ক’দিন পর পেশ করা হবে সাধারণ বাজেট। আর, একে কেন্দ্র করেই এখন যাবতীয় আলাপ আলোচনা ঘুরপাক খাচ্ছে অর্থনৈতিক দুনিয়ায়। যেহেতু ভারতের বাজেট আন্তর্জাতিক অর্থনীতির ক্ষেত্রেও গুরুত্ব বহন করে, তাই আন্তর্জাতিক মহল ও নিবিড় পর্যবেক্ষণ করছে দেশের আর্থিক গতিপ্রকৃতির উপর। বলাই বাহুল্য, যে মোদী সরকার ডাহা মিথ্যা ও অসত্য ভাষণকে তার শাসন প্রণালীর এক অভিন্ন প্রকরণ বানিয়ে ফেলেছে, অর্থনীতির ক্ষেত্রেও সেই মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর দপ্তর থেকে। বলা হচ্ছে, এবার ভারতীয় অর্থনীতি নাকি ইংরাজির আদ্যাক্ষর ভি-র মতোই আবার পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠার মুখে দাঁড়িয়ে। কিন্তু নির্মম বাস্তবটা ঠিক কি?
এই নভেম্বর মাসে দেশের শিল্পোৎপাদন ১.৯ শতাংশ হারে সংকুচিত হয়ে ঋণাত্বক ক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে দু’মাসের ব্যবধানের পর। সরকারী তথ্য দেখাচ্ছে, এর প্রধান কারণ ম্যানুফ্যাকচারিং ও খনি, এই দু’টি ক্ষেত্রের দুরাবস্থা। যে ম্যানুফাকচারিং ক্ষেত্র শিল্পীয় উৎপাদন সূচকে ৭৭.৬৩ শতাংশ অবদান রাখে, ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিকাল অফিস বা এনএসও-র সদ্য প্রকাশিত তথ্য দেখাচ্ছে, সেই ক্ষেত্রটি নভেম্বর মাসে সংকুচিত হয়েছে ১.৭ শতাংশ হারে। ওই নভেম্বর মাসে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৩.৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেলেও খনি সংকুচিত হয়েছে ৭.৩ শতাংশ হারে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কোভিড-১৯-এর দরুণ শিল্প উৎপাদন গত বছর মার্চে ১৮.৭ শতাংশে নেমে যায় আর আগস্ট ২০২০ পর্যন্ত ঋণাত্বক ক্ষেত্রেই বিচরণ করে।
কদিন আগে সেন্টার ফর মনিটারিং ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমইআই) কর্মসংস্থান সম্পর্কিত যে তথ্য প্রকাশ করেছে তা রীতিমতো আতংকজনক। তাদের তথ্য দেখিয়েছে, ডিসেম্বর ২০১৯-র সাপেক্ষে গত বছর ডিসেম্বরে ১.৭ কোটি কাজ হারিয়ে গেছে ভারতে শ্রম বাজার থেকে। ২০২০-২১ এ অক্টোবর – ডিসেম্বরের মধ্যে গত বছরের সাপেক্ষে ২.৮ শতাংশ কাজ হারিয়ে যায়। ডিসেম্বরে কর্মহীনতার হার ৯.১ শতাংশ, যা সেপ্টেম্বরের ৬.৭ শতাংশ থেকে অনেক বেশি আর সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো শহুরে কর্মসংস্থানের নিদারুণ হাল। নভেম্বর মাসে যে কর্মহীনতার হার ছিল ৬.২ শতাংশ, তা মাত্র একমাসের মধ্যেই অর্থাৎ ডিসেম্বরে বেড়ে দাঁড়ায় ৯.২ শতাংশ। শহুরে তরুণ, বিশেষ করে মহিলা আর বেতনভুক কর্মীরাই সবচেয়ে বেশি কাজ হারিয়েছেন। যাবতীয় প্রকাশিত তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, লকডাউন ও আর্থিক বিপর্যয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন মহিলারা। সমগ্র শ্রমশক্তির মাত্র ১১ শতাংশ মহিলা হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে কর্মহীনতার হার ৫২ শতাংশ!!
