(“ভারতের অর্থনীতি ভি অক্ষরের মতো আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে, আর গোটা দুনিয়া তা দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছে” -- অমিত শাহ এই উক্তি করেছেন। বিপর্যস্ত জনতার প্রতি নির্মম পরিহাস, না কি, নির্লজ্জ বেহায়াপনা -- কী বলা যায় হোম মিনিস্টারের এই উক্তিকে? ‘ইন্ডিয়া স্পেন্ড’-এ প্রকাশিত ২২ জানুয়ারী ২০২১ তারিখের একটি লেখা এই নির্লজ্জ মিথ্যাচারকে আবার উন্মোচিত করেছে। আমরা এই লেখাটির কিছু মূল অংশ এখানে প্রকাশ করলাম। - সম্পাদকমন্ডলী)
ভারতের লাখ লাখ নিম্ন-আয় সম্পন্ন ও দরিদ্র পরিবার বর্তমানে তীব্র আর্থিক সংকটের জালে জর্জরিত। অতিমারী ভারতের অর্থনীতিকে ছারখার করে ব্যাপক বেকারত্ব বৃদ্ধির পাশাপাশি মজুরির উপরও আঘাত নামিয়ে এনেছে। এখন এরসাথে যুক্ত হয়েছে খাদ্য সামগ্রির দীর্ঘমেয়াদি মূল্যস্ফীতি। এই সাড়াশি আক্রমণে নাভিশ্বাস ওঠা দরিদ্র পরিবারগুলো এখন খাদ্যের পেছনে তাদের ব্যয় সংকুচিত করতে শুরু করেছেন, যা ডেকে আনছে শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি, দারিদ্রের কারণে খাদ্য সামগ্রির ক্ষেত্রে টানাটানি শুরু হয়েছে।
অর্থশাস্ত্রীরা বলছেন, সঞ্চিত টাকার উপর হাত পড়ায় দেশের মোট সঞ্চয় নিম্নগামী হচ্ছে, যা ভোগব্যয়ে প্রভাব ফেলছে, ফলে আর্থিক পুনরুদ্ধার আরও বিলম্বিত হবে। ভোগ্যপণ্যের বাজার চাঙ্গা না হলে, বিনিয়োগকারীরাও বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হচ্ছেন না। আন্তর্জাতিক লগ্নিকারীরাও এমন এক বাজারে পুঁজি ঢালবেন না, যেখানে ক্রেতাদের পণ্য খরিদ করার জন্য গ্যাঁটে টাকা নেই। এর প্রভাব পড়বে কর্মসংস্থানেও।
দারিদ্র ও ক্ষুধা ঊর্দ্ধমুখী। অক্টোবর মাসে খাদ্য সামগ্রির মূল্যস্ফীতি মাথাচাড়া দিয়ে ১১ শতাংশে ছুঁয়ে যায়, আর নভেম্বরে তা সামান্য নামে ৯.৪৩ শতাংশে। অতিমারীর আগে ভোগ্যপণ্য মূল্য রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সর্বোচ্চ সীমা ৬ শতাংশের আশেপাশে ঘোরাফেরা করছিল। অতিমারীর পর, আর প্রধানমন্ত্রী আচমকা দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণা করার পর কৃষিক্ষেত্রে সাপ্লাই চেন বিপর্যস্ত হয়ে যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিগত কয়েক মাসে খাদ্য সামগ্রির মূল্যস্ফীতির পেছনে এটাই সবচেয়ে বড় কারণ। খাদ্য সামগ্রির ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি গরিব মানুষদ্রের উপর নিদারুণ প্রভাব ফেলছে কারণ ইতিমধ্যেই তাঁদের বিরাট এক অংশই কর্মহীন, বা অনেক কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
বিশিষ্ট অর্থশাস্ত্রী জয়তী ঘোষ বলেছেন, “এমন একটা সময়ে মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে যখন কাজকর্ম খুইয়ে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন নির্বাহ করাটাই দুরূহ হয়ে উঠেছে”। তিনি নানা তথ্য দিয়ে দেখিয়েছেন, “শুধু অতিমারীর সময়েই নয়, তারও আগে যখন দেশের অর্থনীতি তীব্র মন্থরতার মুখে পড়ে, তখন অনেকেই নতুন কাজ খুঁজে পাননি। আর, যাদের হাতে কাজ ছিল, তাঁরাও কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হন। বেশির ভাগ স্বনিযুক্ত কর্মীদের মজুরি আগের তুলনায় অনেক হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, দেশে দারিদ্র ও ক্ষুধা এক লাফে অনেকটাই বেড়েছে।”
জ্বালানির উপর কর মূল্যস্ফীতিকে আরও বাড়িয়েছে। অর্থশাস্ত্রীদের অভিমত, জ্বালানির উপর ক্রমবর্ধমান মাশুল বৃদ্ধি এই মূল্যস্ফীতিকে বাড়াতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। এরফলে ধাক্কা খেয়েছে লক্ষ লক্ষ স্বনিযুক্ত ভারতীয় ও ক্ষুদ্র ব্যবসা আর তার সাথে সম্পর্কযুক্ত লক্ষ কোটি ইনফর্মাল সেক্টরের শ্রমিকেরা, যারা এই আর্থিক সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
