প্রতিবেদন
সর্বনাশা কৃষি আইন ও সর্বোচ্চ আদালতের সাময়িক স্থগিতাদেশ
ddar

কোম্পানি রাজের স্বার্থে কৃষকের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে দিল্লী সীমান্তে কৃষকের অবস্থান আন্দোলন প্রায় পঞ্চাশ দিন পেরিয়ে এল। সরকারের সাথে কয়েক দফা এর মধ্যে কৃষক নেতাদের বৈঠক হয়েছে। এই সব ব্যর্থ বৈঠকের মধ্য দিয়ে একটাই বিষয় স্পষ্ট হয়েছে। সরকার এই কৃষক প্রতিরোধের ফলে যথেষ্ট কোণঠাসা এবং লাঠি-গুলি চালিয়ে এই আন্দোলনকে দমন করার বিকল্প এই মুহূর্তে বিজেপির মতো চূড়ান্ত দমনকারী সরকারের কাছেও খোলা নেই। তাই আলাপ আলোচনার একটা ভান বজায় রাখা আর অপেক্ষা করা কবে কৃষক ধৈর্য্য হারাবে বা ক্লান্ত হয়ে পড়বে, কবে কৃষকের ঐক্যে ফাটল ধরবে, মনোবলে টান পড়বে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সরকারের সে গুড়ে বালি।
সরকারের হয়ে এবার মাঠে নেমেছে সর্বোচ্চ আদালত। সাময়িক স্থগিতাদেশ জারি করে কোর্ট বলেছে এ স্থগিতাদেশ কৃষি আইনের উপর নয়, কৃষি আইনের বাস্তবায়নের উপর। কিন্তু এই স্থগিতাদেশের সাথে আদালত এটাও বলেছে যে এই পর্যায়ে পুরনো ন্যূনতম সমর্থন মূল্য প্রণালী জারি থাকবে আর এই আইনের ফলশ্রুতি হিসেবে কোন কৃষকই জমি হারাবে না। তবে সরকার যে বলছিল যে নতুন আইনের সাথে এমএসপির কোনো সম্পর্ক নেই, আর পুরো ব্যাপারটাই নিছক ফসল সংক্রান্ত, জমি হারাবার কোন প্রশ্নই ওঠে না? কোর্টের এই স্পষ্টীকরণে সরকারের বক্তব্য আরও সন্দেহজনক হয়ে উঠল না কি?

কোনো আইন সংবিধানসম্মত কিনা তা বিচার করার এক্তিয়ার অবশ্যই সর্বোচ্চ আদালতের রয়েছে। কিন্তু স্থগিতাদেশে আইন সম্পর্কে কোনো কথাই বলেনি সুপ্রিম কোর্ট। পুরো আদেশটাই এসেছে সরকার ও আন্দোলনরত কৃষকদের মধ্যে বর্তমান সংঘাতে যবনিকাপাত কী করে ঘটানো যায় সেই প্রচেষ্টা থেকে। সরকারের বদলে কৃষকদের বলা হলো কোর্ট কর্তৃক ঘোষিত চার সদস্যের কমিটির কাছে নিজেদের অভিযোগ তুলে ধরতে। কমিটিকে বলা হলো দু-মাসের মধ্যে কোর্টের কাছে আলোচনার রিপোর্ট পেশ করত। অর্থাৎ বল এখন কমিটি ও কোর্টের কোর্টে। সরকার যেভাবে পুঁজিপতিদের ঋণ মকুব করে দেয়, সেভাবেই কোর্ট কি এবার সরকারের দায়িত্ব মকুব করে দিল?

কোনো আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকার যদি জনগণের বিরোধিতার সম্মুখীন হয় তাহলে সেই বিরোধ মোকাবিলার দায়িত্ব সেই সরকারেরই। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকারের কথাবার্তা যদি আটকে যায় তাহলে সেই কথাবার্তাকে ফলপ্রসূ করানোর জন্য পরামর্শ দেওয়া যেতেই পারে, কিন্তু সরকারকে সেই দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে পুরো ব্যাপারটা আদালতের নিজের হাতে তুলে নেওয়াটা কি আদৌ সংবিধানসম্মত? সরকার, সংসদ ও আদালত, এই তিন স্তম্ভের মধ্যে ক্ষমতা ও দায়িত্বের যে সুষ্ঠ বন্টনের উপর ভিত্তি করে সংবিধান মেনে গণতন্ত্র পরিচালিত হওয়ার কথা, সেই মূল ব্যাপারটাই কি সুপ্রিম কোর্ট এবার গুলিয়ে দিতে শুরু করেছে?

