পশ্চিমবাংলায় অতিমারী পরবর্তী পরিস্থিতিতে প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে বিভিন্ন বর্গের স্কুল শিক্ষকদের নানা বিক্ষোভ আন্দোলন। রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে এইসব আন্দোলন চলে আসছে বিগত সাত-আট বছর যাবত। বলতে গেলে আন্দোলন তুঙ্গে উঠেছিল লকডাউন পূর্ববর্তী সময়ে, লকডাউনকালীন উপায় ছিল না রাস্তায় নামার, আনলক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতেই বিক্ষুব্ধ শিক্ষককুল নাছোড়, আবার নামতে শুরু করেছেন রাস্তায়। কারণ রাস্তায় নামা ছাড়া ‘রাস্তা’ নেই। জীবন-জীবিকার নিরাপত্তাহীনতা থেকে তৈরি হওয়া সংকট রাস্তায় নামতে বাধ্য করছে। কারণ রাজ্য সরকার কথা রাখছে না। সমানে চলছে বঞ্চনা, অবহেলা, উপেক্ষা আর উৎপীড়ন। সরকারের আচরণে মানবিকতার লেশমাত্র থাকছে না। সরকার কৌশল নিয়ে চলছে কেবল নানা অজুহাত, অন্তঃসারশূন্য প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিরস্ত করে রাখার। অপযুক্তিগুলোর প্রতি অবাধ্য হলে দেওয়া হচ্ছে নানা ‘চক্রান্তে’র লেবেল আর পুলিশী দাওয়াই। কথায় চালু আছে, শিক্ষকসমাজ হল প্রজন্ম তৈরির কারিগর ও সমাজ গঠনের অন্যতম মেরুদন্ড। অথচ সেই শিক্ষকদের এক উল্লেখযোগ্য অংশ লাগাতার পীড়িত হচ্ছেন সরকারপক্ষের পীড়নে।
গন্ডগোলের জের চলছে ২০১১ সালে রাজ্যে শাসকের পট পরিবর্তনের সময়কাল থেকেই। শিক্ষক নিয়োগ নীতি প্রণয়নের প্রশ্নে পরিবর্তিত সরকার গোড়াপত্তনেই শুনিয়ে রেখেছিল পূর্বতন বাম আমলের রেখে যাওয়া অস্বচ্ছতা ও জটজটিলতা অজস্র। নতুন সমাধান দেওয়ার পথে এক কঠিন সমস্যা। তাই সমাধানের উপায় নির্ধারণে সময় লাগবে। মমতা সরকার তখন বলেছিল সবকিছু ধাপে ধাপে শুরু করবে। বহুরকম সমস্যা আছে। শিক্ষকদের স্থায়ীকরণ, বেতন কাঠামো নির্ধারণ, শিক্ষক রয়েছেন বিভিন্ন বর্গের। তারপরে নিয়োগের অপেক্ষায় রয়েছেন ‘টেট’ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পুরানোরা, পাশাপাশি লাইনে থাকা আশায় আশায় নতুনরা, সব ধরনের প্রত্যাশীদের দাবির প্রতি সুবিচার করতে হবে ধাপে ধাপে, তার জন্য সময় লাগবে ছ’মাস থেকে তিন বছর। তারপর সময় গড়িয়েছে, কিন্তু সরকার সুড়ঙ্গের শেষে সুরাহার আলো দেখায়নি। বরং সরকারের মনোভাবে, অবস্থান গ্রহণে, আচরণে ক্রমশ অসংবেদী, অস্বচ্ছ, প্রতিশ্রুতি খেলাপী, বেদরদী, স্বজনপোষণ ও দমনকারী ভূমিকা প্রকাশ হতে থাকে। ২০১১ থেকে প্রথম পর্বে সরকারের স্বরূপ তত প্রকট না হলেও ২০১৬-র দ্বিতীয় পর্বে উৎকট আকার ধারণ করে। সরকারের দিক থেকে আলোচনার দরজা যে খোলা হয়নি তা নয়, কখনও কখনও হয়েছে; কিন্তু হয়েছে প্রথমত খুব কমই, দ্বিতীয়ত চালাকির আশ্রয় নিয়ে, তৃতীয়ত সত্য-মিথ্যা গুলিয়ে দেওয়ার তথ্য-পরিসংখ্যান সহযোগে। তাছাড়া যত না উৎসাহ দেখানো, তার চেয়ে অনেক বেশি নিরাশ বা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। শিক্ষকরা বারেবারে নিজেদের তাগিদে লাগাতার সমীক্ষা রিপোর্ট তৈরি করে, সরকারের নীতি-পলিসির