প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর উদ্ভূত পরিস্থিতির মোকাবিলার প্রয়াস আমেরিকার জনগণ যখন চালিয়ে যাচ্ছেন, তখন গোটা দুনিয়ার কাছে এক জোরালো সতর্ক বার্তাও ধ্বনিত হচ্ছে। কেননা, বিশ্ব পুঁজিবাদের যে সংকট বেড়ে চলেছে, বিশেষত অতিমারী একনাগাড়ে দু-বছর নাছোড়বান্দার মতো পৃথিবীতে চলতে থাকায় যা আরও তীব্র হচ্ছে, তারই অনিবার্য সঙ্গী হচ্ছে সংসদীয় গণতন্ত্রের বিপন্নতা।
ভোট গণনা শুরু হওয়ার সময় থেকেই ট্রাম্প নির্বাচনকে হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ এনে ওই গণনাকে থামানোর চেষ্টা চালিয় যাচ্ছিলেন। কিন্তু তাঁর ওই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং দেশের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট রূপে জো বাইডেনকে দেখতে আমেরিকা এখন প্রস্তুত। নির্বাচনের বৈধতায় স্বীকৃতি দেওয়ার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া মার্কিন সংসদ যখন চালাচ্ছিল, ট্রাম্প তখন সংসদ ভবনে আক্রমণ চালানোর জন্য তাঁর সমর্থকদের উস্কিয়ে তুললেন। প্রেসিডেন্ট হিসাবে চার বছরের স্বৈরশাসনে ট্রাম্প সাহেব কখন কি করবেন তা অনুমান করা কারও পক্ষেই সম্ভব ছিল না, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হোক বা বাকি দুনিয়া, কেউই কল্পনা করতে পারেনি যে উনি একেবারে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে বসবেন।
ব্যর্থ অভ্যুত্থানের খুঁটিনাটি যা প্রকাশ্যে আসছে সেগুলো আমরা যখন বুঝে ওঠার চেষ্টা করছি, তখন এটা ক্রমেই আরও বেশি করে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, আক্রমণ কখনই অতর্কিতে বা স্বতঃস্ফূর্তভাবে চালানো হয়নি, তা ছিল সুপরিকল্পিত এবং উদ্যোগটা প্রশাসনের ভেতর থেকেই চালানো হয়েছিল। দশকের পর দশক ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের নানা দেশেই সরকারের পতন ঘটিয়েছে, সামরিক অভ্যুত্থান এবং গণহত্যার সংঘটনে ইন্ধন যুগিয়েছে, যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে, গৃহযুদ্ধ উস্কিয়ে তুলেছে, এবং সম্ভাব্য সমস্ত উপায়েই জমানা পরিবর্তন সংঘটিত করেছে। আর, এ সবই করেছে স্বৈরাচারী শাসকদের ক্ষমতায় বসিয়ে তাকে গণতন্ত্র বলে চালানোর লক্ষ্যে। যে অভ্যুত্থান ৬ জানুয়ারী ঘটল তার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, ‘গণতন্ত্র রপ্তানির’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত উদ্যোগ আজ আত্মঘাতী হয়ে দেখা দিতে শুরু করেছে।
প্রেসিডেন্ট রূপে ট্রাম্প যে ক্ষমতায় আসতে পারলেন এবং তারপর ইসলামোফোবিয়া ও অভিবাসী আতঙ্কের আগুন উস্কিয়ে তুলে আমেরিকার অভ্যন্তরে এক শক্তিশালী বর্ণবাদী উন্মাদনার জন্ম দিলেন; এরপর কোভিড-১৯ অতিমারীতে ব্যাপক সংখ্যক নাগরিকের মৃত্যু এবং প্রশাসনের তীব্র সংকটের মুখে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলেও ট্রাম্প প্রায় অর্ধেক আমেরিকার সমর্থন পেলেন; এই ঘটনাটাই দেখিয়ে দেয় যে, ব্যর্থ হয়ে যাওয়া ৬ জানুয়ারীর অভ্যুত্থানকে আমেরিকা এক দুঃস্বপ্ন বলে উড়িয়ে দিতে পারে না। পচন অত্যন্ত গভীরে ছড়িয়েছে এবং ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট জমানা যে উত্তরাধিকার রেখে গেল তার থেকে দ্রুত ও সহজে উদ্ধার পাওয়া যাবে না।
প্রেসিডেন্ট রূপে ট্রাম্প জমানার উত্থান আমেরিকার সামাজিক কাঠামোর গভীরে প্রোথিত বর্ণবাদ এবং শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদকে হাট করে খুলে দিয়েছে। ক্রমবর্ধমান কর্পোরেট আগ্ৰাসন এবং গণতন্ত্র, জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা ও আইনের শাসনের বুনিয়াদী নীতির মধ্যে স্বার্থের তীব্র দ্বন্দ্বকেও তা সামনে এনেছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে লাগামহীন বেসরকারীকরণ আমাদের নিরবচ্ছিন্নভাবে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ও প্রশাসনের বেসরকারীকরণের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, এবং এই পথে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং পদ্ধতিগুলোকে ফোঁপরা করে তুলছে। ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট জমানা শুধু হিটলারের নয়া অবতারের করাল ছায়াকেই মূর্ত করেনি, নিরঙ্কুশ কর্পোরেট শাসনের রূপ কি হতে পারে তার আভাসও দিয়েছে। ব্যর্থ হয়ে যাওয়া ট্রাম্প অভ্যুত্থান সারা বিশ্বেরই ক্রোধ ও ধিক্কার আকর্ষণ করেছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের সরকার নির্বাচনী ফলাফল মেনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে প্রেসিডেন্ট পদে পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়েছেন। যে নরেন্দ্র মোদী ট্রাম্পের প্রবল সমর্থক রূপে নিজেকে জাহির করেছিলেন ‘হাউডি মোদী’ ও ‘নমস্তে ট্রাম্প’ কর্মসূচীতে ট্রাম্পকে সঙ্গে নিয়ে, দ্বিতীয়বারের জন্য শাসন ক্ষমতায় ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনের জন্য জনসভায় প্রচার চালিয়েছিলেন, সেই নরেন্দ্র মোদীও টুইট করে তাঁর ‘উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছেন। তবে মোদী ভক্ত এবং কট্টর ট্রাম্প সমর্থকদের মধ্যে যে প্রবল একাত্মতা রয়েছে, ব্যর্থ হয়ে যাওয়া অভ্যুত্থানের সময় তা আবারও দেখা গেল, ভিড়ের মধ্যে কয়েকজন মোদী সমর্থক বলে চিহ্নিত হয়ে পড়েছিলেন।
ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে আমরা এমন সমস্ত ঘটনা দেখতে পাই যেগুলোর সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০২১-এর ৬ জানুয়ারীর ক্যাপিটল হানাদারির পুরোদস্তুর মিল রয়েছে। বিজেপির পূর্বসূরী ভারতীয় জনসংঘের হাজার-হাজার সমর্থক ১৯৬৬ সালের ৭ নভেম্বর গরু জবাইয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা জারির দাবিতে ভারতের সংসদে হামলা চালিয়েছিল। এর ছাব্বিশ বছর পর বিজেপি সমর্থকরা সুপ্রিম কোর্টকে সরাসরি অবজ্ঞা করে প্রকাশ্য দিবালোকে বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। পুলিশ ১৯৬৬র হামলাকে দমন করলেও ১৯৯২ সালে তারা নীরব দর্শক হয়েই থাকে। বিজেপি এখন প্রধান রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করায় মসজিদ ভাঙ্গায় যুক্ত সবাই খালাস পেয়ে গেছে এবং গুঁড়িয়ে যাওয়া মসজিদের স্থানে মন্দির নির্মাণের রায়ের মধ্যে দিয়ে সুপ্রিম কোর্টে তারা পুরস্কৃতও হয়েছে। সংঘ বাহিনী এখন যে কায়দাটাকে নিখুঁতভাবে আয়ত্ত করেছে তা হল গণ প্রহারের কৌশল যার মাধ্যমে জনগণকে চুপ করিয়ে দেওয়া ও তাদের হত্যা করা যায়, আর বিজেপি যে শিল্পটাকে নিপুণ করে তুলেছে তা হল বিরোধী পক্ষের বিধায়ক ও সাংসদদের কিনে নেওয়া এবং অধ্যাদেশ জারি করে ও প্রতারণামূলকভাবে আইন পাশ করিয়ে আইনসভাগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া ও সেগুলোর ওপর জোরজবরদস্তি চালানো।
আমরা ভারতবাসীরা কেবল বিপন্নতার ঝুঁকির বিনিময়েই আমেরিকায় চালানো অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার শিক্ষাকে অবজ্ঞা করতে পারি। কোনো ভোটাভুটি ছাড়াই ভারতীয় সংসদে যখন আইন পাশ করানো হয়, কৃষকরা এই দানবীয় ও বিপর্যয়কর আইনগুলোর বাতিলের দাবি তুললে সরকারের নীতি রচনাকারী শাখা যখন কৃষকদের “বড্ড বেশি গণতন্ত্র দেওয়া হচ্ছে” বলে অভিযোগ জানায়, সরকারের বিরোধিতা করার জন্য ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের প্রাধান্যকারী অংশ যখন কৃষকদের দেশদ্রোহী আখ্যা দেয়, তখন আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, আমরা এখনও এক গুরুতর সময়েরই মোকাবিলা করছি। মার্কিন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রপন্থী যে সমস্ত শক্তি ট্রাম্পের রেখে যাওয়া বিপর্যয়কর উত্তরাধিকারের অবসান ঘটানো ও তাকে কাটিয়ে ওঠার জন্য লড়াই করছেন তাদের পাশে দাঁড়ানোর সাথে-সাথে ভারতেও আমাদের ফ্যাসিবাদী-কর্পোরেটদের হাতে ভারতীয় গণতন্ত্রের কব্জা হয়ে যাওয়াকে প্রতিহত করতে কঠোর লড়াই চালাতে হবে।
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১২ জানুয়ারী ২০২১)