সংসদে কৃষি আইন প্রণয়ন হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে পাঞ্জাবের কৃষক সংগঠনগুলি একত্রিত হয়। ২৫ সেপ্টেম্বর তাঁরা রাজ্যে বন্ধ ডাকে যা জনজীবন স্তব্ধ করে দেয়। মারণঘাতী এই আইনগুলি আসার আগে কৃষকরা ৩২টি সংগঠনে বিভক্ত ছিলেন। ন’টি স্বতন্ত্র সংগঠন ছিল এছাড়া বাকিরা ‘অল ইন্ডিয়া কিষান সংঘর্ষ কোঅর্ডিনেশন কমিটি’ এবং ‘ভারতীয় কিষাণ ইউনিয়ান’-এর সদস্য ছিলেন। আজকে যখন আন্দোলন উচ্চ পর্যায়ে চলে গেছে তখন কেউ ভাবতেও পারবেন না এই সংগঠনগুলিকে একত্রিত করা কতো কঠিন ছিল। এঁদের মধ্যে ধনী কৃষকের সংগঠন যেমন ছিল তেমনি ছোট, প্রান্তিক কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের সংগঠনও ছিল। গত ২৪ জানুয়ারী বিজয়গড় নিরঞ্জন সদনে ‘স্টুডেন্টস উইথ ফার্মারস’ আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে পাঞ্জাবের কৃষক নেতা রবিন্দার সিং পাতিয়ালা উপরোক্ত কথাগুলি বলেন। তিনি ছাড়াও এই অনুষ্ঠানে জগবির কৌর এবং সুখবিন্দার কৌর উপস্থিত ছিলেন। শ্রী রবিন্দার সিং আরও বলেন ১ অক্টোবর থেকেই তাঁরা দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলনের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেন। তাঁরা তখন থেকেই জানতেন এই আন্দোলন লম্বা চলনে ওয়ালা হ্যায়। তিনি বলেন শুরুতে তাঁরা ভাবতেই পারেননি যে আন্দোলনে এই রকম সাড়া পাওয়া যাবে এবং বিভিন্ন মতাদর্শের এই সংগঠনগুলির মধ্যে ঐক্য এতো সুদৃঢ় হবে।
আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী সুখবিন্দার কৌর বলেন পাঞ্জাবে কৃষি যে গভীর সংকটে নিমজ্জিত হচ্ছে তা গত তিরিশ বছর ধরেই বোঝা যাচ্ছিল। তিনি নব্বই-এর দশকের শুরুতে ডাঙ্কেল প্রস্তাবের উল্লেখ করেন। প্রসঙ্গত আর্থার ডাঙ্কেল কৃষিতে বিশ্বায়ন সূচিত করার প্রধান প্রবক্তা। আমাদের দেশের চাষিরা এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিলেন। ব্যাঙ্গালোরে তাঁরা একটি বহুজাতিক বীজ কোম্পানির অফিস ভাঙচুর করেন এবং ১৯৯৩-এর ৩ মার্চ দিল্লীতে বিশাল মিছিল করে এই প্রস্তাব পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেন। তখন বিকেইউ’র মহেন্দ্র সিং টিকায়েত বলেছিলেন ডাঙ্কেল প্রস্তাব যদি মেনে নেওয়া হয় তাহলে বহুজাতিক কোম্পানিগুলি ভারতীয় কৃষি শাসন করবেন। বলাই বাহুল্য অত্যন্ত দূরদর্শী মন্তব্য! তাৎপর্যপূর্ণভাবে তখন ভুপিন্দার সিং মান, অশোক গুলাটি এবং শ্বেতকারী সংগঠনের শরদ জোশি এই প্রস্তাব সমর্থন করেছিলেন। উপরোক্ত দুই ব্যক্তি এবং শ্বেতকারী সংগঠনের অনিল ঘনোয়াট আজও কৃষক স্বার্থবিরোধী আইনগুলির পক্ষে এবং সুপ্রিম কোর্টের কমিটির সদস্য, যদিও মান পরে পদত্যাগ করেছেন।
