মাঝে মাঝে তিনি মনকে অর্গলমুক্ত করেন! আম জনতার উদ্দেশে অর্ধনিমীলিত নেত্রে, সুনিয়ন্ত্রিত স্বরক্ষেপনে, প্রগাঢ় বাচনে ‘অমৃত’বর্ষণ করেন! কিন্তু সব উপদেশ কি আর ফলে! তিনি যখন থালি বাজাইয়া দীপ জ্বালাইয়া করোনা নির্মূলের নিদান দিলেন, অতীব দুষ্ট সেই জীবাণু প্রায় সার্ধলক্ষ প্রাণ কাড়িয়া ছাড়িল!
ইদানীং তাহার সযত্ন লালিত শ্মশ্রু গুম্ফ শোভিত মুখে খানিকটা ‘ঋষিতুল্য’ ভাবের উদয় হইয়াছে। মন্দ লোকেরা অবশ্য এই রাবীন্দ্রিক শ্মশ্রুর পশ্চাতে কূট উদ্দেশ্য দেখিতেছে। এই নূতন ‘ঋষিতুল্য লুক’-এর আড়ালে অতি পরিচিত ক্রূর মুখটি গোপন করিয়া, নূতন ‘ইমেজ’-এ বঙ্গবাসীকে মোহাবিষ্ট করাই নাকি উদ্দেশ্য!
আপামর জনতার জাগতিক সুখ-দুঃখআনন্দ-বেদনায় তিনি নির্বিকার! গত বৎসর দেশের রাজধানীতে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত হত্যাতাণ্ডবে তাহার স্নেহভাজনেরা ‘দেশকে গদ্দারোঁকো’ ইত্যাদি শ্লোগানসহ প্ররোচনা দিয়াছিলেন (যাহাদের একজন ‘অতি বিশিষ্ট’ – গত দই বৎসর ধরিয়া ‘দেশের বিলগ্নীকরণ বাজেট’ ভাষণের নৃত্যপর উপস্থাপনায় যাহার অতি শিষ্ট উপস্থিতি লক্ষণীয়)। সেই হত্যালীলায় উস্কানিদাতাদের পরিবর্তে প্রশাসন নিগৃহীতদের, সমান নাগরিকত্বের আন্দোলনকারীদের গারদে পুরিল। তিনি নীরব! লকডাউন ঘোষণা হইতে, লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকের হাজার মাইল পদব্রজের অসহায়তা, পথিমধ্যে অন্তঃসত্ত্বার মৃত্যুর বেদনা, কোটি কোটি কর্মচ্যুত মানুষের হাহাকার, দেশের আর্থিক বিকাশরেখার ক্রমপতন ও ঋণাত্মক হওয়া-এ সকল বিষয় তিনি ধর্তব্যের মধ্যেই আনিলেন না। তথাকথিত ভীমা কোরেগাঁও মামলায় মিথ্যা অভিযোগে দুই বৎসর যাবৎ বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, সমাজকর্মী, কবি (যাহাদের মধ্যে দুইজন অশীতিপর চলচ্ছক্তিহীন মানুষ কারাযন্ত্রণার পীড়নে মুমূর্ষুপ্রায়) বিনা বিচারে আটক রহিয়াছেন, জামিন পর্যন্ত হয় নাই (অতি সম্প্রতি অবশ্য কবির চিকিৎসার্থে শর্তাধীন সীমিত সময়ের জামিন মিলিয়াছে বটে!) দেশের ‘প্রধান অভিভাবক’ তাহাতে বিস্ময়করভাবে অবিচলিত!