সরকারী তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, এই অক্টোবরেই মনরেগা প্রকল্পে কর্মপ্রার্থির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৯১.৩ – যা প্রমাণ করে অন্য জায়গায় বিশেষত শহরে কাজ না থাকায় ভিড় বাড়ছে গ্রামাঞ্চলে। লকডাউন পর্যায়ে শহর থেকে গ্রামমুখী হওয়ার এই যে উল্টো স্রোত বা রিভার্স মাইগ্রেশন, তা আজও বন্ধ হয়নি। গ্রামীণ ক্ষেত্রে এই অত্যাধিক শ্রমশক্তির চাপ আর্থিক নিয়মেই গ্রামীণ মজুরিকে টেনে নীচের দিকে নামিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে যে শহরের ইনফর্মাল সেক্টরগুলো এখনো নাছোড় স্থিতাবস্থায় চলছে, ফলে শহরমুখী হওয়ার প্রবণতা এখনও দেখা যাচ্ছে না। এটাই উন্মোচিত করে মোদী সরকারের ঝুঠা দাবি, যে আবার চাঙ্গা হচ্ছে ক্ষুদ্র ছোট মাঝারি শিল্প বা কর্মসংস্থানের অবস্থা, যা আমাদের অর্থনীতির ক্ষেত্রে ভালোই প্রাধান্য রেখে চলে।
দেখা যাচ্ছে, প্রকৃত গ্রামীণ মজুরি সারা দেশেই সংকুচিত হয়েছে। মোট ১৮ রাজ্যের মধ্যে মাত্র ৫টি রাজ্যের পাওয়া তথ্য (এ রাজ্যের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি) থেকে জানা যাচ্ছে (পঞ্জাব-হরিয়ানা-কেরল-অসম-ত্রিপুরা) সেপ্টেম্বর ২০২০-তে প্রকৃত মজুরির হার ছিল গত পাঁচ বছরে সবচেয়ে কম। কেন্দ্রীয় সরকারের লেবার ব্যুরো জানাচ্ছে, এই নিম্নমুখী পতন বেশ কিছুদিন যাবত অব্যাহত থাকবে।
জেএনইউর অধ্যাপক ও অর্থশাস্ত্রী অরুণ কুমার বলেছেন, চলতি অর্থবছরে দেশের অর্থনীতি সংকুচিত হবে ২৫ শতাংশ হারে। এর কারণ হিসাবে তিনি দেখিয়েছেন, অসংগঠিত ক্ষেত্র, যা,আমাদের দেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে ৫৫ শতাংশ অবদান রাখে, এখনো ধুঁকছে, জিডিপিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে যে পরিষেবা ক্ষেত্র, তার পুনরুজ্জীবনেও তেমন কিছু লক্ষণ চোখে পড়ছে না।
হ্যাঁ, কিছু মাত্রায় আর্থিক পুনরুদ্ধার হচ্ছে বৈকি। তবে এই পুনরুদ্ধার হচ্ছে নতুন করে বিরাট অসাম্য, আর্থিক বৈষম্যের হাত ধরে। আমরা আগের একটি সংখ্যায় এ বিষয়ে ব্যাখ্যা রাখি। প্রখ্যাত অর্থশাস্ত্রী প্রভাত পট্টনায়েক হালে তাঁর একটা প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে বিভিন্ন সংস্থা তার উৎপাদন খরচকে কমাতে কর্মী ছাঁটাই করছে, অবশিষ্ট কর্মীদের বেতন বা মজুরিতে হাত দিয়েছে। যে সমস্ত কর্মীদের (স্থায়ী চরিত্রসম্পন্ন বেতনভুক কর্মী) এতোদিন সহজে ছেঁটে ফেলা যেতো না, বা যাদের বেতন বাজারের ওঠা নামার ভিত্তিতে নির্দ্ধারিত হতো না, তারাই এবার কর্মচ্যুত হলেন। তাঁদের বেতনকে সংকুচিত করা হলো। উল্লেখিত সিএমইআই-র রিপোর্ট সেই কথাই বলছে। এই পর্যায়ে কর্পোরেট সংস্থাগুলো যে মুনাফা অর্জন করেছে তা এই পথে। অর্থাৎ, একদিকে শ্রমসময়ের হ্রাস ঘটিয়ে মজুরি হ্রাস আর অপরদিকে মজুরি বা বেতনের হ্রাস। পাশাপাশি কর্মী কমিয়ে উৎপাদন খরচ কমানো। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তার রিপোর্টে দেখিয়েছে, এইভাবেই কর্পোরেট সংস্থগুলো খরচ কমিয়ে মুনাফা অর্জন করছে। আর মুনাফা বা সরকারের নানা তোফা পকেটে পুরলেও তারা বিনিয়োগ ততদিন করবে না যতদিন না পর্যন্ত বাজারে চাহিদা বাড়বে। এটাও প্রভাত পট্টনায়েক দেখিয়েছেন, যে কর্পোরেট সংস্থাগুলো তুলনামূলকভাবে অধিক শ্রমনিবিড়, তার তুলনায় কম শ্রমনিবিড় সংস্থাগুলোর আর্থিক বৃদ্ধি ভাল।
ছাঁটাই রোধ, মজুরিকে সংরক্ষিত করাটা এখন গুরুত্বপূর্ণ দাবি হয়ে সর্বত্র সামনে আসছে। বলা যায়, এটা এক বিশ্বজনীন দাবি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে “# ফাইট ফর ২৫ ডলার মিনিমাম ওয়েজ পার হাওয়ার একটা মঞ্চ হিসাবে আবির্ভূত হয় যা আজ রীতিমতো জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। তারা নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বাইডেনের কাছে তাঁর কার্যভার গ্রহণের প্রথম ১০০ দিনের মধ্যে যে কাজ সম্পন্ন করার দাবি তুলেছে তা বিগত ১০ বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থমকে থাকা ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি করে ঘন্টায় ১৫ ডলার করা, (যা প্রাক নির্বাচনী পর্বে বাইডেন প্রতিশ্রতি দেন) মজুরি সংরক্ষণ, সামাজিক সুরক্ষা, ইউনিয়ন গঠনের অধিকার।
যে অসাম্যের রাস্তা ধরে দেশের অর্থনীতি আবার পুনরুদ্ধারের গতিপথ শুরু করেছে প্যান্ডেমিক পরবর্তী পর্বে, তাকে উলটো পথে ঘোরানোই আজ জনগণের দাবি। কর্পোরেটদের স্বার্থে অনুসৃত নীতিমালা নয়, জনগণের স্বার্থ বহনকারী নীতিই রূপায়ন করতে হবে, আর এই লক্ষ্যেই চলমান কৃষক আন্দোলন নিত্যদিন নতুন নতুন উদাহরণ তৈরি করছে।
- অতনু চক্রবর্তী