়চেতা মানসিকতায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন গরিব শ্রমজীবী মানুষের আশা ভরসাস্থল।
কলেজ জীবন শেষ করে কিছু দিন একটা অডিট ফার্মে তারপর ব্যাংকে চাকরি করেন। তারপর ৯০ দশকের শেষে পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হয়ে যান। ৯০ দশকের মাঝামাঝি সময়কালে তিনি পার্টির নদীয়া জেলা কমিটির সদস্য হন, পরবর্তীতে জেলা সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। এই সময়কালে তিনি পার্টির রাজ্য কমিটি ও তারপর রাজ্য সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য হন। ছাত্র জীবন থেকে শুরু করে ধুবুলিয়ার বুকে বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে তিনি অগ্রণী ভূমিকা নিতেন। বলা যায় এ জাতীয় কর্মকান্ডে, তা সে পাবলিক লাইব্রেরি থেকে শুরু করে স্পোর্টস এ্যাসোসিয়েশনের বিভিন্ন দায়ভার কাঁধে নিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অপরিহার্য এক ব্যাক্তিত্ব। তাঁর গুণাবলী ছিলো এমনই যে ভিন্ন মতাবলম্বী মানুষের সাথে মতান্তর হলেও তাঁর কোনো মনান্তর হতো না। রাজনৈতিক আদর্শগত দৃঢ় অবস্থান অটুট রেখেও নানাজনকে সামাজিক কাজে সমন্বিত করার গুণাবলী তাকে বিপুল জনপ্রিয় করে তুলেছিলো। রাজনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক কাজ, মানুষের ছোটখাটো সমস্যায় বিপদে আপদে পাশে থাকা – গণনেতা হিসাবে এই সমস্ত কিছুকে মেলানোর অদ্ভুত দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। ধুবুলিয়ার বুকে বিড়ি শ্রমিক, লোডিং আনলোডিং মজদুর, রেল হকার, টোটো চালক এই সমস্ত ক্ষেত্রগুলিতে ইউনিয়ন গড়ে তোলা এই মেহনতী মানুষদের ন্যায্য মজুরি ও সামাজিক সুরক্ষার জন্য আন্দোলন গড়ে তোলা, পাশাপাশি যুবকদের সংগঠিত করা এই সমস্ত কর্মকান্ডে অগ্রণী নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করে গেছেন। ধুবুলিয়া এলাকার নানা জায়গায় পৃথক ভাবে তাঁর স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে। লোডিং আনলোডিং ইউনিয়ন টিবি গেটে স্মরণ সভা করে৷ ১৬-১৭ নং ব্রাঞ্চ স্থানীয় দুর্গামন্দির চত্তরে এলাকার বহু মানুষকে সমাবেশিত করে স্মরণ সভা করে। টোটো ইউনিয়ন ধুবুলিয়া বাজারের স্ট্যাণ্ডে অনুরূপ সভা করে। তার আদর্শকে পাথেয় করে, বিভিন্ন গুণাবলী থেকে শিক্ষা নিয়ে স্থানীয় কমরেডরা নিজেদের মনকে দৃঢ় করে এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। প্রকৃতই এক সংগ্রামী গণনেতা, ক্লান্তিহীন এক অনুভবী মানুষ কমরেড সুবিমল সেনগুপ্তকে জানাই লাল সেলাম।