দেশের কৃষক সমাজ, তাহার অতি সাধের কর্পোরেটরাজ কায়েমের বাসনায় জল ঢালিয়াছেন! তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে তিন মাসব্যাপী সত্যাগ্রহে অনড় থাকিয়া তাহার শিরঃপীড়ার কারণ হইয়াছেন। এই অনমনীয় দৃঢ়পণ লড়াইয়ে দেশের সকল মানুষ যাহারা গত প্রায় সাত বৎসর ধরিয়া কেন্দ্রের হিন্দুত্ববাদীদের গণতান্ত্রিক রীতি প্রকরণকে পদদলিত করিয়া সমস্ত জুলুম, বেনিয়মের বেত্রাঘাত সহিতেছেন, যাহাদের হাজার প্রতিবাদ শাসকের আকাশচুম্বী ঔদ্ধত্যে প্রতিনিয়ত প্রতিহত হইতেছে, তাহারা যেন এই আন্দোলনে এক সমস্বর প্রতিবাদের ভাষা পাইয়াছেন! গত ২৬ জানুয়ারী প্রজাতন্ত্র দিবসে আম জনতা গর্বিত বিস্ময়ে, আত্মহারা আনন্দে প্রত্যক্ষ করিয়াছেন, ধূলিধূসর লাখো কৃষকের হিম্মতের ‘ট্রাক্টর প্যারেড’ কীভাবে মন্ত্রী সান্ত্রী আমলা রাজনীতিকদের ঔদ্ধত্য, আভিজাত্য প্রদর্শনের একচেটিয়া অধিকারকে ম্লান করিয়া দিয়াছিল! সেই হিম্মতের প্যারেড প্রধান ‘অভিভাবকের’ হৈমালিক উপেক্ষায় অবশেষে আঁচড় কাটিতে সক্ষম হইয়াছে!
সেই দিন লাল কিলায় এক বিক্ষিপ্ত ঘটনার উল্লেখ করিয়া, তিনি স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় আবেগ থরথর কণ্ঠে বলিয়াছিলেন, জাতীয় পতাকার অবমাননায় বিশ্বের কাছে নাকি ভারতের মুখ পুড়িয়াছে!
বটে! ইতোপূর্বে তাহার কারণে বহুবার ভারতের মাথা হেঁট হয় নাই? যখন তাহার মুখ্যমন্ত্রিত্বে একটি রাজ্যে রাষ্ট্রপোষিত সাম্প্রদায়িক হিংসায় প্রায় দুই সহস্র প্রাণ বলি হইয়াছিল? হাজার হাজার নারীর সম্ভ্রম লুঠ হইয়াছিল? যখন সমস্ত রাষ্ট্রীয় শিষ্টাচারের মুখে কালি লেপিয়া বিদেশে এক রাষ্ট্রপ্রধানের নির্বাচনী প্রচার করিয়াছিলেন (‘আব কি বার ট্রাম্প সরকার’), সেই রাষ্ট্রপ্রধান যখন তাহার দেশের মানুষের কাছে প্রত্যাখ্যাত হইলেন – তখন আরেকবার? ৩৭০ ধারা বিলোপের পর হইতে কাশ্মীরী জনগণের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার, গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ, শিশুদের পর্যন্ত পেলেটে চোখ অন্ধ করিয়া দেওয়া? দীর্ঘ প্রায় দেড় বৎসর ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রাখিয়া (অতি সম্প্রতি ইন্টারনেট চালু হইয়াছে) কাশ্মীরী জনগণকে বিপর্যয়ে ঠেলিয়া দেওয়া, অর্থনীতির কোমর ভাঙিয়া দেওয়া? একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের প্রধান হইয়া ‘রামমন্দিরের’ শিলান্যাস করা এবং সমস্ত স্বাধীনতা সংগ্রামীর দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ রঞ্জিত স্বাধীনতা দিবসের গরিমাকে ধূলায় লুটাইয়া শিলান্যাসের দিনটিকে ‘স্বাধীনতা দিবস’ আখ্যা দেওয়া? অপরিকল্পিত লকডাউনে মানুষকে, বিশেষত পরিযায়ী শ্রমিকদের অবর্ণনীয় দুর্দশায় ঠেলিয়া দেওয়া? দিল্লী সীমানায় ভয়াবহ ঠাণ্ডার হিংস্র কামড়ের মধ্যেও অবিচল কৃষকদের উপর প্রশাসনিক মদতে হিন্দুত্ববাদী গুণ্ডাবাহিনীকে তাণ্ডব চালাইতে দেওয়া? কর্পোরেটের কোম্পানি রাজ কায়েমের জন্য কৃষক ও জনতার স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেওয়া? কৃষকদের অনড় সংকল্পে ব্যর্থকাম হইয়া তাহাদের পানীয় জল,বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট বন্ধ করিয়া কংক্রিট-গজাল-কাঁটাতারে দেশের মধ্যেই অবরুদ্ধ রাখা? বিশ্ববাসী কি এই সব জঘন্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় চক্ষু মুদিয়াছিলেন? আসলে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগ্রামী প্রতিস্পর্ধা তাহাকে প্রতিহিংসা পরায়ণ করিয়া তুলিয়াছে!