শ্রীমতি কৌর বলেন এই সংকটের শুরু ষাটের দশকে সবুজ বিপ্লবের সময় থেকে। তখন সরকারি আধিকারিকরা চাষির ঘরে ঘরে গিয়ে এই নতুন চাষ শুরু করার জন্য প্রচার করেছিলেন। এই অভিনব চাষে দীক্ষিত করার জন্য পাঞ্জাবে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল। এই নতুন পদ্ধতিতে চাষ শুরু করার পর এতো আনাজ হতো যে সরকার পুরো কিনে উঠতে পারতো না। উচ্চফলনশীল বীজ ব্যবহার শুরু হল, আমরা আমাদের পরম্পরাগত সাবেকি চাষের রীতিনীতি ভুলে গেলাম। এই ধরনের বীজ ব্যবহারের কারণে নানা সমস্যা শুরু হল যেগুলো সমাধানের জন্য আবার জমিতে পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ মারার বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োগ করা শুরু হল। আমরা এই বীজ, পেস্টিসাইডস, ইন্সেক্টিসাইডস-এর ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে যে বহুজাতিক সংস্থাগুলি তাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লাম। তাদের ব্যবসায় জোয়ার এলো, চাষিদের দুর্গতি শুরু হল। বিভিন্ন ব্যাংক কম সুদে, সহজ কিস্তিতে ট্র্যাক্টর কেনার ঋণ দিল। পুরো পাঞ্জাব ট্র্যাক্টরে ভরে গেল। এখন বছরের অর্ধেক সময় এই ট্র্যাক্টরগুলি মাল বহন করার কাজে ব্যবহৃত হয়। ক্ষেতমজুরদের মজুরি কমে যাওয়া শুরু হল। আজকে পাঞ্জাবে কৃষক আত্মহত্যার ৫৩% হচ্ছে ক্ষেতমজুর। আমাদের উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক সরকার কেনে বাকিটা ঘরে পরে থাকে। লকডাউনের সময় পাঞ্জাবে একজনও ক্ষুধার কারণে মারা যায়নি কারণ আমাদের ঘরে পর্যাপ্ত পরিমাণে চাল গম ছিল। আমরা বস্তা করে শস্য গুরুদোয়ার পাঠিয়ে দিতাম যা তাঁরা বিভিন্ন জায়গায় লঙ্গর খুলে দুঃস্থ মানুষদের ক্ষুধা নিবারণ করতেন। সরকার আজ কৃষকদের উপদেশ দিচ্ছেন এতো চাল গম উৎপাদন করে কী হবে, আলু, টমাটো, সূর্যমুখি করো? আমরা বলছি এইসব ফসলের জন্য আমাদের এমএসপি দাও, মান্ডি দাও, বিমা দাও, আমরা সানন্দে তা করব। সুখবিন্দার কৌর দৃপ্ত কন্ঠে বলেন আজ আমাদের সমস্যা গভীর রূপ ধারণ করেছে -- এসপার নয় উসপার! কিষাণ থাকলে এই কানুন থাকবে না, কানুন থাকলে আমরা কিষাণরা থাকব না।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন শ্রী ছন্দক চাটার্জি। তিনি বলেন অনেকেরই আক্ষেপ বাংলার চাষিরা কেন এই আন্দোলনে সেইভাবে শামিল হচ্ছেন না। তাঁদের সংগঠন ‘জল, জমিন, জঙ্গল’ কিছু গ্রামে গিয়ে দেখেছেন বেশির ভাগচাষি ঋণগ্রস্ত, ফসল বিমার জন্য আবেদন করতে না পারার দরুণ তাঁরা সেই ব্যবস্থার সুযোগও নিতে পারেন না। আরও গুরুত্বপূর্ণ প্রায় কেউই এই আইনগুলি সম্পর্কে অবহিত নন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে জগবির কৌর পাঞ্জাবি গান পরিবেশন করেন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই মনোজ্ঞ আলোচনার সমাপ্তি ঘটে।
- সোমনাথ গুহ