সুপ্রিম কোর্ট কৃষকদের বলেছে সাময়িক স্থগিতাদেশ ও কমিটি গঠনকেই প্রতিবাদের জয় হিসেবে মেনে নিতে। মোদী সরকার বলছে কৃষকেরা আইন না বুঝে নাকি বিভ্রান্ত হয়ে প্রতিবাদে নেমেছে। তাই আলোচনার নামে কৃষকদের ক্লাস নেওয়ার চেষ্টা করেছে সরকারের মন্ত্রীরা। এবার ক্লাস শুরু হলো আন্দোলন নিয়ে। সুপ্রিম কোর্ট চায় না মহিলা, বৃদ্ধ ও শিশুরা অবস্থান আন্দোলনে অংশ নিক। এক উকিল যিনি বলেছিলেন নির্ভয়ার মার কাছে জানতে চাওয়া উচিত অত রাতে মেয়ে দিল্লীর রাস্তায় কী করছিল, বলেছিলেন নিজের মেয়ে বা বোনের প্রাক-বৈবাহিক সম্পর্কের খবর পেলে পুরো পরিবারের সামনে নিজের খামারবাড়িতে পেট্রোল ঢেলে তাকে পুড়িয়ে মারবেন, এবার তিনি সুপ্রিম কোর্টকে জানালেন যে তাঁর মক্কেল কৃষক সংগঠন নাকি কথা দিয়েছে যে নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা সবাই বাড়ি ফিরে যাবে। সুপ্রিম কোর্ট তাঁকে ধন্যবাদ জানালেও সংশ্লিষ্ট কৃষক সংগঠনটি এই তথ্যকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে। কৃষকেরা এবার ১৮ জানুয়ারী গোটা দেশ জুড়ে কৃষক রমণীদের প্রতিবাদের ডাক দিয়েছেন।

সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশের সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয়টি হল চার সদস্যের নবগঠিত কমিটি। যে চার জন সদস্যকে কোর্ট বেছে নিয়েছে তাদের দুজনের পরিচয় কৃষি অর্থশাস্ত্রী হিসেবে আর অন্য দুজন হলেন দুই কৃষক সংগঠনের নেতা। কিন্তু এঁদের সকলের সাধারণ পরিচয় হলো এঁরা মোদী সরকারের কৃষি নীতি ও নতুন কৃষি আইনের কট্টর সমর্থক। কমিটির প্রথম বৈঠক এখনও হয়নি, কিন্তু কমিটির একজন মনোনীত সদস্য বিবৃতি দিয়ে কমিটি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। ভূপিন্দার সিং মানের এই সরে আসা নিছক তথ্যের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয়, বিবৃতিটিও যথেষ্ট অর্থবহ। মান বলছেন তিনি এমন কিছু করতে চান না যাতে কৃষক এবং পাঞ্জাবের স্বার্থ বিপন্ন হয়। নিজের অবস্থান স্পষ্ট করার সাথে সাথে কমিটি সম্পর্কেও এই মন্তব্য যথেষ্ট ইঙ্গিতপূর্ণ। মান-এর এই মন্তব্যকে আমরা মিলিয়ে নিতে পারি মন্ত্রী নীতিন গডকারির সাম্প্রতিক এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের সাথে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার ‘আইডিয়া এক্সচেঞ্জ’ শীর্ষক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে সাম্প্রতিক কৃষি আইন বিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে গডকারির বক্তব্য খুব স্পষ্ট। তাঁর মতে মূল সমস্যা হলো ভারতে অতিরিক্ত খাদ্যশস্য উৎপাদন এবং বাজার দরের চেয়ে বেশি এমএসপি। ফলে সরকারের কাছে সমাধানসূত্র হলো খাদ্যশস্য উৎপাদন কমিয়ে এনে জৈব ইন্ধন উৎপাদনে জোর বাড়ানো। সোজা কথায় ধান গম চাষের বদলে ইথনল উৎপাদনে মনোযোগী হওয়া। কৃষক যখন কোম্পানির ইচ্ছে, হিসেব এবং নির্দেশ মতো চুক্তিচাষিতে পরিণত হবে তখন কৃষির চরিত্র কী হবে সে ব্যাপারে যথেষ্ট ইঙ্গিতপূর্ণ এই ইশারা।