এ হেন ব্যক্তিটি যে আদৌ সত্য ও ন্যায়ের পথিক নহেন এবং জনগণের পক্ষেও নহেন—এ বিষয়ে রাজনৈতিক মহলে অন্তত কিঞ্চিন্মাত্র সন্দেহ থাকিতে পারে না, যতই ‘ভোল’ পরিবর্তন করুন!
সম্প্রতি বঙ্গের শাসকদলের নেতা কর্মীদের মধ্যে এক অদ্ভুত রোগের সংক্রমণ দেখা দিয়াছে। ‘পদ্মরোগ’! কিছুকাল টানাপোড়েনের পর – কোনো এক সুপ্রভাতে পদ্মবনে প্রস্ফুটিত হওয়া! ‘হেভিওয়েট’ মন্ত্রী হইতে পঞ্চায়েতের চুনোপুঁটি নেতা-সবারই এক ‘অভিযোগ’—একই সঙ্গে!’দলের মধ্যে দম বন্ধ হইয়া আসিতেছে’! এই ‘গণতান্ত্রিক অধিকারবোধ’ এখনই হঠাৎ কুম্ভকর্ণের নিদ্রা ভাঙিয়া প্রবল বিক্রমে জাগিয়া উঠিল? রহস্যটি কী? কিছু দিন ধরিয়া পদ্মদলের রাজ্য সভাপতিকে অবশ্য এক রহস্যময় ‘পলিটিক্যাল ভ্যাকসিন’-এর কথা বলিতে শুনা যাইতেছে! তিনি কতজনকে, কী মাত্রায় তাহা প্রয়োগ করিয়াছেন, তিনিই জানেন।ইহা কতটা ‘পলিটিক্যাল’ তাহা লইয়া সন্দেহ থাকিলেও, ইহার কার্যকারিতা অমোঘ! যেন হ্যামলিনের বংশীবাদকের সম্মোহনে ইন্দূরের পাল পিল পিল করিয়া চলিয়াছে! টলি পাড়াতেও সংক্রমণ ভয়ানক আকার নিয়াছে। এই এই খানেই আমাদের বিস্ময়। এই জুমলা দলটিকে সততা, ন্যায়, আদর্শবোধের ‘পরাকাষ্ঠা’ ঠাওরাইবার কারণটি কী?
এই আবহেই তিনি বঙ্গে আসিলেন — জুমলা দলের কর্ণধার! দিল্লীর বাকি পদ্মনেতারা তো ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করিতেছেনই। তিনি আসিয়াই রাবীন্দ্রিক শ্মশ্রু-গুম্ফের আড়ালে রহস্যঘন কণ্ঠে ‘আসল পরিবর্তন’-এর কথা শুনাইলেন! ‘আসল পরিবর্তন’!! সেটি কি তোলাবাজির পরিবর্তে জুমলাবাজি! বঙ্গবাসীর এখন ‘ছাড়িয়া দে মা, কাঁপিয়া বাঁচি’ অবস্থা! উদরান্নের সংস্থান কঠিন হইয়াছে ঠিকই। কিন্তু একেবারে ‘তৃণভোজী’ ভাবিয়া ফেলা কি ঠিক হইতেছে?