ত্রুটি-বিচ্যুতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে, আইন-আদালতের দ্বারস্থ হয়ে, সমস্তরকমভাবে দাবির সপক্ষে জনমত অর্জন করেছেন। একমাত্র রাজ্যের শাসকদল এই ফয়সালা না করা সমস্যা সমূহকে ‘ভূতের বোঝা’ বলে বোঝাতে চায়। বিগত দশ বছরে প্রতিবিধান না পাওয়ার পরিণামে আত্মহত্যা সহ অনাহার-অর্ধাহারে-অপুষ্টিতে-রোগভোগে-বিনা চিকিৎসায় সবরকম মিলে শতাধিক সাথীর মর্মান্তিক অকালপ্রয়াণ ঘটেছে। আন্দোলন চালিয়ে আসছেন পার্শ্বশিক্ষক, চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক, শিক্ষা সহায়ক, শিক্ষামিত্ররা, সোচ্চার অনুমোদন বিহীন মাদ্রাসা শিক্ষকরা। রয়েছেন আরও অনেক অংশ। কোনও অংশকেই সরকার সন্তোষজনক সমাধান দিতে পারছে না।
বহু টালবাহানার পর মুখ্যমন্ত্রী সদ্য জানালেন, পার্শ্ব ও চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক এবং শিক্ষা সহায়ক ও শিক্ষাবন্ধু — এই চার বিশেষ অংশ ফি-বছর তিন শতাংশ হারে বেতনবৃদ্ধির সুবিধা ও অবসরকালে তিন লক্ষ টাকা পাবেন। কিন্তু তাছাড়া অন্যান্য দাবির বিষয়ে অর্থাৎ স্থায়ীকরণ ও স্থায়ী বেতন কাঠামো, সম কাজে সম বেতন সহ অন্যান্য সুবিধা পাওয়ার প্রশ্নে সরকার এখনও মুখ খুলছে না। অন্যদিকে, নতুন নিয়োগের দাবিও অতি বাস্তব ও যুক্তিসম্মত। অভাবের নমুনাগুলো নজর করলেই চোখ কপালে ওঠে। স্কুলগুলিতে শিক্ষক ঘাটতি থাকছে যথেষ্ট সংখ্যায়। সাধারণ স্কুলগুলিতে তবু পূর্ণ সময়ের শিক্ষকসংখ্যার ভারসাম্য সামলে নেওয়ার মতো। কিন্তু জনজাতি ভাষা মাধ্যমের স্কুলগুলিতে পূর্ণ সময়ের শিক্ষকের আকাল। পাশাপাশি লক্ষ্যণীয়, ২০১৪ সালে প্রাথমিকে টেট পরীক্ষা দেওয়া উত্তীর্ণদের প্রথম মেধা তালিকা প্রকাশ হল ২০২১-এ। ২০১৭-তে বিজ্ঞপ্তি জারি করা টেট পরীক্ষা নেওয়াও হল একমাস হয়নি। দীর্ঘসূত্রিতা চলছে কি মাত্রায়! এসব নিয়ে এখনও হয়ত তেমন প্রশ্ন ওঠেনি, তবে উঠবে না এমন নিশ্চয়তা নেই। চলত হয়ত আরও অনাচার। কিন্তু নিকটে নির্বাচন পরিস্থিতি। শিক্ষক আন্দোলনও হচ্ছে বেগবান, ধেয়ে যাচ্ছে ‘বিকাশভবন’, ‘নবান্ন’ বা মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন অভিমুখে। আন্দোলন সরকারকে বাধ্য করছে কিছু পদক্ষেপ করতে। এই অভিজ্ঞতা শেখাচ্ছে আরও জোরদার ও ব্যাপক করে তুলতে হবে আন্দোলন। শিক্ষকদের আন্দোলনের অধিকার ও দাবি খুবই ন্যায়সঙ্গত।
সুযোগ বুঝে নির্বাচনী দাঁও মারতে শিক্ষক আন্দোলনের প্রতি ‘সমর্থনের’ ভন্ডামী দেখাতে শুরু করেছে বিজেপি। যে দল কেন্দ্রের ক্ষমতাকে ব্যবহার করছে শিক্ষা সংকোচন, শিক্ষায় সরকারি বিনিয়োগ ক্রমাগত কমিয়ে দেওয়া, শিক্ষার গৈরিকীকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণে; এবারের কেন্দ্রীয় বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কমিয়ে দিল ৬.১৩ শতাংশ, যারা দিল্লীর কৃষক আন্দোলনের প্রতি নিয়েছে ঔপনিবেশিক শাসকের অনুরূপ বৈর অবস্থান, তারা আবার এরাজ্যে সাজতে চাইছে ‘শিক্ষক দরদী’! এহেন ধূর্তামী থেকে রাজ্যের শিক্ষক সমাজ ও শিক্ষক আন্দোলনকে থাকতে হবে সম্পূর্ণ সংস্রব মুক্ত।