“রথ ভাবে আমি দেব, পথ ভাবে আমি, মূর্তি ভাবে আমি দেব; হাসে অন্তর্যামী”। গত ৬ ফেব্রুয়ারী; নবদ্বীপ থেকে শুরু হয়েছে আসন্ন নির্বাচনে বঙ্গবিজয়ের লক্ষ্যে বিজেপির হাইভোল্টেজ ‘পরিবর্তন যাত্রা’। রাজ্যের ২৯৪ আসন ছুঁয়ে হাইটেক রথে চড়ে দফায় দফায় পরিক্রমা করবেন বিজেপির সর্বভারতীয় নেতৃত্ব। সেই আশির দশক থেকে চলা আদবানীর রথযাত্রার মডেল এখনও বিজেপির কাছে নির্বিঘ্ন শহর-নগর-গ্রামে মানুষের মাঝে বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা- সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করার একমাত্র হাতিয়ার। সেকারণেই রবীন্দ্রনাথের কবিতাংশটি মনে এসে গেল। তবে এক্ষেত্রে দেবতাটি কে তা একমাত্র বলতে পারবে জনগণের ‘মন কি বাত’! যাই হোক, এই ‘পরিবর্তন যাত্রা’য় ইতিমধ্যে দুবার এসে গেছেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডা। অমিত শাহ ঘুরে গেছেন। আবার আসবেন। মায় আমাদের ‘আন্দোলনভোগী’ প্রধানমন্ত্রীও জেলায় ঘুরে গেলেন। ব্রিগেড ছাড়াও আরো আসবেন নাকি পশ্চিমবাংলার অন্দরমহলে! আসলকথা পুরো হিন্দি বলয় জুড়ে কৃষি বিলের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত কৃষকদের ‘মহাপঞ্চায়েত’ বিজেপি-আরএসএস-কে আক্ষরিক অর্থে তাড়া করছে। সেই তাড়া হজম না করতে পেরে ওরা এসে তল্পী গাড়তে চাইছে এই বারভূঁইয়ার দেশে। ওনারা নাকি পরিবর্তন এনে এই প্রদেশকে ‘সোনার বঙ্গাল’ করে দেবেন। বাংলাকে জানে না, চেনে না। বাংলার সংস্কৃতি, বাঙালি জীবনচর্যা সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণাহীন বিজাতীয় এই শক্তি শুধুমাত্র সংগঠিত ধর্মকে হাতিয়ার করে, ‘জয় শ্রীরাম’ এই হন্তারক শ্লোগানের জিগির তুলে পশ্চিমবঙ্গকে ওদের একমাত্রিক ‘হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তান’ প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। ওদের সুবিধা হয়ে গেছে একটা জায়গায়-বাংলার এখনকার শাসকদল মূলত মতাদর্শহীন; দলের সম্বল একমাত্র নেতৃর অনুপ্রেরণা। আভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ও তৃণমূলস্তরে দুর্নীতি প্রশ্নে শাসক তৃণমূলের অবস্থানও প্রশ্নের ঊর্ধে নয়। এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে রাষ্ট্রীয় নিরঙ্কুশ ক্ষমতার বলে বলিয়ান হয়ে, অঢেল অনৈতিক অর্থ ও পেশিশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে কৃষক আন্দোলনের ফলে নিজের গড় হিন্দি-বলয়ে কোণঠাসা, মরিয়া বিজেপি। দলবদল, ঘোড়া কেনবেচা এখন বাংলায় নিত্যদিনের ঘটনা। ফ্যাসিবাদের আগ্রাসী ভূমিকা জনগণ দেখছে। আপাদমস্তক এক অপদার্থ কেন্দ্রীয় সরকার যে কিনা মাত্র ৬ বছরে দেশের অর্থনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতিকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে খাদের কিনারে — সেই চোরের মায়ের বড় গলা।ওরা নাকি ডবল ইঞ্জিন দিয়ে অর্থাৎ কেন্দ্র-রাজ্য যুগপৎ সহযোগিতা দিয়ে বাংলায় উন্নয়নের বন্যা বইয়ে দেবে? ত্রিপুরার মানুষকেও এই একই কথায় ভুল বুঝিয়ে ওরা ক্ষমতায় এসেছিল। আজ ত্রিপুরার মানুষ বুঝছে – ফ্যাসিবাদ কি ও কেমন? জনগণ সব দেখেছে কিভাবে মোদী- অমিত শাহ-মোহন ভাগবতের আরএসএস-বিজেপি বিমুদ্রাকরণ; জিএসটি, কাশ্মীরের ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি, উচ্চতম ন্যায়ালয়কে কাজে লাগিয়ে রামমন্দির নির্মাণ; দাভোলকর, পানশারে, কালবুর্গী, গৌরীয় লঙ্কেশ হত্যা; ভীমা কোরেগাঁও মামলা; গো-রক্ষক বাহিনী; জয় শ্রীরামের নামে মব লিঞ্চিং; দলিত হত্যা; ধর্ষণ সংস্কৃতি; তাৎক্ষণিক তিন তালাক আইন; লাভ জিহাদ আইন, করোনা কালে অপরিকল্পিত লকডাউন; পরিযায়ী শ্রমিকদের সাথে অমানবিক আচরণ; ব্যাঙ্কে জনগণের সম্পত্তি লুট হতে দেওয়া; বিলগ্নীকরণের নামে জলের দরে দেশের সম্পত্তি বেঁচে দেওয়া; কৃষকদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে নির্বিচারে দমনপীড়ন; এনপিআর-সিএএ-এনআরসি; ইত্যাদি ইত্যাদি চরম নেতিবাচক যা কিছু আজকের এই ব্রাহ্মণ্যবাদী ফ্যাসিস্ট ভারতে কার্যকর হচ্ছে সবই করছে এই সরকারের প্রতিনিধিরা। এসব করেও বাংলার নির্বাচনে ওরা পরিবর্তনের আওয়াজ তুলছে। কি পরিবর্তন আনবে ওরা? কোন মডেলকে প্রতিষ্ঠা করবে? গুজরাট মডেল? নাকি উত্তরপ্রদেশ মডেল! নরেন্দ্র মোদীর সাধের গুজরাট মডেলের অন্তঃসার আগেই উন্মোচিত হয়েছে। যোগী রাজ্য তো অত্যাচারী দুষ্কৃতিদের রাজ্য-এ ভীষণই প্রতিষ্ঠিত সত্য। আর আমাদের পশ্চিমবাংলা?
এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ তবু “‘ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরো’ দু’বছর (২০১৮ ও ২০১৯) কলকাতাকে দেশের ‘সেফ সিটি’র তকমা দিয়েছে। অন্য শহরের তুলনায় এই শহরের নারী নিরাপত্তা যে অনেকটাই ভালো, তা বারবারই উঠে এসেছে ‘ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরো’র পরিসংখ্যানেও। খোদ কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে থাকা দিল্লি পুলিশেরসঙ্গে কলকাতার তুলনা করে ওই পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ সালে এই শহরের ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১৪টি। আর দিল্লিতে ১২৩১টি। [সূত্র- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২০.০২.২১] উপরি লিখিত অংশটি অনুধাবন করলেই বোঝা যায় সত্যি অর্থে ইতিবাচক পরিবর্তন বিজেপির সিলেবাসের বিষয় নয়। ওরা মূলত পরিবর্তন করতে চায় বাঙালি জীবনে বহু ঝরঝাপটা সত্ত্বেও আজও টিকে থাকা বাংলার নবজাগরণের উদার মানবিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।ওরা বাংলার অতীতে, ঝেটিয়ে বিদায় করা বাবু কালচার আবার ফিরিয়ে আনতে চায়। বিজেপির প্রকল্প অনুযায়ী বাংলা কেমন দেখতে হবে? খোদ প্যারিচাদ মিত্রর ‘আলালের ঘরের দুলাল’ থেকে সেই উদাহরণকে দেখে নেওয়া যাক। বাবু “মতিলাল ধূমধামে সর্বদাই ব্যস্ত – বাটিতে তিলার্ধ থাকে না। কখন বনভোজনে মত্ত কখন যাত্রার দলে আকাড়া দিতে আসক্ত কখন পাঁচালির দল করিতেছে কখন সকের কবিওয়ালদিগের সঙ্গে দেওরা দেওরা করিয়া চেঁচাইতেছে কখন বারোয়ারী পূজার জন্য দৌড়াদৌড়ি করিতেছে কখন খেমটার নাচ দেখিতে বসিয়া গিয়াছে কখন অনর্থক মারপিট, দাঙ্গা-হাঙ্গামে উন্মত্ত আছে। নিকটে সিদ্ধি, চরস, গাঁজাগুলি মদ অনবরত চলিতেছে গুড়ুক পালাই পালাই ডাক ছাড়িতেছে। বাবুরা সকলেই সর্বদা ফিটফাট মাথায় ঝাঁকড়া চুল, দাঁতে মিসি, সিপাই পেড়ে ঢাকাই ধুতি পরা বুটোদার একলাই ও গাজের মেরজাই গায়ে, মাথায় জরির তাজ, হাতে আতরে ভুরভুরে রেশমের হাত রুমাল ও এক এক ছড়ি, পায়ে রুপার বগলসওয়ালা ইংরাজি জুতা। ভাত খাইবার অবকাশ নাই কিন্তু খাস্তার কচুরি, খাসা গোল্লা,বরফি, নিখুঁতি, মনোহরা ও গোলাবি খিলি সঙ্গে সঙ্গে চলিয়াছে। — সন্ধ্যার পর বাবুরা দঙ্গল বাঁধিয়া বাহির হন হয় তো কাহার বাড়িতে পরিয়া লুঠতরাজ করেন নয় তো কাহার কানাচে আগুন লাগাইয়া দেন হয়তো কোনো বেশ্যার বাটীতে গিয়া শোর সরাবত করিয়া তাহার কেশ ধরিয়া টানেন বামশারি পোড়ান কিংবা কাপড় বা গহনা চুরি করিয়া আনেন নয় তো কোন কুলকামিনীর ধর্ম্মনষ্ট করিতে চেষ্টা পান”। বাংলা এই সংস্কৃতিকে সবলে তার কক্ষচ্যুত করেছে বিগত শতকের নবজাগরণের কালে। আজবিজেপি তাকেই ফিরিয়ে আনতে চাইছে নব আঙ্গিকে। পরিবর্তন করতে চাইছে উদার বাঙালির সহজিয়া মুখকে। একবিংশ শতাব্দীতে নতুন করে ফিরে আনতে চাইছে কৌলিন্য প্রথা অধ্যুষিত বাহ্মন্যবাদী বাংলাকে।
বাংলাকে করতে চাইছে মুসলমান-দলিত বিরোধী এক নব উত্তরপ্রদেশ।
কথা শেষ — কিন্তু পরিবর্তনের জন্য বিজেপির এই মরিয়া প্রচেষ্টা এতো সহজে হবে না। বিজেপিকে লড়তে হবে — “আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে — এই বাংলায়” এই অনুভূতির সঙ্গে। বিজেপিকে লড়তে হবে -- “একসাথে চল গড়বো মোরা রঙ্গা দুনিয়া” এই তীব্র অনুভবের সঙ্গে। দেখা যাক সময় কি বলে?
- সিতাংশু চক্রবর্তী