গত বছর জুলাই মাসে যখন সারা দেশে লকডাউন চলছিল, তখন কাশ্মীরের শোপিয়ান জেলায় ঘটা এক পুলিশ এনকাউন্টার খবরের শিরোনামে আসে। রাষ্ট্রীয় রাইফেলের ক্যাপ্টেন ভূপিন্দর সিং আরো দুই অধস্তন কর্মীদের নিয়ে ‘অপারেশন’টি চালান। ঘটনার পর থেকেই কাশ্মীরীরা বলে আসছিলেন যে ওটা ছিল আসলে একটা ফেক এনকাউন্টার। তাঁদের দাবি নিহত ব্যক্তিরা আসলে নিরীহ নিরপরাধ শ্রমিক। সেনার তরফ থেকে প্রথমে এই অভিযোগ অস্বীকার করা হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা তাদের অবস্থান পাল্টাতে বাধ্য হয়।
১৮ জুলাই ২০২০। কাশ্মীরের শোপিয়ান জেলার আমশিপোরা গ্রাম। হঠাৎ খবর আসা শুরু করে যে ওই গ্রামে রাষ্ট্রীয় রাইফেলের জওয়ানেরা তিন ‘জঙ্গিকে’ হত্যা করেছে । যদিও সেনার তরফ থেকে সেই জঙ্গিদের কোনো পরিচয় নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়নি। পরের দিন, সাংবাদিক সম্মেলন করে ভারতীয় সেনার পক্ষ থেকে বলা হয় যে ‘বিশেষ সূত্র’ থেকে খবর এসেছিল যে চার পাঁচ জন বিদেশী জঙ্গি নাকি ওই এলাকায় গা ঢাকা দিয়ে আছে। খবর পাওয়া মাত্রও সেনার তরফ থেকে গতিবিধি শুরু করা হয়। ওই এলাকাটিকে সেনার জওয়ানেরা ঘিরে তল্লাশি চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। অবশেষে জঙ্গিদের নাগালের মধ্যে পেলে জওয়ানেরা তাদের তিন জনকে ধরাশয়ী করে। সাংবাদিক সম্মেলনে আরো বলা হয় যে উক্ত জঙ্গিদের কাছ থেকে প্রচুর পরিমানে অত্যাধুনিক অস্ত্র শস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
পরের মাস থেকেই অন্য রকম খবর আসা শুরু করে। নিহতদের নিরীহ মজদুর বলে দাবি জানান কিছু স্থানীয় অধিবাসী। পাশের রাজোরি জেলার এক পরিবারের তরফ থেকে বলা হয় নিহত ওই তিন ব্যক্তি আসলে তাঁদের পরিবারের সদস্য। তাঁরা নিহতদের নাম ঘোষনা করেন – তাঁদের মতে এই তিনজনের নাম ছিল ইমিতিয়াজ আহমেদ (বয়েস কুড়ি), আবরার আহমেদ (বয়েস ষোলো) এবং মোহাম্মদ ইব্রার (বয়েস পঁচিশ)। তাঁরা আরো জানান যে এই তিন জন আসলে একে ওপরের ভাই। জুলাই মাসের ষোলো তারিখে তারা শোপিয়ান জেলায় যায় কাজের সন্ধানে। কিন্তু তারপর থেকে তাদের সাথে তাদের পরিবারের কোনো যোগাযোগ হয়নি। চিন্তিত হয়ে পরিবারের লোকজন পুলিশকে খবর দেয়। এই মর্মে পরিবারের লোকের রাজোরি জেলায় পিরি থানায় নিরুদ্দেশ রিপোর্ট করে। ইতিমধ্যে তাঁদের কাছে আমশিপুরা এনকাউন্টারের খবর আসে। সোশ্যাল মিডিয়া মারফত নিহতদের ছবি ও তাঁদের হাতে আসে। সেই ছবি দেখেই তাঁরা তাদের সন্তানদের চিনতে পেরেছেন বলে তাঁরা দাবি করেন।
এই রিপোর্টের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করে জম্মু কাশ্মীর পুলিশ। তদন্তে জানা যায় যে নিহতদের প্রত্যেকের কাছেই তাদের আধার কার্ড ছিল। যদিও সেনার তরফ থেকে দাবি করা হয় যে তথাকথিত নিহত জঙ্গিদের কোনো পরিচয় পাওয়া যাও নি। আর সনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়ে তারা নিহতদের বারামুলা জেলার এক অচিহ্নিত কবরখানায় কবর দিয়ে আসে। এই খবরের পর মৃতদেহ কবর থেকে বার করে ডিএনএ নিরীক্ষণ করার দাবি জানায় উক্ত পরিবার। ডিএনএ পরীক্ষায় পাওয়া যায় যে, ওই নিহত তিন ব্যক্তি আসলে ওই পরিবারেরই সদস্য। এর পরে স্বাভাবিক ভাবেই এটাও প্রমান হয় যে সেনার তরফ থেকে ওই একাউন্টার সম্পর্কে যা বলা হয়েছিল তার এক বর্ণ ও সত্য নয়। এর পর সেনার তরফ থেকে উচ্চ স্তরীয় তদন্তের ঘোষণা করা হয়।
জম্মু কাশ্মীর পুলিশ সম্প্রীতি অভিযোগ পত্র (চার্জশীট) দায়ের করেছে। তাতে, প্রথমিক অনুসন্ধানের করে তার জেনেছে যে আসলে রাষ্ট্রীয় রাইফেরলের ক্যাপ্টেন ভূপিন্দর সিং আরো কিছু তার কিছু অধস্তন কর্মী ও অসামরিক ইনফর্মারদের নিয়ে এই ‘ষড়য্ন্ত্র’টি করে। তারা তিন মজদুর কে হত্যা করে, তাদের পরিচয় লোপাট করার চেষ্টা করে, এবং তার পরে তাদের শবের পাশে অত্যাধুনিক হাতিয়ার রেখে তাদেরকে ‘জঙ্গি’ বলে চালানোর চেষ্টা করে। জম্মু কাশ্মীরের সাধারণ নাগরিকদের একাংশের ধারণা যে শুধুমাত্র পুরস্কারের লোভে রাষ্ট্রীয় রাইফেলের জওয়ানেরা ওই হত্যা লীলা চালানো হয়।
- বিষ্ময় বসু