কৃষি আইনের ঘোষিত উদ্দেশ্য কৃষককে স্বাধীনতা দেওয়া, কৃষকের আয় বাড়ানো। কিন্তু সবুজ বিপ্লবের একদা বহু প্রশংসিত ঘাঁটি পাঞ্জাবের অভিজ্ঞ কৃষকের গডকারির ঐ ‘আসল কথা’ বুঝতে অসুবিধে হয়নি। কৃষিতে আদানি আম্বানির কোম্পানি রাজ প্রতিষ্ঠা মানে কৃষকের শেষ স্বাধীনতাটুকু কেড়ে নিয়ে তাকে কোম্পানির ভাড়াটে বানিয়ে দেওয়া। মূল্য নির্ধারণ ও শস্য ক্রয়ের প্রক্রিয়া থেকে সরকারের সরে যাওয়া মানে কৃষকের ইচ্ছে মতো মূল্য নির্ধারণ ও শস্য বিক্রয় নয়, বাজারের নিয়ম অনুযায়ী মূল্য নির্ধারণ ও কেনাবেচা। আর গডকারি ঠিকই বলেছেন বাজারের দাম এমএসপি বা সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম সমর্থন মূল্য থেকে গড়ে যথেষ্ট কম। যে বাজারে কোম্পানি ক্রেতা আর কৃষক বিক্রেতা সেখানে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে বাজার বিক্রেতা নয়, ক্রেতার কথাতেই চলবে। আর তাই পাঞ্জাবের পোড় খাওয়া কৃষক ‘স্বাধীনতা ও আয় বৃদ্ধির’ ছেঁদো প্রতিশ্রুতির ফাঁদে পা দিতে নারাজ।

ভারতীয় কৃষিতে আজ পর্যন্ত চোখে পড়ার মত সাফল্য বলতে সবুজ বিপ্লবের কথাই আলোচিত হয়েছে। আর স্বাধীন ভারতে আত্মনির্ভরতার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব বলতে আমেরিকার গমের উপর নির্ভরশীলতা কাটিয়ে ওঠা। এই কৃতিত্বের মূলে পাঞ্জাব। সবুজ বিপ্লবের মডেল আজ অবশ্যই গভীর সংকটে – প্রাকৃতিক পরিবেশের অবনতি, জলবায়ু পরিবর্তন, ক্রমবর্ধমান কৃষি খরচ, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নানাবিধ বিপদ সংকেত কৃষি বিকাশের নতুন মডেলের দাবি জানাচ্ছে। মোদী সরকারের নয়া কৃষি আইনে এই বিকল্প পথের অনুসন্ধানের লেশমাত্র নেই। যা আছে তা হল কৃষিকে বৃহৎ ব্যবসায় রূপান্তরিত করার মরিয়া প্রচেষ্টা। তার ফলে আদানি আম্বানির মুনাফার পাহাড় আরও উঁচু হবে, আর খাদ্যশস্যের ব্যাপারে আমরা হয়তো আবার আমদানি নির্ভর হয়ে পড়ব। ক্ষুধার প্রতিযোগিতায় ভারত হয়তো আরও কয়েক ধাপ নীচে নেমে যাবে। কৃষির সঙ্গে যুক্ত ব্যাপক জনগণের দারিদ্র্য হয়ে উঠবে গভীরতর।

তাই দিল্লী সীমান্তের কৃষকের আন্দোলন আজ আর রাজধানীর সীমানায় আটকে নেই। সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে বাঁচাতে ও কৃষক আন্দোলনকে ঠেকাতে যাই ফন্দি আঁটুক, দেশের ব্যাপক মানুষ আজ কৃষকের সাথে। কোম্পানি রাজের বিরুদ্ধে, কৃষকের সাথে; মোদী সরকারের গুন্ডামির বিরুদ্ধে, সংবিধানের পথে গণতন্ত্রের সাথে – এবারের প্রজাতন্ত্র দিবসে এটাই আসমুদ্র হিমাচল ভারতবাসীর মনের কথা। কৃষক জিতলে দেশ জিতবে, আমরা সবাই জিতব। তাই লড়তেই হবে, ছিনিয়ে আনতেই হবে জনগণের জয়।

- দীপঙ্কর ভট্টাচার্য    

খণ্ড-28
সংখ্যা-3