মূল্যস্ফীতি, সংকোচন ও খাদ্য বন্টন। অর্থনীতির নজিরবিহীন সংকোচনের হাত ধরে বেড়েছে খাদ্যসামগ্রির মূল্য। লক্ষ কোটি দরিদ্র ভারতবাসী এবং নিম্ন-আয় সম্পন্ন পরিবারগুলোর হাতে নগদ টাকা তুলে না দেওয়ায় ইতিমধ্যেই বহু অর্থশাস্ত্রী মোদী সরকারকে সমালোচনা করেছেন। আর, সরকারের তরফ থেকে এই খরচ না করাটা বর্তমানে অর্থনীতির সংকোচনের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ। একথা বলেছেন জেএনইউ’র অর্থনীতির অধ্যাপক ও প্ল্যানিং কমিশনের ডেভেলপমেন্ট পলিসির প্রাক্তন প্রধান সন্তোষ মেহরোত্রা। তিনি আরও বলেছেন, “জি-২০’র দেশগুলোর তুলনায় ভারতের আর্থিক সংকোচন সবচেয়ে বেশি। গোটা দুনিয়ার মধ্যে এখন আমাদের দেশেই রয়েছে সবচেয়ে বেশি গরিব মানুষের সংখ্যা। তাই এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে আমাদের সরকার একেবারেই ভুল পথে দেশের অর্থনীতিকে পরিচালিত করছে।”
লকডাউনের পর বেশ কয়েকমাস খাদ্য সামগ্রির মূল্যস্ফীতি ছিল অনেক বেশি। এরই সাথে যুক্ত হয় মারাত্মক কর্মহীনতা ও সংকুচিত গ্রামীণ মজুরি। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা প্রকল্পের অধীনে সরকার নভেম্বরের পর আর নিখরচায় খাদ্যশস্য সরবরাহ করেনি। অর্থশাস্ত্রীরা সতর্ক করে জানিয়েছেন যে এর ফলে দারিদ্র-জনিত অপুষ্টির শিকার হবেন বিপুল মানুষ, অর্থের অভাবে গরিব পরিবারগুলো খাদ্য সামগ্রির পেছনে খরচে রাশ টেনে ধরতে বাধ্য হচ্ছেন। জয়তী ঘোষ বলেছেন, “জনকল্যাণমূলক খাতে ও খাদ্য সরবরাহ প্রশ্নে সরকার যে কেন খরচ করছে না তা রীতিমতো এক রহস্য। এমনকি আইএমএফও ভারত সরকারকে আরও বেশি খরচ করার পরামর্শ দিয়েছে।” তিনি অবিলম্বে এফসিআই-র গুদাম থেকে উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য বিতরণ করার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “একদিকে দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ ক্ষুধার জ্বালায় দিন কাটাচ্ছেন, আর অন্যদিকে সরকারী গুদামে উপচে পড়া খাদ্যশস্য পচে নষ্ট হচ্ছে।” লকডাউনের সময়, এপ্রিল-জুনের মধ্যে প্রায় ১,৫০০ টন খাদ্য শস্য পচে নষ্ট হয়। তার সাপেক্ষে, ২০২০-র গোটা অর্থবর্ষে এফসিআই গুদামে নষ্ট হয় ২,০০০ টন খাদ্য শস্য।
বিত্তশালীদের উপর কর বসাও, আরও বেশি খরচ কর। জয়তী ঘোষের মতে, কেন্দ্রীয় সরকারকে অবিলম্বে রাজ্য সরকারের হাতে বেশি টাকা দিতে হবে, খরচ করতে হবে সেই সমস্ত কেন্দ্রীয় প্রকল্পে যেগুলোর মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থান হতে পারে, স্বাস্থ্য শিক্ষার উন্নতিকল্পেও তার প্রভাব পড়বে। বাড়তি খরচের সংস্থান জোটাতে কেন্দ্রীয় সরকার অর্বুদপতি বা অতি ধনীদের উপর সম্পদ কর বসাতে পারে, যারা অতিমারীর সময়ে ব্যাপক মুনাফা অর্জন করেছে (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে যেমনটা ভাবনা চিন্তা চলছে), করনীতির বদল ঘটিয়ে এমএনসি-গুলোকে সেই পরিমাণে কর দিতে বাধ্য করানো যা ঘরোয়া কোম্পানিগুলো দিয়ে থাকে, বা যে সমস্ত সংস্থাগুলোর আর্থিক কার্যকলাপ বেড়েছে, তাদের উপর নতুন কর বিন্যাস প্রভৃতি পদক্ষেপ নিতে পারে সরকার। পরিবারগুলো তাঁদের বহু কষ্টার্জিত সঞ্চয়কে যেভাবে খরচ করতে বাধ্য হচ্ছেন, তা ভারতের থমকে থাকা অর্থনীতির চাকা ঘোরাবে না। তাই সরকারকে তার আর্থিক নীতির গতিপথকে আমূল বদলাতে হবে, আর তার জন্য রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের পথই এখন সংকট মুক্তির একমাত্র পথ।